কোনো দাবিতে যখন একটি স্বতস্ফূর্ত আন্দোলন সংগঠিত হয় এবং বিভিন্ন চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে সেই আন্দোলনটি যখন সবলে পেয়ে যায় একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ, তখন সন্দেহাতীতভাবে ধরে নিতে হবে সেই দাবিটিই একটি সংগঠন’ এবং নিঃসন্দেহে একটি গণসংগঠন।' সে অর্থে 'একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি' সুস্পষ্ট দাবি সম্বলিত একটি গণমানুষের সংগঠন। দীর্ঘ ২৯ বছর পূর্বে এই দাবিনামাটির রচয়িতা ছিলেন শহীদজননী জাহানারা ইমামসহ দেশের ১০১ জন বরেণ্য নাগরিক, যার বর্তমান সাংগঠনিক রূপই হচ্ছে 'একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি'। মৃত্যুশয্যা থেকে লেখা জননী জাহানারা ইমামের শেষ চিঠিটিকে ধরে নেয়া যেতে পারে সংগঠনটির দিকনির্দেশনামূলক দলিল, যার আলোকে এই দীর্ঘ ২৯টি বছরের পথ চলা এবং যা ভবিষ্যতেও থাকবে চলমান। শহীদজননী সেই শেষ চিঠিতে লিখেছিলেন:
"সহযোদ্ধা দেশবাসীগণ,
আপনারা গত তিন বছর ধরে একাত্তরের ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমসহ স্বাধীনতাবিরোধী সকল অপশক্তির বিরূদ্ধে লড়াই করে আসছেন। এই লড়াইয়ে আপনারা দেশবাসী অভূতপূর্ব ঐক্যবদ্ধতা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। আন্দোলনের শুরুতে আমি আপনাদের সঙ্গে ছিলাম। আমাদের অঙ্গীকার ছিল লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত কেউ রাজপথ ছেড়ে যাব না। মরণব্যাধি ক্যান্সার আমাকে শেষ কামড় দিয়েছে। আমি আমার অঙ্গীকার রেখেছি। রাজপথ ছেড়ে যাইনি। মৃত্যুর পথে বাধা দেবার ক্ষমতা কারো নেই। তাই আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি এবং অঙ্গীকার পালনের কথা আরেকবার আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই। আপনারা আপনাদের অঙ্গীকার ও ওয়াদা পূরণ করবেন। আন্দোলনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে থাকবেন। আমি না থাকলেও আপনারা আমার সন্তান-সন্ততিরা আপনাদের উত্তরসূরিরা সোনার বাংলায় থাকবেন।
এই আন্দোলনকে এখনো দুস্তর পথ পাড়ি দিতে হবে। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্র ও যুব শক্তি, নারী সমাজসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষ এই লড়াইয়ে আছে। তবু আমি জানি জনগণের মত বিশ্বস্ত আর কেউ নয়। জনগণই সকল শক্তির উৎস। তাই একাত্তরের ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধী বিরোধী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ’৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল সমন্বয় আন্দোলনের দায়িত্বভার আমি আপনাদের বাংলাদেশের জনগণের হাতে অর্পণ করলাম। জয় আমাদের হবেই"- জাহানারা ইমাম
অসাধারণ ঐতিহাসিক একটি চিঠি, যার প্রতিটি শব্দের পেছনেই লুকিয়ে রয়েছে দায়িত্ব, কর্তব্য, অঙ্গীকার, সাবধানবাণী, শত্রু-মিত্রের সংজ্ঞা এবং সর্বপরি লক্ষ্যে পৌছানোর সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা। প্রতিটি আন্দোলনই শুরু হয় কোন না কোন দাবিকে কেন্দ্র করে এবং সময়ের আবর্তে ও প্রেক্ষাপটে তার কৌশলগত পরিবর্তন বা পরিবর্ধনও হয়, যার ব্যত্যয় ঘটেনি নির্মূল কমিটির আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়ও।
