<p><em>মাটি থেকেই বেশির ভাগ খাবার পাই আমরা। কিন্তু মাটিই হবিগঞ্জের একটি জনপ্রিয় খাবার। লোকে একে ডাকে ছিকড় বলে। শাহ ফখরুজ্জামান এতে নজর দিয়েছেন</em></p> <p>হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার দিনারপুর পরগনার কায়স্থ গ্রামের ঝরনারানি কর একজন ছিকড়শিল্পী। বাপ-দাদার আমল থেকেই ছিকড় বানান। বিশ্বাস করেন এর সুদিন আবার ফিরে আসবে। উল্লেখ্য, ছিকড় একটি ফারসি শব্দ। ছিয়া মানে কালো আর কড় মানে মাটি। ছিয়াকড় শব্দটিই পরে ছিকড় হয়ে গেছে।</p> <p><strong>কান্দিগাঁও পাহাড়ের মাটি</strong><br /> পাহাড়, হাওর আর বিজনা নদী মিলিয়ে কায়স্থ গ্রাম। ঝরনারানির কাছ থেকেই জানা গেল, একসময় বিজনায় বড় বড় নৌকা চলত। পাইকাররা নৌকা বোঝাই করে ছিকড় নিয়ে যেতেন দূর-দূরান্তে। তখন সুদিন ছিল ছিকড়ের। দিন-রাত কাজ করেও ঝরনা রানির পূর্বপুরুষরা পাইকারদের চাহিদা মেটাতে পারতেন না। সেটা শত বছর আগের কথা। ছিকড়ের মাটিকে লোকে ডাকে ছিকনা মাটি। এক ধরনের এঁটেল মাটি। দিনারপুরের কান্দিগাঁও গ্রামের পাহাড়ে মেলে এ মাটি।</p> <p><strong>যেভাবে হয় ছিকড়</strong><br /> ঝরনারানি বললেন, ছিকড় তৈরিতে আসলে লাগে দক্ষতা। মাটি শুকানো ও পোড়ানোতেই আসল কারসাজি। ঠিকভাবে না হলে স্বাদ আর ঘ্রাণ কোনোটাই পাওয়া যায় না। ছিকনা মাটি তুলে আনাটাও গুরুত্বপূর্ণ কাজ। টিলায় গর্ত খুঁড়ে লম্বা বাঁশের সাহায্যে গভীর থেকে তুলে আনা হয় এ মাটি। রাতের বেলা মাটিগুলো একটি গামলায় নিয়ে পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। সারা রাত ভিজে মাটি নরম হলে ছাঁচে ফেলে প্রথমে তৈরি করা হয় মণ্ড। তারপর কাঠের হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে চ্যাপ্টা করা হয়। এরপর চাকু দিয়ে বিস্কুটের মতো ছোট ছোট করে টুকরা করা হয়। তবে গ্রাহক চাহিদা অনুযায়ী ললিপপ বা লজেন্স আকৃতির ছিকড়ও হয়ে থাকে। কাটার পর কাঁচা ছিকড়গুলো রোদে দেওয়া হয়। দু-এক দিন শুকানোর পর এক ধরনের বিশেষ চুলায় এগুলো পোড়ানো হয়। তারপর একটি মাটির হাঁড়ির নিচের অংশ ভেঙে সেখানে লোহার শিক দিয়ে তৈরি চালুনি বসানো হয়। শিকড়গুলো ওই চালুনির ওপর বসানো হয়। তারপর হাঁড়িটি রাখা হয় একটি মাটির গর্তে। ধানের তুষ দিয়ে আগুন জ্বালানো হয় গর্তে। সতর্কতার সঙ্গে ছিকড়ের গায়ে শুধু ধোঁয়া লাগানো হয়। দুই ঘণ্টা পর ছিকড় কালচে রং ধারণ করে। সুঘ্রাণ তৈরি হয়।</p> <p><strong>গর্ভবতীদের প্রিয় খাদ্য</strong><br /> একসময় সিলেট অঞ্চলে, বিশেষ করে হবিগঞ্জের গ্রামাঞ্চলে ছিকড়ের প্রচুর চাহিদা ছিল। দোকানেও বিক্রি হতো। হকাররা বাড়ি বাড়িও পৌঁছে দিতেন। নগদ টাকায় বা চালের বিনিময়ে ছিকড় কেনাবেচা হতো। গর্ভবতী মায়েদের কাছে জনপ্রিয় ছিল ছিকড়। বিশ্বাস করা হতো এটা খেলে রোগবালাই সারে; কিন্তু এখন এটিকে অস্বাস্থ্যকর হিসেবেই দেখা হয়।</p> <p><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/May 2019/18/Cikor1.jpg" style="height:499px; width:665px" /></p> <p><strong>তবে এখনো লন্ডন যায়</strong><br /> ঝরনা রানি জানান, অনেক জায়গা থেকেই লোকে ছিকড় খুঁজতে আসেন। মোবাইলেও যোগাযোগ করেন কেউ কেউ। প্রবাসীরা লন্ডন ফেরার আগে ছিকড় নিতে আসেন। কেউ কেউ আত্মীয়দের মাধ্যমে লন্ডন পাঠাতে বলেন। প্রতি মাসে বিদেশের একাধিক ফরমায়েশ পান। গত মাসেই পাশের দেবপাড়া ইউনিয়নের এক লন্ডনপ্রবাসী এবং আরেক আমেরিকাপ্রবাসী তাঁর কাছ থেকে ১০ কেজি করে ছিকড় নিয়েছেন। এখন তিনি ২০০ টাকা কেজি দরে ছিকড় বিক্রি করেন। তবে প্রবাসীদের ফরমায়েশ পেলে বকশিশ পান বেশি।</p> <p><strong>ছিকড় নিয়ে গবেষণা</strong><br /> হবিগঞ্জের সবচেয়ে বড় ব্যবসাকেন্দ্র চৌধুরী বাজার এলাকায় এখনো ছিকড় মেলে। হবিগঞ্জের লোকজ সংস্কৃতি সংগ্রাহক ও গবেষক আবু ছালেহ আহম্মেদ এ নিয়ে অনেক লেখালেখি করেছেন। তিনি বলেন, সিলেট অঞ্চলে একসময়ের জনপ্রিয় খাবার ছিল এটি। শত বছরের পুরনো এই ছিকড়শিল্প। এখন অবশ্য বিলুপ্তপ্রায়। নবীগঞ্জ ছাড়াও বাহুবল, বানিয়াচং এবং মাধবপুর উপজেলায়ও ছিকড় তৈরির কারিগর ছিল।</p>