<p style="text-align: justify;">২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর সমগ্র বিশ্বে পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বিশ্ব মানবাধিকার দিবস’। ১৯৬০ সালের ২৫ নভেম্বর লাতিন আমেরিকার ডমিনিক্যান রিপাবলিকের স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে ভূমিকা গ্রহণের জন্য প্যাট্রিয়া, মারিয়া তেরেসা ও মিনার্ভা মিরাবেল- গির্জার এই তিন সিস্টারকে হত্যা করা হয়। সেই ঘটনা স্মরণে পরবর্তীকালে এই দিনটি আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন শুরু হয়। ১৯৯৩ সালে ভিয়েনা মানবাধিকার সম্মেলনে নারী-পুরুষের মধ্যে অসমতা ও বৈষম্যের কারণে সৃষ্ট জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা বিশেষ গুরুত্ব পায় এবং নারী নির্যাতন বিষয়ে ঘোষণা গ্রহণ করা হয়।</p> <p style="text-align: justify;">তখন থেকে দিবসটি বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃতি পায়। ১৯৯৯ সাল থেকে জাতিসংঘ এই দিনটিকে কেন্দ্র করে ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বিশ্ব মানবাধিকার দিবস হিসেবে পালন করছে। এর পর থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে সচেতনতা ও সামাজিক আন্দোলন সংগঠিত করার লক্ষ্যে পক্ষটি পালিত হচ্ছে।</p> <p style="text-align: justify;">এবারের জাতিসংঘের স্লোগান হচ্ছে : Unite, invest to prevent violence against women & girls. অর্থাৎ ‘নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা বন্ধে এগিয়ে আসুন, সহিংসতা প্রতিরোধে বিনিয়োগ করুন’- এই স্লোগান নিয়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ পক্ষব্যাপী নানামুখী কর্মসূচি পালন করছে।</p> <p style="text-align: justify;">সাম্প্রতিককালে সমাজ ও রাষ্ট্রের অগ্রগতি এবং টেকসই উন্নয়নের সারকথা অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের আলোকে নারীর অবস্থা ও অবস্থান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নারী যত তার সক্ষমতা, দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, সেখানে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াচ্ছে নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা। এই সহিংসতা প্রতিরোধ ও নির্মূলে সামষ্টিক করণীয় আজ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এটা কেবল নারীর সমস্যা নয়, সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়—সেই উপলব্ধি সর্বাগ্রে মনোজগতে ধারণ করতে হবে। এই জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে নারীর প্রতি অধস্তন দৃষ্টিভঙ্গি, যা ক্ষমতার কাঠামোয় নারী-পুরুষের অসম অবস্থান থেকে গড়ে ওঠে।</p> <p style="text-align: justify;">সেই কারণে জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার মূলে রয়েছে নারীর ওপর প্রাধান্য বিস্তারের মনোবৃত্তি, যা সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে অনুমোদন করা হয়। ক্ষমতার কাঠামোতে এই অসম অবস্থান তৈরি করছে ব্যক্তিজীবনে নারীর অধিকারের ক্ষেত্রে মৌলিক বৈষম্য, যেমন- বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, সম্পত্তির অধিকার, সন্তানের অভিভাবকত্ব, স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইত্যাদি।</p> <p style="text-align: justify;">নারীর ক্ষমতায়ন, নারী উন্নয়ন এবং নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধের আলোচনায় আজ বৈশ্বিক এবং জাতীয়ভাবে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো শক্তিশালী করা ও বিনিয়োগের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে সামনে চলে এসেছে। এই বিনিয়োগ একদিকে যেমন নারী ও কন্যা নির্যাতন প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে প্রয়োজন, একই সঙ্গে নারীর ক্ষমতায়নের জন্যও জরুরি।</p> <p style="text-align: justify;">নির্যাতন প্রতিরোধের ক্ষেত্রে প্রয়োজন সহিংসতার শিকার নারী ও কন্যার জন্য সেবামূলক কর্মকাণ্ড  এবং ন্যায্য বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ।</p> <p style="text-align: justify;">এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান কর্মকাণ্ডগুলো; যেমন- ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার, ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার, ডিএনএ ল্যাবরেটরি, সরকারের আইনগত সহায়তা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি ও যথাযথ কার্যসম্পাদন জরুরি। ভিকটিম ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রে ভিকটিমের চিকিৎসা, ট্রমা থেকে উদ্ধারের জন্য কাউন্সেলিং এবং আর্থিক ক্ষতিপূরণের লক্ষ্যে বিনিয়োগ খুব জরুরি। আমরা জানি, বাংলাদেশে নারীর প্রতি সংবেদনশীল বেশ কিছু আইন প্রণীত হয়েছে, কিন্তু এই আইন বাস্তবে নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে এবং বিচারব্যবস্থা কতটা জেন্ডার সংবেদনশীল তার কোনো মূল্যায়ন ও পরিবীক্ষণ নেই। এই মূল্যায়ন ও পরিবীক্ষণের জন্য প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে গুরুত্ব দেওয়া, শক্তিশালী করা এবং বিচারব্যবস্থার সংশ্লিষ্ট মানবসম্পদকে জেন্ডার সচেতনতায় প্রশিক্ষিত করা।