<p>জান্নাতুল ফেরদৌস আইভীর জীবনটা সংকট ও সংগ্রামে ভরা। জন্ম ও বেড়ে ওঠা খুলনায়। ১৯৯৭ সাল। তিনি তখন খুলনা বিএল কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী। ৩০ এপ্রিল। ছোট ভাইকে নিয়ে মা গেছেন স্কুলে। জান্নাতুল তখন আগের রাতে রান্না করা খাবার গরম করছিলেন। পরনে হাফসিল্কের সালোয়ার-কামিজ। ওড়না দিয়ে গরম পাতিল সরাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এত গরম যে ধরে রাখতে পারেননি। ওড়না থেকে আগুন লাগে জামায়। পুড়ে কালো হয়ে যায় হাত, মুখ ও শরীরের বেশির ভাগ অংশ। চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, পৃথিবীতে ৬০ শতাংশের বেশি পোড়া রোগীর বেঁচে থাকার হার খুবই কম। সেই অল্পসংখ্যকের মধ্যে একজন জান্নাতুল।</p> <p>মাসের পর মাস হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। কয়েক মাস পর শরীরের মাংস পচেগলে শুকিয়ে, চামড়ায় টান লেগে থুতনি গলার সঙ্গে লেগে গিয়েছিল। চোখের নিচের চামড়া টেনে চোখ নিচের দিকে নেমে ভয়ংকর অবস্থা। তাকানোর উপায় ছিল না। শুধু গলায়ই তাঁর অপারেশন হয়েছে ১৭টি। ঘাড়ে চামড়া প্রতিস্থাপন করতে হয়েছে। তা ঠিকমতো খাপ খায়নি। পরে আবার অস্ত্রোপচার। এভাবে মোট ৫১ বার অস্ত্রোপচার হয়েছে জান্নাতুলের শরীরে। </p> <p>সেই থেকে প্রায় ২৭ বছরের পোড়া ক্ষতের জীবন জান্নাতুলের। একে তো মেয়ে তার ওপর আবার চেহারাও বিকৃত, এ নিয়ে পদে পদে লড়তে হয়েছে। দূরসম্পর্কের এক নানা এসেছিলেন হাসপাতালে। জান্নাতুলকে দেখে তিনি বলেছিলেন, ‘মাইয়ারে বাঁচাইয়া রাখতে হবে ক্যান? কেমন বিদঘুটে চেহারা। ও তো মা-বাপের বোঝা ছাড়া কিচ্ছু হবে না। ওরে বিষ খাওয়াই মাইরে ফেল?’ সেই স্মৃতি দীর্ঘদিন পুড়িয়েছে জান্নাতুলকে। সুস্থ হতে হতে তিনি বুঝলেন, জীবন নামের রেলগাড়িটা এক ধাক্কায় যেন লাইনচ্যুত হয়ে গেল! বন্ধ হয়ে গেল পড়াশোনা। আক্ষরিক অর্থেই ঘরবন্দি। চার দেয়ালের মধ্যে বইয়ের পাতা আর টিভির পর্দায় আটকে যাওয়া জীবন। বছর তিনেক একাডেমিক পড়াশোনার সঙ্গে সংশ্লেষ ছিল না।</p> <figure class="image"><img alt="kk" height="600" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/Orko/Untitled-4 (1).jpg" width="1000" /> <figcaption>দুর্ঘটনার আগে এমন ছিলেন জান্নাতুল ফেরদৌস আইভী।</figcaption> </figure> <p><strong>মন পোড়েনি</strong></p> <p>তখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ বছরের মধ্যে অনার্স শেষ করতে হতো। কিন্তু সে সময়টা পার হয়ে যায় জান্নাতুলের। এমনিতেই নিজের চিকিৎসা ব্যয়ে পরিবারের ফতুর হওয়ার দশা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও যে পড়বেন সে উপায়ও নেই। তাঁর জায়গায় থাকলে অন্য যে কেউ হয়তো হাল ছেড়ে দিত। কিন্তু আগুনে শরীর পুড়লেও মন পোড়েনি তাঁর। অসীম সাহস আর দৃঢ় মনোবলে চেয়েছেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে। খোঁজখবর নিয়ে জানলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন অনিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে পড়ার সুযোগ আছে। যেন সুড়ঙ্গের শেষে আলোর দেখা পেলেন জান্নাতুল।