<p>মানিক বাবা-মায়ের অযত্নে বেড়ে ওঠা এক শিশু। বয়স ৮ বছর। মানিকের বাবার একটি চায়ের দোকান আছে হাড়িভাঙ্গা গ্রামের বটতলায়। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে মানিক মেজো। বাকি তিন ভাইবোনের মতো ওরও ইচ্ছা করে স্কুলে যেতে, পড়তে, মানুষের মতো মানুষ হতে, মায়ের হাতে মাখা ভাত খেতে, বাবার কাঁধে চড়ে বাজারে যেতে। কিন্তু মানিকের ইচ্ছেগুলো ইচ্ছেই থেকে যায়। কারণ, সে তৃতীয় লিঙ্গের অধিকারী, যাদের সাধারণত মানুষ হিজড়া বলে সম্বোধন করে। এ কারণে মানিক কখনো স্কুল গেটে প্রবেশ করতে পারেনি। স্কুলের শিক্ষকমণ্ডলীসহ গ্রামের মানুষেরা তাকে স্কুলে পড়ার সুযোগ দিতে রাজী হয়নি।</p> <p>তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়া-একটি পরিচয়, যারা নিজেকে পুরুষ বা নারী হিসেবে চিহ্নিত করেন না। যারা জন্মের সময় যৌনাঙ্গ বা অন্যান্য মানদন্ডের ভিত্তিতে আলাদা লিঙ্গ হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করতে চায় বা করতে বাধ্য হয়। তারা নিজেদের যৌন বা লিঙ্গ ভূমিকা অনুভব করে না।</p> <p>হিজড়া শব্দের ব্যবহারটি ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছে “নপুংসক” বা “হানাপ্রোডাইট”, যারা মূলত পুরুষ ও যৌনাঙ্গ অনিয়মে ভোগে। তারা পুরুষ শরীরবৃত্তির সাথে জন্মগ্রহণ করে। নৃতাত্ত্বিক সেরেনা নন্দার ভাষায়-হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা পুরুষ বা মহিলা, কেউ নয় হিসেবেই বিবেচিত হয়। তারা আর্থ-জৈবিক পুরুষ, যারা নারীদের মতো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিষয়েও উপস্থিত হন।</p> <p>“নপুংসক” “ট্রন্সসেঞ্জুয়ালস”, “প্রতিভাশালী পুরুষ” এবং অতি সম্প্রতি “ট্রান্সজেন্ডার”-এগুলো বিশ্বজুড়ে হিজড়াদের পরিচয়। যদিও বাংলাদেশ সরকার হিজড়াদের “তৃতীয় লিঙ্গ” হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু এই স্বীকৃতি তাদের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে পারেনি এখনও সেই অর্থে। তৃতীয় লিঙ্গ তথা হিজড়া সম্প্রদায় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সবক্ষেত্রেই অবহেলিত। বিভিন্ন প্রতিকূলতার পাশাপাশি নানা বৈচিত্রে ভরা তাদের জীবন সংগ্রাম। প্রতিনিয়তই তারা বৈষম্যের শিকার। প্রতিকূল পরিবেশ ও অনুকূল সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাবে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত এই জনগোষ্ঠী। সমাজের অসুস্থ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তারা বাসস্থানের মতো মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তারা বসবাস করে। সহপাঠী শিক্ষার্থীরা, এমনকি শিক্ষকরা তাদের সাথে ভালো ব্যবহার ও আচরণ করে না। তাই তারা স্কুলে পড়াশোনাও করতে পারে না। শিক্ষার অভাবে তারা ভালো চাকরি পায় না। এমনকি চাকরির জন্য তাদের সাক্ষাতকার নিতেও ডাকা হয় না। সবচেয়ে করুণ ঘটনা ঘটে তখন, যখন হিজড়ারা তাদের পরিবারের সাথেও বসবাস করতে পারে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাবা-মা, ভাইবোন এবং অন্যান্য আত্মীয়স্বজন তাদের পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করেন। ফলে তাদের লিঙ্গ সম্পর্কে তথ্য গোপন করতে হয়, অথবা পরিবার ছেড়ে চলে যেতে হয়। দুইটির যে কোনো একটি পন্থা বেছে নেয়া নিঃসন্দেহে খুব কঠিন তাদের কাছে। তারা যেখানেই থাকুক না কেন, বা যা-ই করুক না কেন, তারা মানসিক</p> <p>এবং যৌন হয়রানির হাত থেকে কখনোই মুক্ত হয় নয়। বেশিরভাগ সময় তারা তাদের মধ্যে থাকা মেয়েলি বৈশিষ্ট্যগুলো ত্যাগ করতে বাধ্য হয়, যার ওপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না।