<p>কন্ডোলিৎসা রাইস তখন মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব। ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে গেছি নিউ ইয়র্কে। রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ সভা চলছে। কন্ডোলিৎসা রাইসের সঙ্গে প্রণববাবুর পৃথক দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে রাইস প্রণববাবুকে বলেন, ভারত যাতে মিয়ানমারের সেনা শাসককে সমর্থন না করে এবং সু চির আন্দোলনকে যাতে পূর্ণ সমর্থন দেয়।</p> <p>কেননা সামরিক শাসন কর্তৃত্ববাদের শাসন। প্রণববাবু এই কথাটি শুনে কন্ডোলিৎসা রাইসকে বলেন, সামরিক শাসনের বিরোধিতা করব, কিন্তু আমেরিকাই তো কোনো কোনো ক্ষেত্রে কর্তৃত্ববাদের পক্ষে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে কর্তৃত্ববাদের বিপক্ষে। সেখানেই হয়ে যায় মুশকিল।</p> <p>যেমন- পাকিস্তানে পারভেজ মোশাররফ নওয়াজ শরিফকে সরিয়ে যেভাবে সামরিক অভ্যুত্থান করে ক্ষমতাসীন হলো, সেও তো সামরিক কর্তৃত্ববাদ। আর সেই কর্তৃত্ববাদকে ভারত কেন সমর্থন করবে? আমেরিকা বলে দিচ্ছে, পারভেজ মোশাররফ ইজ এ গুড বয় এবং জুন্টা ইজ ব্যাড বয়। এই যে একেকটি ক্ষেত্রে একেক রকমের দাওয়াই, ভারত তার বিপক্ষে। কেননা ভারত সামগ্রিকভাবে, আদর্শগতভাবে কোনো প্রতিবেশী রাষ্ট্র কেন, পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রেই কর্তৃত্ববাদী শাসনের পক্ষে নয়, সামরিক কর্তৃত্ববাদ তো আরো ভয়ংকর!</p> <p>এই পুরনো ঘটনাটা দিয়ে আজ এই লেখাটা শুরু করলাম এই জন্য যে বাংলাদেশে ৭ জানুয়ারি নির্বাচন। এটা বাংলাদেশে শেখ হাসিনার টানা চতুর্থ মেয়াদ হওয়ার কথা। এই নির্বাচনের আগে বিএনপি ভোট বর্জন করছে এবং জামায়াতের সমর্থন নিয়ে শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবি করে চাইছে যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয় এবং তার নেতৃত্বে ভোট হয়। সেই সম্ভাবনা এখন খারিজ হয়ে গেছে। কিন্তু ভারতের অত্যন্ত জোরালো অবস্থান হলো যে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে, বিশেষ করে গণতন্ত্র থাকাটা ভারতের জন্য বিশেষ প্রয়োজন।</p> <p>সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ আয়োজিত এক আলোচনাসভায় বিষয়বস্তু ছিল, ‘দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত এবং আঞ্চলিকতার ভবিষ্যৎ’। এটা নয়াদিল্লিভিত্তিক নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। সেই সভায় ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব কূটনীতিক শ্যাম শরণ বলেন, ভারত প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ককে মধুর রাখতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। প্রতিবেশী রাষ্ট্রে কোনোভাবে যাতে সামরিকবাদ, কর্তৃত্ববাদ, মৌলবাদ মাথাচাড়া না দেয়, সেটাই ভারতের কাছে একান্ত কাম্য। কেননা যদি প্রতিবেশী রাষ্ট্রে আগুন লাগে, তার আঁঁচ ভারতে এসে পড়ে। সামরিকবাদের হাত ধরে আসে মৌলবাদ এবং তার হাত ধরে আসে সন্ত্রাস।</p> <p>এর ফলে জঙ্গি কার্যকলাপ, খুনখারাবি, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি এবং নানা সমস্যা দেখা দেয়। অতীতে শ্রীলঙ্কায় যখন এলটিটিই সন্ত্রাস<br /> চরমে ছিল, প্রভাকরণ যখন শ্রীলঙ্কায় বসে ভারতবিরোধী কাজের নীলনকশা তৈরি করছিল, তখন ভারতের কাছে কি সেটা কাঙ্ক্ষিত ছিল? ভারতের একজন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী সেই জঙ্গিদের হাতে প্রাণ পর্যন্ত হারিয়েছেন। এই কারণে ভারত বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও চাইছে, যাতে জাতীয় নির্বাচনে আর যা-ই হোক, এই মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক নেতিবাচক শক্তি কোনোভাবে ক্ষমতা দখল করতে না পারে। সেই কর্তৃত্ববাদ হবে কিন্তু গণতন্ত্রের উল্টো পিঠ, যেটা হবে খুব ভয়ংকর!