</p> <p>পরিবার ও বন্ধুদের সহায়তায় অনিয়মিত (প্রাইভেট) শিক্ষার্থী হিসেবে ইডেন মহিলা কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেন। পরে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উন্নয়ন অধ্যয়নেও স্নাতকোত্তর করেছিলেন। ইডেনে ক্লাস করার সুযোগ পাননি। একা একা পড়ে বোঝা ভীষণ কঠিন। কিন্তু কাজটি সহজ হয়ে গেল নিগার হোসেন নামে এক শিক্ষকের সহায়তায়। তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে জান্নাতুলকে ইংরেজি সাহিত্যের খুঁটিনাটি বুঝিয়ে দিতেন।</p> <p><strong>যেন অদৃশ্য মানব</strong></p> <p>মানবাধিকার, এনজিও—এসব নিয়ে পরিষ্কার ধারণা ছিল না জান্নাতুলের। তাঁরা দুই বোন, এক ভাই। তাঁর একমাত্র ছোট বোন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে পড়ছিলেন। তিনি আন্তর্জাতিক আইন, মানবাধিকার ইত্যাদি নিয়ে যখন পড়তেন, জান্নাতুল তাঁর কাছে জানতে চাইতেন—এমন কোনো আইন কি নেই, যা আমাদের মতো মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলে? ছোট বোন তখন জান্নাতুলকে মানবাধিকার বিষয়ে বুঝিয়ে বলতেন। শুনে জান্নাতুলের মনে হতো, ‘সুস্থ হলে আমি মানবাধিকার নিয়েই কাজ করব।’</p> <p>মানবাধিকারকর্মী হিসেবেই ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে যোগ দিলেন যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা অ্যাকশন অন ডিস-এবিলিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে। গ্রামগঞ্জে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার নিয়ে সচেতন করতেন। তাদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন প্রায় ২০ হাজার প্রতিবন্ধী। কিন্তু জেলায় জেলায় কাজ করতে গিয়ে জান্নাতুল উপলব্ধি করলেন—এই ২০ হাজার লোকের মধ্যে কোথাও অগ্নিদগ্ধ ব্যক্তিরা নেই। বললেন, ‘কেবলই ভাবতাম, এত লোকের মধ্যেও আমি একা। নিশ্চয়ই আমার মতো এমন অনেকে আছে। সব সময় মনে হতো, দগ্ধ মানুষগুলোর কথা; তাদের হয়ে বলার মতো কেউ নেই।’ সেই ভাবনা থেকেই ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ভয়েস অ্যান্ড ভিউজ’। অগ্নিদগ্ধ মানুষের অধিকার নিয়েই কাজ করে সংগঠনটি। এই কাজের স্বীকৃতি হিসেবেই এ বছর বিবিসির ১০০ অনুপ্রেরণাদায়ী নারীর তালিকায় উঠেছে জান্নাতুলের নাম।জান্নাতুল বললেন, ‘সবার মধ্যে থেকেও নিজেকে একজন ‘ইনভিজিবল (অদৃশ্য) মানুষ’ বলে মনে হতো। পথেঘাটে, সহকর্মী, প্রতিবেশী এমনকি আত্মীয়-স্বজনও মনে করিয়ে দিত—আমি পোড়া মানব! মানুষের মর্যাদা দিয়ে কেউই আমার সঙ্গে কথা বলত না।’</p> <figure class="image"><img alt="hhh" height="600" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/Orko/Untitled-2 (5).jpg" width="1000" /> <figcaption>জান্নাতুলের নির্মিত খিজিরপুরের মেসি চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য</figcaption> </figure> <p><strong>নীরবে করলেন সব</strong></p> <p>চুলার আগুন তাঁকে থমকে দিতে চেয়েছে। কিন্তু ভেতরের আগুনকে নিভে যেতে দেননি জান্নাতুল। স্ফুলিঙ্গ হয়ে ফোটার জন্য বেছে নিয়েছেন চলচ্চিত্র