একাত্তরে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ২৫ মার্চ রাতে, যখন পাক-হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাংলার নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষের উপর। একটি অঘোষিত যুদ্ধ শুরু হলেও, তা মোকাবেলা করার একটি দিক-নির্দেশনাও দেয়া ছিল আগে থেকেই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণকে সে অর্থে সন্দেহাতীতভাবে ধরে নেয়া যেতে পারে স্বাধীনতা যুদ্ধের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা। এ ভাষণ আজও বাঙ্গালী জাতির হৃদয়ে হয়ে আছে সকল প্রেরণার উৎসস্থল হিসেবে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের শেষ চিঠিটিও বাঙ্গালী জাতির প্রতি ঠিক তেমনি একটি দিকনির্দেশনামূলক বার্তা, যার আলোকে আজ দীর্ঘ ২৯টি বছর ধরে চলে এসেছে ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনের সুসংগঠিত ধারাবাহিকতা।
নির্মূল কমিটির অন্যতম নেতা অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন লিখেছেন একটি নাগরিক আন্দোলন কীভাবে কালের পরিক্রমায় একটি বিশাল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘১৯৯৫ থেকে নির্মূল কমিটির আন্দোলনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার কার্যক্রম শুরু হয়। ঘাতকদের বিচার অনুষ্ঠান একটি পর্যায় বটে, কিন্তু এর সঙ্গে জড়িত মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা অক্ষুণ্ন রাখা, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে লড়াই। এ কারণে নির্মূল কমিটির দু’টি সহযোগী প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলা হয়। এর একটি হলো ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ কেন্দ্র ট্রাস্ট’ অন্যটি হলো ‘সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদবিরোধী দক্ষিণ এশীয় গণসম্মিলন’ (২০০১) ট্রাস্টের সঙ্গে যুক্ত আছেন শিল্পী আমিনুল ইসলাম (পরলোকগত), ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, শিল্পী হাশেম খান প্রমুখ। এর প্রধান সমন্বয়কারী কাজী মুকুল। প্রধানত তাঁর চেষ্টায় সারাদেশে ৭০টি পাঠাগার স্থাপন করা হয়েছে। মৌলবাদ/জঙ্গীবাদ বিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠাই পাঠাগারের মূল উদ্দেশ্য। জোট সরকার যখন ক্ষমতায় ছিল তখন ৪০টি পাঠাগারের ওপর হামলা চালানো হয়েছিল। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ মেলাও প্রথম শুরু করে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিই। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর উদ্বোধন করেন।
মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী দক্ষিণ এশিয়া গণসম্মেলন বা ‘সাউথ এশিয়ান পিপলস ইউনিয়ন এগেইনস্ট ফান্ডামেন্টালিজম অ্যান্ড কমিউনিজম’ ২০০১ সালে ঢাকায় দু’দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলন আহ্বান করে। বিষয় ছিল, ফান্ডামেন্টালিজম অ্যান্ড কমিউনিজম : রোল অব সিভিল সোসাইটি। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা থেকে পি এ সাংমা, মৃণাল সেন, হামজা আলাভী, দামান দুঙ্গানা, এম. জে আকবর, আইকে গুজরাল, সুনীল উইজেসি সার্ধানায় প্রমুখ যোগ দেন। ২০১০ সালে আরও বড় পরিসরে এই সংগঠনের উদ্যোগে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বিষয় ছিল ‘পিস, জাস্টিস অ্যান্ড সেকিউলার হিউমিনিজম’। এবার জার্মানি, সুইডেন, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, ইরান, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস ও রাশিয়া থেকে প্রতিনিধিরা এসেছিলেন। শুধু তাই নয়, তারা এক বাক্যে ‘ঢাকা ঘোষণায়’ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সমর্থন করে গেছেন।