</p> <p>তৃতীয় লিঙ্গের এসব মানুষ অসুস্থ হলে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালেও সে অর্থে চিকিৎসা সুবিধা পান না। হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মীরা তাদের চিকিৎসা দিতে অস্বস্তিবোধ করেন। এমনকি তাদের সাথে খারাপ ব্যবহারও করেন কোনো কোনো ক্ষেত্রে। তারা চিকিৎসকের ব্যক্তিগত চেম্বারে ফি দিতে পারলেও তাদের সেবা দিতে চায় না চিকিৎসকরা। এছাড়া, ব্যাংক একাউন্ট খুলতে গ্যারান্টার না পাওয়ায় জীবন বীমা, পাসপোর্ট, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অসহযোগিতা এবং স্থায়ী ঠিকানা নিরূপণে তারা চরমভাবে বাধাগ্রস্থ হয়। ফলে পারিবারিক ও সামাজিক বৈষম্যের শিকার হয়ে অনেক হিজড়া বাঁচার তাগিদে রাস্তাঘাটে ও যানবাহনে যাত্রীদের কাছে হাত পাততে হয়। আবার বিয়ে বা শিশু জন্মের সময় গান গাওয়া এবং নাচের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে।</p> <p>অনেকে যৌন পেশা, চোরাচালান ও মাদকদ্রব্যের মতো নিষিদ্ধ পেশাতে জড়িয়ে পড়ে এবং হিংসাত্মক হয়ে উঠে। তাদের ব্যবহার করে মাদক ব্যবসায়ী, চোরাচালানকারীরা দেশ ও সমাজের ভয়ানক ক্ষতি করছে। কোনো হিজড়া যৌন ব্যবসায়ের সাথে জড়িত থাকলে এসটিআই বা এইচআইভি সংক্রমণের ক্ষেত্রে বিশাল কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। যৌন ব্যবসায়ও তারা নিরাপদ নয়। তারা তাদের ক্লায়েন্টদের দ্বারা ধর্ষিত হয় এবং অনিরাপদ যৌনতায় সম্পৃক্ত হতে বাধ্য হয়। ফলে তারা প্রায়শই এসটিআই দ্বারা সংক্রমিত হয়।</p> <p>বাংলাদেশের সবচেয়ে দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য মানবাধিকারের অপব্যবহার এবং যৌন স্বাস্থ্য অধিকার অস্বীকারের উদ্বেগ ও উদ্বেগের সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালে বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি (বিএসডব্লুএস) গঠিত হয়েছিল। এটি ২০০০ সাল থেকে হিজড়া জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য ও অধিকারের উন্নয়নের কাজ করে আসছে। বিএসডব্লুএস নীতি এবং অ্যাডভোকেসি উদ্যোগের অংশ হিসেবে গত কয়েক বছর ধরে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সরকারের সাথে সক্রিয়ভাবে কাজ করে আসছে। নভেম্বর ২০১৪ সালে, বিএসডব্লুএস, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং ইউএনএইডএস এর সহযোগিতায় বাংলাদেশ সরকার হিজড়া সম্প্রদায়ের তৃতীয় লিঙ্গ স্বীকৃতি দিবস উপলক্ষে সকল বিভাগীয় ও কেন্দ্রীয় স্তরে “হাইপ্রা প্রাইও ২০১৪” এর অধীনে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বিভাগীয় সুপারিশগুলোর ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় পরামর্শ অধিবেশন নির্দিষ্ট সুপারিশসহ একটি পথের নকশা তৈরি করা হয় এবং হিজড়া সম্প্রদায়ের মানবাধিকার সম্পর্কিত সমস্যাগুলো মোকাবিলা ও প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এটিকে “ঢাকা ঘোষণা” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তারা যেন সম্মানের সাথে বসবাস করতে পারে, সেটা নিশ্চিত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়।</p> <p>তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের পুনর্বাসিত করার এবং তাদের কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগের প্রস্তাব দেওয়ার অংশ হিসেবে তাদের উন্নতির জন্য সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে দেশের বিভিন্ন জেলায় পুনর্বাসন কার্যক্রম চালু করা হয়েছিল। কর্মসূচির জন্য প্রায় ৭ কোটি ২১ লাখ ৭ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। এই উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে ১৩৫ জন হিজড়া শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পেয়েছে