নির্মাণ, লেখালিখি, ছবি আঁকার মতো সৃজনশীল সব কাজ। কর্মক্ষেত্রেও দেখলেন একই পদে চাকরি করেও জুনিয়ররা তাঁর চেয়ে বেশি বেতন পাচ্ছেন। এই বৈষম্য মানতে পারেননি। কর্মক্ষেত্রে সমান মর্যাদার দাবি নিয়েই ২০১২ সালে নির্মিত তাঁর চলচ্চিত্র ‘নিরবে (সাইলেন্টলি)’। ক্যামেরায় নিজের চেহারার বিকৃতি দেখে সহ্য করতে পারবেন না বলে ছবি তোলা ছাড়াই অনেক বছর পার করেছিলেন। অনেক সময় আয়নাও দেখতেন না। সেই জান্নাতুলই চলচ্চিত্র বানালেন। এতে প্রতিবন্ধী নারীদের কেউ অভিনয় করতে রাজি হয়নি। তাই অভিনয়ও করলেন। সেই চলচ্চিত্রের পোস্টারে বড় করে তাঁর ছবিও ছাপা হলো। চলচ্চিত্রটি প্রদর্শিত হলো বিভিন্ন দেশে। এই চলচ্চিত্রের জন্য জান্নাতুল বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ থেকে সম্মাননা পেয়েছিলেন ২০১৬ সালে। বুয়েটের স্থপতিদের সংগঠন উইপার কাছ থেকে অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। তাঁকে সম্মাননা দিয়েছে রোকেয়া হল অ্যালামনাই অ্যাসোশিয়েশন। এর আগে তানভীর মোকাম্মেলের ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সও করলেন। আরো নানা জায়গা থেকে চলচ্চিত্রবিষয়ক বিভিন্ন শর্ট কোর্স করেন। ‘নিরবে’র আগে প্রতিবন্ধী নারীর জীবন নিয়ে উত্তরণ নামের একটি প্রামাণ্যচিত্রও তৈরি করেন জান্নাতুল। সরকারি অনুদানে মুক্তির অপেক্ষায় থাকা ‘খিজিরপুরের মেসি’ নামে একটি শিশুতোষ চলচ্চিত্রও বানিয়েছেন। উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধসহ এ পর্যন্ত ১১টি বই লিখেছেন।</p> <figure class="image"><img alt="nti" height="600" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/Orko/Untitled-k.jpg" width="1000" /> <figcaption>তাঁর লেখা ্ বইয়ের প্রচ্ছদ</figcaption> </figure> <p><strong>মা তাঁর সাহস</strong></p> <p>পোড়ার যন্ত্রণা নিয়ে জীবন বয়ে চলেছেন জান্নাতুল। এখনো শারীরিক নানা সমস্যায় ভুগছেন। তবে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েননি। বেঁচে থাকতে বাবা সব সময় সাহস জুগিয়েছেন। তিনি জান্নাতুলকে ‘আব্বুজি’ বলে ডাকতেন। জান্নাতুল বললেন, “বাবা সব সময় বলতেন, ‘আগুনের মতো হইয়ো। আগুনকে কেউ পকেটে লুকিয়ে রাখতে চাইলে সে নিজেই পুড়ে মরে যায়।’ সুখে-অসুখে বাবার এই কথাটি মনে রাখেন জান্নাতুল। এখন মাকে নিয়ে থাকেন বাড্ডায়। মা-ই তাঁর আদর্শ। দগ্ধ শরীরের কারণে প্রতিনিয়ত বিরূপ মন্তব্যের শিকার হয়েছেন। বিয়েও করেননি। জান্নাতুল বললেন, ‘শুধু সামাজিকতা রক্ষার জন্য বিয়ের কী দরকার। বিয়ে না করে একা থাকার সাহস জুগিয়েছেন মা।’</p> <p>সুবর্ণ নাগরিক কার্ডে শারীরিক প্রতিবন্ধী হিসেবে পরিচয় আছে জান্নাতুলের। তিনি জানালেন, ২০১৩ সালের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনে প্রতিবন্ধিতা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কথা আছে। তবে সেখানে অগ্নিদগ্ধ ব্যক্তিদের বিষয়ে আলাদাভাবে কিছু বলা নেই। তিনি এই আইনে দগ্ধ হওয়া ব্যক্তিদের বিষয়টিকে প্রতিবন্ধিতার আলাদা ধরন হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য কাজ করবেন।</p>