না, এখানেই শেষ নয়। সারা বছর নির্মূল কমিটি ঢাকা ছাড়াও সারাদেশে সভা-সমিতি, সেমিনার করেছে যার সংখ্যা হাজারের ওপর। যুদ্ধাপরাধ, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গীবাদ, সংবিধান বিষয়ে দুইশত’র অধিক পুস্তিকা/ গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। এ রেকর্ড আর কোনো বেসরকারি সংস্থার আছে কী না সন্দেহ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য জোট সরকার সংখ্যালঘুদের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছিল। তার ওপর তিন খণ্ডে প্রায় ৩০০০ পৃষ্ঠার একটি রিপোর্ট প্রকাশ। নাম ‘শ্বেতপত্র বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ১৫০০ দিন’। যুদ্ধাপরাধী আইনের ওপরও কয়েকটি পুস্তিকা এবং হেফাজতের তাণ্ডবের ওপর দু’খণ্ডে ১২৬০ পৃষ্ঠার হেফাজত-জামায়াতের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ৪০০ দিন শ্বেতপত্র এবং ২০১৬ সালে ‘বাংলাদেশে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ৮০০ দিন’ ২৬০০ পৃষ্ঠার ৩ খণ্ড প্রকাশিত হয়।
নির্মূল কমিটির উদ্যোগে শাহরিয়ার কবির ১৫টি ডকুমেন্টারি তৈরি করেছেন যা দেশে-বিদেশে আদৃত হয়েছে। এগুলো হলো : সংখ্যালঘু নির্যাতনের ওপর ‘আমাদের বাঁচতে দাও’, মুক্তিযুদ্ধের গান’যুদ্ধাপরাধ ৭১’, ‘দুঃসময়ের বন্ধু’, জিহাদের প্রতিকৃতি’, সীমানাহীন জিহাদ’, চূড়ান্ত জিহাদ’, বাংলাদেশ কোন পথে’ ও জার্নি টু জাস্টিস’ প্রভৃতি। বীরাঙ্গনাদের নির্মূল কমিটিই প্রথম সম্মাননা জানিয়েছে। এরপর বীরাঙ্গনাদের স্বীকৃতি দিতে অন্যান্য সংস্থা এগিয়ে এসেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় বিভিন্ন জায়গায় নির্মূল কমিটি ত্রাণ পরিচালনা করেছে। এখনও শুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য নিয়ে নির্মূল কমিটি দেশের দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধা/ বীরাঙ্গনাদের নিয়মিত সাহায্য করছে। যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে একটি ডাটা ব্যাংক গড়ে তুলেছে।
১৯৯৫ সাল থেকে নির্মূল কমিটি জাহানারা ইমাম স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করেছে। এ বক্তৃতা দিয়েছেন কবীর চৌধুরী, কামাল লোহানী, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আনিসুজ্জামান, কে এম সোবহান প্রমুখ। এ পর্যন্ত ২৫টি বক্তৃতার আয়োজন করা হয়েছে। সম্প্রতি অধ্যাপক কবীর চৌধুরী পরলোকগমন করলে তাঁর স্মরণে ফেব্রুয়ারি মাসে আয়োজন করা কবীর চৌধুরী স্মারক বক্তৃতা। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িকতার ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য ১৯৯৫ সাল থেকে নির্মূল কমিটি ১টি প্রতিষ্ঠান ও একজন ব্যক্তিকে ‘জাহানারা ইমাম স্মৃতি পদক’ প্রদান করছে। এ পর্যন্ত ৫৪ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে পদক দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছে। এর মধ্যে আছেন প্রয়াত সুফিয়া কামাল, শওকত ওসমান, শামসুর রাহমান, শওকত আলী খান প্রমুখ। প্রতিষ্ঠান হিসেবে পদক পায় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ছায়ানট, উদীচী, টুয়েন্টি টুয়েন্টি টেলিভিশন (লন্ডন), মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, সময় প্রকাশন প্রভৃতি। যুদ্ধাপরাধ, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ নিয়ে শতাধিক পোস্টার এবং লিফলেট প্রকাশ করেছে কমিটি।