</p> <p>এ কথা ঠিক যে ভারত সব সময় প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পারেনি, বড় দেশের দাদাগিরি নামক একটা বৈশিষ্ট্যের জন্য। এই দাদাগিরি নামক ফেনামেনান পরিত্যাজ্য। অটল বিহারি বাজপেয়ি যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখনো এই বিষয়ে বিতর্ক হয়েছিল। তখন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন ব্রজেশ মিশ্র। তিনি ছিলেন প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি। সেই সময় অভিযোগ উঠেছিল যে ভারত প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপরে দাদাগিরি করছে এবং ব্রজেশ মিশ্র কিন্তু চেষ্টা করেছিলেন সেই অপবাদ ঘোচানোর। বাংলাদেশে তখন খালেদা সরকার ছিল। সেই সময়ই কর্তৃত্ববাদ এবং সামরিক শক্তির মাথাচাড়া দেওয়ার একটা প্রবণতা, সেটা কিন্তু দেখেছিলেন অটল বিহারি বাজপেয়ি। তিনি চেষ্টা করেছিলেন, খালেদা সরকারকে সেটা বারবার বোঝানোর। সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার, হিন্দু মেয়েদের ধর্ষণ, মন্দির ভাঙচুর করা- এসবই তখন বাংলাদেশে হয়েছিল এই মৌলবাদী শক্তির দ্বারা, যেটা ধর্মনিরপেক্ষতা এবং গণতন্ত্রকে ভূলুণ্ঠিত করেছিল। এ জন্য দুর্গাপূজার ঠিক পরপরই ব্রজেশ মিশ্রকে যেতে হয়েছিল বাংলাদেশের শাসকদের বোঝানোর জন্য যে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের এই আচরণ ভারত কখনোই সমর্থন করতে পারে না।</p> <p>শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রেও যেমন সন্ত্রাসবাদের জন্য, মৌলবাদী শক্তির জন্য ভারত-শ্রীলঙ্কা সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে জটিল ছিল। এইতো কয়েক দিন আগে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে বলেছেন, এবার ভারতের সঙ্গে স্থলপথে যোগাযোগের ব্যবস্থা হবে। ২০ বছর আগে যখন এই প্রকল্পের কথা প্রথম উচ্চারিত হয়েছিল, তখন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন রনিল বিক্রমাসিংহে। তখন কিন্তু শ্রীলঙ্কার দিক থেকে সদর্থক সাড়া পাওয়া যায়নি।<br /> ভুটান, মিয়ানমার, মালদ্বীপ এসব দেশে একদিকে যেমন চীনের প্রভাব বাড়ছে, সে রকমভাবে বাড়ছে ভারতবিরোধিতার তাস। এই পরিস্থিতিটা কিন্তু ভারতের জন্যও যথেষ্ট উদ্বেগজনক। ভারত কিন্তু এই প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে নিরন্তর লড়াই করছে। সব প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গেই ভারত সম্পর্ক ভালো করতে আগ্রহী।</p> <p>বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কটা অনেক বেশি আত্মিক। অনেক বেশি আবেগজড়িত। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানবিরোধী লড়াই এবং তার সঙ্গে এত দিন ধরে ইন্দিরা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্পর্ক। সেই ধারাবাহিকতা কিন্তু নরেন্দ্র মোদিও ক্ষমতায় আসার পর ১০ বছর ধরে শাসনকালে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে কেন ভারতের কাছে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ।</p> <p>এই পরিস্থিতিতে এবারের ভোটে বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এবং স্টেট ডিপার্টমেন্ট যেভাবে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনের কথা তুলে বাংলাদেশকে চাপের মধ্যে ফেলে কার্যত বিএনপি ও জামায়াতকে কিছুটা অক্সিজেন জুগিয়েছে, সেটা ভারতের কাছেও সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত। ভারত কিন্তু এ ব্যাপারে সোচ্চার হয়েছে কূটনৈতিক স্তরে। এর কারণ যুক্তরাষ্ট্রকে এটাই ভারত বারবার বলার চেষ্টা করছে যে এতই যদি তাদের গণতন্ত্র-প্রেম হয়, তাহলে চীনে তো কোনো গণতন্ত্র নেই এবং চীনে যেভাবে কর্তৃত্ববাদ চলছে, সে ব্যাপারে কখনোই যুক্তরাষ্ট্র সোচ্চার হওয়ার সাহস রাখে না।