এবং ৩৫০ জন হিজড়া দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ পেয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ১১ নভেম্বর ২০১৩ তে হিজড়াকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে</p> <p>স্বীকৃতি দিয়ে একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এই স্বীকৃতি তাদের অধিকারকে সুরক্ষিত করবে, তাদের পাসপোর্টসহ সব সরকারি নথিতে তাদের লিঙ্গকে “হিজড়া” হিসেবে চিহ্নিত করতে আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠিত করবে।</p> <p>সরকারের লক্ষ্য তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন এবং শিক্ষিত করে গড়ে তোলা। এ লক্ষ্যে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের ৭০০ টাকা, মাধ্যমিকে-৮০০ টাকা, উচ্চমাধ্যমিক-১০০০ টাকা এবং উচ্চতর পর্যায়ে ১২০০ টাকা হারে উপবৃত্তি প্রদান করছে সরকার। এছাড়া ৫০ বছর বা তদুর্ধ বয়সের অস্বচ্ছল ও অক্ষম হিজড়াদের বিশেষ ভাতা মাসিক ৬০০ টাকা প্রদান; বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও আয়বর্ধনমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করতে প্রশিক্ষণোত্তর আর্থিক সহায়তা বাবদ 10 হাজার টাকা প্রদান করা হচ্ছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে যেখানে শিক্ষা উপবৃত্তি ১৩৫ জনকে দেয়া হতো ২০১৯-২০ অর্থবছরে সে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২ শত ৪৭ জনে। লেখাপড়া শেষ করে হিজড়ারা এখন চাকুরিও করছেন।</p> <p>মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘মুজিববর্ষে দেশের একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না’। তাঁর অঙ্গিকার বাস্তবায়নে আশ্রায়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর জন্য সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার হাটিকুমরুল ইউনিয়নে ৬৬ শতাংশ জমিতে ‘প্রিয় নীড়’ নামে হিজড়া পল্লী গড়ে তোলা হয়েছে। ‘প্রিয় নীড়’ ছাড়াও দিনাজপুর সদর উপজেলায় হিজড়া পল্লীতে আরো ১২৫টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।</p> <p>এ বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসে বৈশাখী টেলিভিশনে সংবাদ পাঠ করেছেন ট্রান্সজেন্ডার নারী তাসনুভা আনাম শিশির। একই দিন আরেক ট্রান্সজেন্ডার নারী নুসরাত মৌকে দেখা গেছে নাটকের একটি চরিত্রে অভিনয় করতে। স্বাধীনতার 50 বছরে দেশে এই প্রথম টেলিভিশনে সংবাদ পাঠ করেছেন তৃতীয় লিঙ্গের কোনো নারী। দেশে সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও হিজড়ারা এগিয়ে আসছে।</p> <p>আমাদের দেশের সংবিধান নারী-পুরুষ যৌন পরিচয় নির্বিশেষে সকল মানুষের সুরক্ষা এবং অধিকার পূরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের তৃতীয় ভাগের ২৮ এবং ২৯ নং অনুচ্ছেদ সকল ব্যক্তির মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত করেছে। এতে উল্লেখ রয়েছে রাষ্ট্র কেবলমাত্র ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ বা জন্মের ভিত্তিতে কোনো নাগরিকের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করবে না।</p> <p>হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া সরকারের একটি উত্তম পদক্ষেপ। পাশাপাশি নাগরিক হিসেবে হিজড়াদের বৈষম্যের বিরুদ্ধে সুরক্ষার অধিকার, সাম্যের অধিকার, ভোটদানের অধিকার, নির্বাচনের পক্ষে দাঁড়ানোর অধিকার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং বাসস্থানের অধিকার নিশ্চিত করতে সরকার প্রতিশ্রুতিবন্ধ। তাদের অগ্রযাত্রা পুরোপুরি নিশ্চিত করতে সরকারের পাশাপাশি আমাদের সকলের আন্তরিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।</p>