<p style="text-align:justify">স্বাধীনতার আগে জনপ্রিয় ধারার লেখা বা জনপ্রিয় সাহিত্যের ধারণাটা পূর্ব পাকিস্তানে ছিল না। সে সময় যাঁরা লিখতেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, শহীদ কাদরী ও আল মাহমুদ। কথাসাহিত্যিক ছিলেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত ওসমান, আবু রুশদ, রশীদ করিম, শহীদুল্লা কায়সার, জহির রায়হান, শওকত আলী, রাবেয়া খাতুন, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক, মাহমুদুল হক, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত। তাঁদের লেখা বই নিয়মিত বের হতো না, মাঝেমধ্যে হতো। সেই বইয়ের বিক্রি খুব কম ছিল। হয়তো বছরে দুই-তিনশো বই বিক্রি হয়েছে। পাঁচশো বই চলেছে এমন রেকর্ডও নেই। তবে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জসীমউদ্দীন—এঁদের বইগুলো চলত। সব থেকে বেশি চলত মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ-সিন্ধু’। ‘বিষাদ-সিন্ধু’ বাঙালি মুসলমানের ঘরে ঘরে ছিল। এ ছাড়া অন্য লেখক যাঁরা চল্লিশ, পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে লিখতে শুরু করেছেন তাঁদের অনেকেই বড় লেখক, অনেক ভালো লেখক কিন্তু বইয়ের বিক্রিতে তাঁরা পিছিয়ে ছিলেন। দেশ স্বাধীনের আগে-পরে অনেক বছর পর্যন্ত আমাদের বইয়ের বাজার ছিল পশ্চিমবঙ্গের কিছু জনপ্রিয় লেখকের দখলে। এঁদের মধ্যে ছিলেন যাযাবর, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন গুপ্ত, একটু পরে নিমাই ভট্টাচার্য, তারও পরে শংকর ছিলেন। এঁদের বই বাংলাদেশের বইয়ের দোকানগুলোতে, ফুটপাতে হাত বাড়ালেই পাওয়া যেত। বনেদি বইয়ের দোকানগুলোয় আবার কিছু ক্ল্যাসিকস লেখকের বই পাওয়া যেত। এঁদের মধ্যে ছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। এই তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে তারাশঙ্করের বই একটু বেশি বিক্রি হতো। আর শরত্চন্দ্রের বই তো চিরকালই বিক্রি হয়। ‘দেবদাস’, ‘বড়দিদি’, ‘রামের সুমতি’ বেশি বিক্রি হতো। কিন্তু তাঁর লেখা ‘শ্রীকান্ত’, ‘গৃহদাহ’ বা ‘চরিত্রহীন’ বিক্রি হতো কম। অর্থ হচ্ছে, শরত্চন্দ্রের ক্ষেত্রেও তাঁর জনপ্রিয় ধারার বইগুলোর বিক্রিই হয়েছে বেশি।</p> <p style="text-align:justify">স্বাধীনতা যেমন আমাদের একটা দেশ দিল, তেমনি শিল্প-সাহিত্যসহ সব ক্ষেত্রের দরজাগুলো খুলে দিল। সেই সময় অনেকের সঙ্গে ইমদাদুল হক মিলন নামের একজন তরুণও লিখতে শুরু করলেন। দুই ধরনের লেখা তিনি লিখতে লাগলেন। সেই সময়কার, তাঁর প্রজন্মের তরুণ-তরুণীর প্রেম-ভালোবাসা, স্বপ্ন আর দিনযাপনের ছবি সরল আকর্ষণীয় ভাষায় লিখতে লাগলেন। এই করে করে তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন তরুণদের কাছে, গৃহবধূদের কাছে। অন্যদিকে গ্রাম জীবন নির্ভর গল্প লিখে বোদ্ধা পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে লাগলেন। এই লেখক লেখা শুরু করেছিলেন ’৭৩ সালে। পত্রিকায় লেখেন, পত্রিকায় লিখতে লিখতে তাঁর একটা নাম হয়েছে। তাঁর প্রথম বই ‘ভালোবাসার গল্প’ প্রকাশিত হলো ১৯৭৭ সালে। এক বছরে ২২৫০ কপি বিক্রি হয়ে গেল। ফলে তাঁর প্রতি প্রকাশকদের বিশেষ নজর পড়ল। লেখকের পরের বইটা আবার বিক্রি হলো না, গল্পের বই ‘নিরন্নের কাল’। বইয়ের গল্পগুলো গ্রামীণ হতদরিদ্র মানুষের জীবনযাপন নিয়ে। আমরা যেটাকে বলি ‘সিরিয়াস সাহিত্য’, ‘নিরন্নের কাল’ তাই। এদিকে মিলন লিখতে শুরু করেছেন তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘যাবজ্জীবন’। ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছে বাংলা একাডেমির ‘উত্তরাধিকার’ পত্রিকায়। বোদ্ধা পাঠক মহলে সুনাম কুড়াচ্ছে সেই উপন্যাস। কয়েক বছর পর এই লেখকের ‘ও রাধা ও কৃষ্ণ’ ব্যাপক বিক্রি হলো। পাঠক গ্রহণ করছেন মিলনের সব ধরনের লেখা। ‘দুঃখকষ্ট’, ‘কালোঘোড়া’ আর তুমুল আলোড়ন তোলা উপন্যাস ‘পরাধীনতা’। ইমদাদুল হক মিলন হয়ে উঠলেন বাংলাদেশে প্রথম জনপ্রিয় লেখক। বাংলাদেশে জনপ্রিয় লেখকের কনসেপশনই তৈরি করলেন এই লেখক।</p> <p style="text-align:justify">’৯৩ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেলেন। সে বছর বইমেলায় ২৮ দিনে তাঁর ‘ভালোবাসার সুখদুঃখ’ বইটা ৮৭ হাজার কপি বিক্রি হলো। বই বিক্রির ক্ষেত্রে এটা বাংলাদেশে রেকর্ড। তার আগে হুমায়ূন আহমেদ নিয়ে কথা আছে। তাঁর প্রথম বই বের হলো ’৭০ সালে ‘নন্দিত নরকে’। ’৭২ সালে এসে ‘নন্দিত নরকে’ নতুন করে বের হলো, এরপর বের হলো ‘শঙ্খনীল কারাগার’। এই দুটো বই সাহিত্যের মনোযোগী পাঠক, সাহিত্যবিষয়ক গুণীজন বা আমরা যাঁদের সাহিত্যের বিচারক বলি তাঁদের মনোযোগ আকর্ষণ করল। যেমন আহমদ শরীফ, শওকত আলী—এঁরা ‘নন্দিত নরকে’ নিয়ে লিখলেন। তারপর হুমায়ূন আহমেদ লিখলেন সায়েন্স ফিকশন ‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’, বাচ্চাদের বই ‘নীল হাতি’। বইগুলো টুকটাক বিক্রি হয়। কিন্তু জনপ্রিয়তা বলতে যা বোঝায় সেই জায়গাটায় তখনো তিনি পৌঁছাননি। তিনি চলে গেলেন আমেরিকায়, পিএইচডি করতে। আমেরিকায় থাকার সময়ই ১৯৮২ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেলেন। আমেরিকায় বসে তিনি শুনলেন, বাংলাদেশে একজন লেখক জনপ্রিয় হয়েছেন। তাঁর নাম ইমদাদুল হক মিলন। ১৯৮৪ সালে দেশে ফিরে বইমেলায় ইমদাদুল হক মিলনের ‘ও রাধা ও কৃষ্ণ’ বইটা নিয়ে লেখকের অটোগ্রাফ নিতে গিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। এইভাবে দুই লেখকের ঘনিষ্ঠতা হলো। ইমদাদুল হক মিলনের ‘পরাধীনতা’ বইটা নিয়ে দৈনিক বাংলায় একটা লেখা লিখেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ, সেখানে তিনি এই তথ্যগুলো দিয়েছেন। ১৯৮৫ সালে হুমায়ূন আহমেদ টেলিভিশনে ধারাবাহিক নাটক লিখলেন ‘এইসব দিনরাত্রি’। এই নাটক জনপ্রিয়তার তুঙ্গে চলে গেল। যত দিন যেতে লাগল তিনি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তার যাবতীয় রেকর্ড ভাঙতে লাগলেন। জনপ্রিয়তার নতুন জগৎ তৈরি করলেন। যেমন নাটকে তাঁর জনপ্রিয়তা, অন্যদিকে নাটকের কারণে তাঁর বই বিক্রি হু হু করে বাড়তে লাগল। তিনি বহু ধরনের লেখা শুরু করলেন। যা লেখেন তা-ই জনপ্রিয় হয়।</p> <p style="text-align:justify">নব্বইয়ের গোড়ার দিকে ইমদাদুল হক মিলন ও হুমায়ূন আহমেদ দুজন প্যারালালি জনপ্রিয় লেখক। যেমন তাঁদের নাটক জনপ্রিয়, তেমনি তাঁদের বই। মিলন বই লিখে বই জনপ্রিয় করলেন, হুমায়ূন নাটক লিখে তাঁর বইও জনপ্রিয় করলেন। ধীরে ধীরে হুমায়ূন আহমেদ হয়ে উঠলেন তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয় লেখক, বাংলা ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। নাটক সিনেমা গান বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণ, যে শাখায় তিনি হাত দিলেন সেই শাখাই ব্যাপক জনপ্রিয় হলেন। মোট কথা, এই দুজন লেখক বাংলাদেশের সাহিত্যকে একটা বিশাল জায়গায় নিয়ে গেলেন। ইমদাদুল হক মিলন জনপ্রিয় ধারাটা তৈরি করলেন। আমেরিকা থেকে ফিরে এসে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর ম্যাজিক দিয়ে সেই ধারাটা তুঙ্গে নিয়ে গেলেন। বাংলাদেশের সাহিত্যে এ দুই লেখকের অবদান স্বাধীনতার ৫০ বছরের এক বড় অর্জন।</p>