নির্মূল কমিটির শাখার সংখ্যা এখন প্রায় ২০০। বিদেশে ১২টি। সে হিসেবে বলা যায়, সিভিল সমাজের সবচেয়ে বড় সংগঠন নির্মূল কমিটি। জাতীয় হিসাবে ধরলে চারটি বড় রাজনৈতিক দলের পরই নির্মূল কমিটির অবস্থান।
গত দুই দশক থেকে, আগেই বলেছি, বাংলাদেশের বিশিষ্টজনরা এর সঙ্গে জড়িত। এই সংস্থাকে আর্থিক সাহায্য দিতে কোনো প্রতিষ্ঠান বা ধনীরা সবসময়ে অপারগতা প্রকাশ করেছে। কমিটির শুভানুধ্যায়ী ও সদস্যদের চাঁদায় সংগঠন চলছে যা খুবই কষ্টকর। একমাত্র প্রয়াত শিল্পী নিতুন কুণ্ডু জাহানারা ইমাম স্মৃতিপদকের ক্রেস্ট নিয়মিত তৈরি করে দিয়েছেন। স্থপতি, কবি রবিউল হোসাইন এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে, এ দেশে পাকিস্তানের এজেন্ট প্রাক্তন দু’জন রাষ্ট্রপতি এলিট সমাজকে ভালোভাবে বিভক্ত করতে পেরেছেন। তারা বোঝাতে পেরেছেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার চাওয়া, অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে আন্দোলন কোনো সুস্থ চাওয়ার বিষয় নয়, এটি রাজনীতি। ডিজিএফআইয়ের সহায়তায় প্রকাশিত বলে অনুমিত (এ বিষয়ে কখনও কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করা যাবে না। উইকিলিকস যদি কখনও পারে) ‘র ইন বাংলাদেশ’ নামে একটি বইয়ে নির্মূল কমিটিকে ‘র’-এর এজেন্ট হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের ঘাঁটি যে কত শক্ত এটি তার প্রমাণ। ১৯৯৬ থেকে জাতীয় নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের প্রার্থীদের জন্য নির্মূল কমিটি বিভিন্ন জায়গায় (বিশেষ করে যেখানে যুদ্ধাপরাধীরা দাঁড়িয়েছিল) সভা করে জনমত সংগঠন করেছে।
এই সংক্ষিপ্ত ফিরিস্তি দেয়ার একটা কারণ আছে। নির্মূল কমিটির অনেক কর্মকাণ্ডের কথা আমারও মনে নেই। আজ মুক্তিযুদ্ধের যে নতুন প্রজন্ম তৈরি হয়েছে তাতে অনেক ব্যক্তি, সংস্থার অবদান স্বীকার করেও বলতে হয়, এতে নির্মূল কমিটির অবদান বেশি। কারণ এক্ষেত্রে এত বেশি কাজ কেউ করেনি। অনেকের কাজ মার্চ বা ডিসেম্বরে সীমাবদ্ধ। নির্মূল কমিটির কাজ চলে সারা বছর। আমরা অনেকে শুরু থেকে ছিলাম নির্মূল কমিটির সঙ্গে, এখনও আছি অনেকে, তবে নির্মূল কমিটির এই যে আন্দোলন যা এখনো সজীব, তার কারণ এর প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। এ কারণেই এটি আলোচনার বিষয় যে, যা পারিনি তা করা যেতে পারে যদি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া যায়। আর নির্মূল কমিটির এই কৃতিত্বের জন্য আমরা সবাই দাবিদার হতে পারি, কিন্তু আমি মনে করি শাহরিয়ার কবিরের উদ্যম ও কাজী মুকুলের সাংগঠনিক শক্তি না থাকলে আজ নির্মূল কমিটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতো না। জোট আমলে মন্ত্রী, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা ব্যক্তিগত আক্রোশে শাহরিয়ারকে সরকারি মালিকানাধীন সাপ্তাহিক বিচিত্রা থেকে চাকরিচ্যুত করেন। সে থেকে আর তিনি কোনো চাকরি পাননি, করেনওনি। সারাটা সময় খালি যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে কাজ করে গেছেন। শাহরিয়ারের সঙ্গে আমাদের মতানৈক্য হয়। অনেকে আমরা তাকে অপছন্দ করি পছন্দও করি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিরিয়ে আনা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি বাস্তবায়নে তাঁর অবদান অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আমি তো মনে করি, ‘স্বাধীনতা পদক’ পাওয়ার অন্যতম দাবিদার তিনি।