</p> <p>আবার পাকিস্তানে যখন সামরিক শাসন হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্রের কণ্ঠস্বর শোনা যায় না। এমনকি পৃথিবীর অন্য বহু দেশে কী হচ্ছে, সেগুলো দেখার চেষ্টা করে না যুক্তরাষ্ট্র। তাহলে শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কেন এ ধরনের আচরণ? কেন শেখ হাসিনাকে দুর্বল করার চেষ্টা? তার মানে কি এই যে আসলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের মধুর সম্পর্কটা কোথাও যুক্তরাষ্ট্রের মনপসন্দ নয়? কোনো একটা জায়গায় যুক্তরাষ্ট্র কি বাংলাদেশকে আরো বেশি সরাসরি প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে আনার পক্ষপাতী, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গুলিহেলনে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটা চলবে, যেটা শেখ হাসিনার পররাষ্ট্রনীতিতে নেই।</p> <p>ভারত মনে করে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করেছিলেন, তার মূল কথাটা ছিল, বাংলাদেশ সমস্ত রাষ্ট্রের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখবে, কিন্তু দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে যদি বৈরিতা থাকে, তাহলে সেই বৈরিতার প্রেক্ষাপটে কোনো একটা রাষ্ট্রের হয়ে বাংলাদেশ তাঁবেদারি করবে না। বাংলাদেশ দুজনের সঙ্গেই সমদূরত্ব নীতি নিয়ে চলবে। বাংলাদেশের দিক থেকে কোনো শত্রু নেই। বাংলাদেশের আলাদা করে বিশেষ কোনো বন্ধুত্ব ভারতের সঙ্গে নিশ্চয়ই থাকবে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে সম্পূর্ণ সার্বভৌম নীতিকে আত্মবিসর্জন দেবে। সেই কারণে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক রক্ষা করছে। সেটাতে ভারতেরও কোনো আপত্তি নেই। কেননা ভারতও চীনের সঙ্গে এই সম্পর্কটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আগ্রহী। এর কারণ বারবার ভারতের কূটনীতিকরাও বলছেন, ভুলে গেলে চলবে না, চীনও কিন্তু ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাওয়াটা কাঙ্ক্ষিত নয় ভারতের জন্য।</p> <p>নয়াদিল্লিভিত্তিক যে সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের আলোচনায় দ্য হিন্দু কাগজের কূটনৈতিক সম্পাদক সুভাষিণী হায়দারও তাঁর বক্তৃতায় বলেছেন যে বাংলাদেশের কোনোভাবেই সামরিক কর্তৃত্ববাদ বা কোনো ধরনের কর্তৃত্ববাদ ভারতের কাছে কাঙ্ক্ষিত নয়। ভারত চায় গণতন্ত্র। সে জন্য নির্বাচনের মাধ্যমে মানুষের সমর্থন নিয়ে এগিয়ে এলে সেটা অনেক বেশি ভালো পরিস্থিতি হতে পারে।</p> <p>আরেকটা অনুষ্ঠানে দেখা যাচ্ছে, ওপি জিন্দল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপিকা শ্রীরাধা দত্ত- তিনি সম্প্রতি আরেকটা আলোচনাসভায় বলেছেন, বাংলাদেশে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকে আজ পর্যন্ত বিএনপি শুধু শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবি করা ছাড়া কোনো বিকল্প রাজনীতি গড়ে তুলতে পারেনি। বাংলাদেশের সামনে কোনো মডেল তুলে ধরতে পারেনি।</p> <p>অনেক দিন ধরে খালেদা অসুস্থ এবং তাঁর পুত্র দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত। এই পরিস্থিতিতে বিএনপির যে সংগঠন বা বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি, সেটা কিন্তু গোটা দেশে দেখা যায়নি। আন্দোলন বলতে একটাই হয়েছে যে শেখ হাসিনার কুশপুত্তলিকা দাহ এবং শেখ হাসিনা হটাও অভিযান। কিন্তু কোনো সত্যিকারের একটা দায়িত্বশীল বিরোধিতা বিএনপি দাবি করতে পারেনি।</p> <p>শ্রীরাধা দত্ত নিরপেক্ষ একজন গবেষক। তিনি কিন্তু আওয়ামী লীগ বা বিএনপি- কোনো দলেরই পক্ষে না থেকে নিরপেক্ষভাবে তাঁর বক্তব্য পেশ করেছেন। এখানে একটা জিনিস বোঝা যাচ্ছে, বিএনপি নামক বিরোধী দলের যে ভূমিকা, সেই ভূমিকা নিয়েও ভারত উৎসাহিত হতে পারেনি। এই পরিস্থিতিতে ভারতের একটাই প্রত্যাশা, বাংলাদেশের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হোক, আবার নতুন করে ধর্মনিরপেক্ষ ও সন্ত্রাসবিরোধী গণতন্ত্রের পথে বাংলাদেশ এগিয়ে চলুক।</p> <p>লেখক : নয়াদিল্লিতে কালের কণ্ঠ’র<br /> বিশেষ প্রতিনিধি</p>