</p> <p style="text-align: justify;">সাম্প্রতিক সময়ের সহিংসতার একটি বড় ক্ষেত্র হচ্ছে সাইবার সহিংসতা ও অনলাইন সহিংসতা। বৈশ্বিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৩৮ শতাংশ নারী অনলাইন সহিংসতার শিকার এবং ৮৫ শতাংশ নারী বলেছেন, তাঁরা অন্য নারীর প্রতি ডিজিটাল সহিংসতা প্রত্যক্ষ করেছেন। আমাদের দেশে এর কোনো পরিসংখ্যান নেই। কিন্তু আমরা জানি, আমাদের নারী ও কন্যারা প্রতিনিয়ত সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারীকে হেয় করা, নারীর প্রতি বিদ্বেষমূলক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টিকারী বক্তব্য অবাধে প্রচারিত হচ্ছে।</p> <p style="text-align: justify;">বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতাবিষয়ক তথ্য নিয়মিত সংরক্ষণ করে থাকে। বিগত সময়ের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতার অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও ধর্ষণের চেষ্টার মতো বর্বরতম সহিংসতা। আরো উদ্বেগের বিষয়, এই বর্বরতম সহিংসতার প্রধান শিকার হচ্ছে তরুণী-কিশোরী এবং অপরাধী হিসেবেও দেখা যাচ্ছে তরুণ প্রজন্মের সংখ্যাধিক্য।</p> <p style="text-align: justify;">সহিংসতা প্রতিরোধে আরেকটি বড় ক্ষেত্রে বিনিয়োগের প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়ন। কেননা নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতার সঙ্গে সমাজ ও রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সহিংসতা নারীকে আরো দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেয়। সহিংসতার কারণে একদিকে যেমন স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে অর্থনৈতিক কার্যক্রম থেকে নারীকে সরে আসতে হয়।</p> <p style="text-align: justify;">সহিংসতা নারী ও কন্যার পেশাগত উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতার ক্ষেত্রে নেতিবাচক ভূমিকা রাখে। সম্প্রতি আইএমএফের একটি গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা ১ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটলে অর্থনৈতিক কার্যক্রম ৯ শতাংশ নেমে আসে। বৈশ্বিক এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে, নারীর প্রতি সহিংসতার কারণে (ব্যক্তি পর্যায়, জনপরিসর ও সামাজিক পরিসরে) ক্ষতির পরিমাণ ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলার এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্ষেত্রে জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার ক্ষেত্রে ক্ষতি হয় বছরে ৩৬৬ বিলিয়ন ডলার। সুতরাং দেখা যাচ্ছে নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধের লক্ষ্যে কেবল সুনির্দিষ্টভাবে সহিংসতার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ যথেষ্ট নয়, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে বিনিয়োগ না করলে প্রকৃত অর্থে সহিংসতা নির্মূল হবে না। এর জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয়ভাবে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটি ব্যাপক বহুমাত্রিক সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি এবং নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ। মোটাদাগে বলা যায়, নারীশিক্ষা, কর্মসংস্থান, কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি, নিরাপদ কর্মক্ষেত্র, কর্মজীবী হোস্টেল, যানবাহন ব্যবস্থা, নারী উদ্যোক্তা তৈরি এবং স্বাস্থ্য ও প্রশিক্ষণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ গুরুত্ব বহন করে। কেননা নারীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে। এই সমন্বিত কার্যক্রমে গণমাধ্যম পালন করতে পারে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা, সেই ক্ষেত্রেও প্রয়োজন পরিকল্পিত কর্মসূচি।</p> <p style="text-align: justify;">জাতিসংঘের পক্ষ থেকে এবার জোরের সঙ্গে বলা হয়েছে যে নারী আন্দোলনের সংগঠন, যারা নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে কাজ করছে, তাদের জন্য আর্থিক বিনিয়োগ প্রয়োজন। সামাজিক প্রথা পরিবর্তন, ক্ষমতার কাঠামোয় সমতা আনা, নির্যাতনের শিকার নারী ও কন্যাদের জন্য প্রয়োজনীয় সেবা দানকারী কাজগুলো আরো শক্তিশালী করা এবং সব ক্ষেত্রে নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধি খুবই জরুরি।</p> <p style="text-align: justify;">নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে নিতে হবে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। একদিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সমন্বিত পরিকল্পিত বিনিয়োগ এবং নীতি প্রণয়নে বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে হবে। সেই সঙ্গে সহিংসতার বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে আওয়াজ তোলা এবং সেখানে সব শ্রেণি-পেশা এবং পুরুষ ও তরুণদের যুক্ত করা দরকার।<br /> বৈষম্যমূলক সামাজিক প্রথা, আইনের প্রয়োগ, ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে দুর্বলতা দূর করা এবং নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমেই সম্ভব নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ ও নির্মূলকরণ।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>লেখক </strong>: যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক<br /> বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ</p>