আজ ২৯ বছর পর মনে হচ্ছে, খুব কম দেশে এ ধরনের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন শিল্পী সাহিত্যিকরা। কবি শামসুর রাহমান দীর্ঘদিন আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। প্রবীণ শওকত ওসমানকে যখন ডেকেছি তখনই সাড়া দিয়েছেন। কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খান বা রফিকুন নবীর মতো বরেণ্য শিল্পীদের কাছে যখন পোস্টার চেয়েছি নির্দ্বিধায় করে দিয়েছেন। বিচারপতি কে.এম. সোবহানতো আমাদের বয়সীই হয়ে গেছিলেন। মনে পড়ছে ব্যারিস্টার শওকত আলীর কথাও সব সময় যিনি ছিলেন হাস্যোজ্জ্বল। বক্তা হিসেবে কামাল লোহানী, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর কখনই বিমুখ করেন নি। কবীর চৌধুরী ও নির্মূল কমিটি তো একীভূত হয়ে গিয়েছিলেন। কলিম শরাফীর কথাও বা কীভাবে ভুলি? শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী বা সালমা হক, মমতাজ লতিফকে আজ পর্যন্ত দেখিনি একটি সভা বা মিছিলে অনুপস্থিত থাকতে। এভাবে সবাই মিলে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে আজ প্রায় এগার বছর হলো। যুদ্ধাপরাধের বিচার শুধু নির্মূল কমিটি চেয়েছে তা’ নয়। বাংলাদেশের অনেক সামাজিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবি করেছে। কিন্তু নির্মূল কমিটির বৈশিষ্ট্য হলো এ আন্দোলনের পথ থেকে কখনও বিচ্যুত না হওয়া এবং বিরতি না দেওয়া এবং তা জনদাবিতে পরিণত করতে পারা। যতদিন পর্যন্ত বিচারের ট্রাইবুনাল গঠিত না হয়েছে ততদিন পর্যন্ত নির্মূল কমিটি জনমত জাগ্রত রেখেছে। এবং ট্রাইবুনাল ও আইন সংক্রান্ত নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি ও শৈথিল্যের গঠনমূলক সমালোচনা করেছে। বিদেশে যখন জামায়াতের লবিংয়ের কারণে, সরকার, ব্যক্তি, সংগঠন ট্রাইবুনালের সমালোচনা করেছে তখন আমরা বারবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এর একটি বিহিত করার জন্য অনুরোধ করেছি। তারা ব্যর্থ হলে, নির্মূল কমিটি চাঁদা তুলে, অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ব্যয়ে শাহরিয়ার কবির ও তুরিন আফরোজ নিউইয়র্ক, লন্ডন, ব্রাসেলস, প্যারিস, জেনেভা হেগ, স্টকহোম, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন ডিসি, বস্টন প্রভৃতি শহরে গিয়েছেন, বিভিন্ন দেশের সংসদীয় সভায় ট্রাইবুনালের পক্ষে বক্তব্য তুলে ধরেছেন। কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশ নির্মূল কমিটির নেতৃবৃন্দই রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন। এখনও আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচার আইন, ট্রাইবুনালের অপূর্ণতা, গণহত্যা আর্কাইভস ও জাদুঘর প্রতিষ্ঠার কথা নির্মূল কমিটিই নিরন্তর বলে যাচ্ছে, দাবি তুলছে এবং তুলে যাবে যতদিন না জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ সহ সকল দাবি পূরণ না হয়।
জামায়াত নিষিদ্ধকরণের দাবি গত প্রায় তিন দশক ধরে নির্মূল কমিটি করে আসছে। প্রথম দিকে এ দাবি যখন করা হয় তখন সবাই এটি অবাস্তব দাবি বলে মনে করেছে। গত এক বছর ধরে জামায়াতের সহিংসতা এই দাবিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। আজ এটি বাস্তব সত্য যে জামায়াত ধর্মকে পুঁজি করে একটি দানবীয় শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ট্রাইবুনালের প্রতিটি রায়ে জামায়াতকে অপরাধী সংগঠন বলা হয়েছে। একটি রায়ে এমনও মন্তব্য করা হয়েছে যে জামায়াতের আদর্শে বিশ্বাসী কেউ সরকারে যাতে প্রবেশপত্র না পায় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে। জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকলে সরকার অবশ্যই জামায়াত নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হবে।
জামায়াত নিষিদ্ধ করার দাবির সঙ্গে আমরা আরেকটি দাবি করছি তা হলো, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধান থেকে অপসারণ করা।
অনেকে বলতে পারেন, যুদ্ধাপরাধ বিচার শেষ হচ্ছে, সুতরাং নির্মূল কমিটির আন্দোলনের আর কী আছে? আমরা মনে করি না যুদ্ধাপরাধের রায় কার্যকর হলেই আমাদের কাজ শেষ হয়ে যাবে। কারণ, যুদ্ধাপরাধীদের দলতো থেকে যাবে। তাদের রাজনীতি তো থেকে যাবে। যুদ্ধাপরাধের সমর্থকরাও তো এক ধরনের যুদ্ধাপরাধী। তাদের রাজনীতি আর জামায়াতের রাজনীতির মধ্যে তো পার্থক্য নেই। আর এই অপরাজনীতি কী তা তো এখনও আমরা প্রত্যক্ষ করছি। পেট্রোল বোমা মেরে, পুড়িয়ে, কুপিয়ে প্রায় ২০০ মানুষ হত্যা করা হয়েছে ২০১৩ সালে। পুলিশ, বিজিবির সদস্যদের হত্যা করা হয়েছে। তিন হাজার বৃক্ষ কর্তন করা হয়েছে। দখল হয়েছে অগণিত। ৫৩১টি স্কুল, মাদ্রাসা পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ট্রাক ভর্তি গরু পুড়িয়ে মারা হয়েছে। নির্বাচনের আগে পরে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর পোড়ানো হচ্ছে, তাদের ওপর নিরন্তর আক্রমণ চলছে। জামায়াত-বিএনপির অপরাজনীতির কারণে ধর্মীয় মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা যে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে তার বিরুদ্ধে আমাদের নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যেতে হবে যতদিন না এই অপরাজনীতির বিনাশ হবে।
নির্মূল কমিটির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার কারণ হলো, আমরা মনে করি যুদ্ধাপরাধের বিচারের মাধ্যমেই এ দেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদী জঙ্গীবাদ বিলুপ্ত হবে না। যুদ্ধাপরাধ বিচার মুক্তিযুদ্ধের একটা পর্যায় মাত্র। মুক্তিযুদ্ধের বাকি লক্ষ্যগুলো অর্জন দীর্ঘ সময়ের আন্দোলনের অন্তর্গত। আমরা যদি না থাকি তাহলে আমাদের উত্তরসূরিরা যাতে এ আন্দোলনটি সজীব রাখতে পারে সে জন্যই এত পরিশ্রম। আমরা বলতে পারি গর্ব করে, অনেক কিছু না পারলেও কিছু কাজ তো করতে পেরেছি।’
একাত্তরে বাংলাদেশ যে মূলমন্ত্রের উপর দাঁড়িয়ে স্বাধীন হয়েছিল, বাহাত্তরের সেই ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক সেক্যুলার ডেমোক্র্যাটিক সংবিধানে ফিরে না গেলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করা সুদূর পরাহত হবে। জন্মলগ্ন থেকে এই দাবিটিই শহীদজননী জাহানারা ইমামের একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির মূল দাবি হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল এবং এখনো তা চলমান। এ দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত নির্মূল কমিটির আন্দোলন অব্যাহত থাকবে!
সাব্বির খান: কলামিস্ট, লেখক ও সাংবাদিক। কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।
মন্তব্য