<p>‘কাট ইয়োর কোট অ্যাকর্ডিং টু ইয়োর ক্লথ’ বা আয় বুঝে ব্যয় করা―এই প্রবাদবাক্যের সাথে আমরা সকলেই পরিচিত। কিন্তু ইংরেজি এই বাক্য কি আদৌ মেনে চলা সম্ভব হয় কারো? একটা কোট বানাতে সাধারণত দুই গজ কাপড় লাগে। এখন কারো কাছে যদি এক গজ কাপড় থাকে, তাহলে কি তার জন্য আদৌ কোট বানানো যাবে? যে জিনিস সম্ভবই না সেটি কেন আমাদের প্রবাদবাক্যের অংশ হলো? মূলত আমাদের মতো দেশের মানুষ যখন সীমিত আয় বা সম্পদ দিয়ে অসীম চাহিদা বা প্রয়োজনীয়তা মেটাতে চায়, তখন যেন নিজের ও পরিবারের ভবিষ্যৎ এবং সামনের দিনগুলোতে আরো প্রয়োজনীয়, যেমন―শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অসুস্থতা বা দুর্ঘটনার মতো বিষয়ও আসতে পারে, সেটি মাথায় রাখে। আর এখান থেকেই ‘ব্যক্তিগত আর্থিক ব্যবস্থাপনা’ ধারণা এসেছে। সেই ব্যবস্থাপনা নিয়ে লিখছেন<strong> হামিমুর রহমান ওয়ালিউল্লাহ</strong>।</p> <p>বিখ্যাত সাময়িকী ফোর্বসের মতে, আর্থিক ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত জ্ঞান থাকা সকলের জন্য অপরিহার্য। কারণ এটি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে, যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বাড়ায়, মানসিক চাপ কমায় এবং জীবনমানের উন্নতিতে কাজ করে। এই জ্ঞান মানুষকে যেমন আয় বুঝে ব্যয় করা শেখায়, তেমনি ব্যয় বুঝে কিভাবে আয়ও বাড়াতে হবে সেটির সঠিক নির্দেশনা দেয়। আর্থিক ব্যবস্থাপনার জ্ঞান আপনাকে উদ্ভূত যেকোনো সংকট মোকাবেলা করতে ও সুযোগ কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে সক্ষম করে তুলবে।</p> <p>আর্থিক ব্যবস্থাপনা আপনাকে অনেক কিছু শেখাবে। আয়-ব্যয়ের সংজ্ঞতি সম্পর্কে জানতে পারবেন। মানুষমাত্রই চাহিদার যেন শেষ নেই। আজ যিনি ১৫ হাজার টাকা দিয়ে বাসা ভাড়া দিয়ে থাকেন, তার হয়তো ইচ্ছে করে আরো বড় বাসায় পরিবারের সবাইকে নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকবেন। আমাদের মতো হয়তো অনেকেরই ইচ্ছে করে প্রতিনিয়ত ভালো খাওয়ার। প্রিয়জনের সাথে প্রতিনিয়ত ভালো সময় কাটানোর। কিন্তু চাইলেই কি আর পারা যায়? তাই মাসের শুরুতেই মৌলিক খাত তথা খাদ্য, শিক্ষা বা বাসস্থানের মতো বিষয়ের খরচ কতটুকু হবে তা হিসাব করে ফেলা যায় এবং কোন কোন খাত থেকে কত টাকা আসবে তারও একটা হিসাব করা যায়।</p> <p>এখান থেকেই শুরু হবে মূল কাজ। প্রথমেই, এই সীমিত আয় দিয়ে প্রয়োজনের সর্বোচ্চ কিভাবে মেটানো যায় সেই পরিকল্পনা করতে হবে। এখানে মাথায় রাখতে হবে, চাহিদা এবং প্রয়োজনীয়তার মাঝে সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। খাবারের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়তা হচ্ছে, বেঁচে থাকার জন্য সীমিত আয়ে সর্বোচ্চ পুষ্টি ও ভিটামিনসমৃদ্ধ খাবারের জোগান দেওয়া। এর বাইরে বাকি সব হচ্ছে চাহিদা। আমাদের প্রাথমিক কাজ হবে, কেবল প্রয়োজনীয়তাকেই হিসাবের মধ্যে রাখা। প্রয়োজনীয়তা মেটানোর জন্য আপনার আয়ের দুই-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত খরচের কথা ভাবতে পারেন। জরুরি কারণ যেমন অসুস্থতা, দুর্ঘটনা, জীবনের বড় কোনো ইভেন্ট তথা বিয়ে বা বিনিয়োগ ছাড়া কখনো এই ব্যয় মাসের আয়ের থেকে বেশি না হয়, সেটি খুব কঠোরতার সাথে মেইনটেইন করা।</p> <p>সঞ্চয় ও বিনিয়োগের অভ্যাস বাড়াতে হবে। আমরা শর্ট-টার্ম বা লং-টার্ম ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখেই আয়ের একটা অংশ সঞ্চয় করি। আমরা যারা বেসরকারি চাকরি করি বা করব ভাবছি, তাদের সাধারণত ভবিষ্য তহবিল থাকে না। বেশির ভাগ চাকরিতে সহজ কিস্তিতে ও স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থাও থাকে না। তখন এই সঞ্চয়ই যেকোনো দরকারে বা অবসর-পরবর্তী জীবনে মূল চালিকাশক্তি হয়ে থাকে।</p> <p>আমরা যদি আয়ের এক-তৃতীয়াংশ জমাতে পারি, সে ক্ষেত্রে জমানো অর্থের একটা অংশ সঞ্চয় এবং বাকি অংশ বিনিয়োগ করতে পারব। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের কমন সমস্যা হচ্ছে, আমরা বিনিয়োগে সাহস পাই না। অর্থ একবারেই হারিয়ে যাওয়ার ভয় এবং বিনিয়োগের যথার্থ পরিবেশের অভাব এখানে মূল কারণ। এ ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যাংক, সঞ্চয় বা প্রতিষ্ঠিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অল্প অল্প করে বিনিয়োগ করা যায়। পাশাপাশি পারলে ছোটখাটো নিজের ব্যবসায় বিনিয়োগ করা। পাশের একজন বিশ্বস্ত প্রতিবেশী কর্মক্ষম ও শিক্ষিত কিন্তু আয় নেই, তাকে কাজে লাগানো। এখানের যে মুনাফা হবে তার একটা অংশ আবার ব্যবসায় বিনিয়োগ করে বাকি অর্থ সঞ্চয়ে রাখা। এটি বাড়তে থাকলে তখন জমি, ফ্ল্যাট বা স্থায়ী সম্পদ কেনার চিন্তা একটা ভালো অপশন হতে পারে।</p> <p>ঋণ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে কৌশলী হতে হবে। আর্থিক ব্যবস্থাপনায় আমরা কতটুকু ভালো তা বোঝা যায় ঋণ ব্যবস্থাপনায় কতটুকু ভালো তার মাধ্যমে। আমরা যতই হিসেবি জীবন চালাই না কেন কখনো ঋণের দরকার পড়েই। তাই ঋণ নিয়ে ফেললে দ্রুতই দক্ষতার সাথে এটি পরিশোধের সকল কৌশল তৈরি করা। প্রয়োজনে একাধিক কৌশলও মাথায় রাখা যেতে পারে। যেমন কোনো কারণে বেতন দেরিতে হতে পারে, তাই আত্মীয়, বন্ধু বা কাছের কোনো কলিগদেরও বলে রাখা।</p> <p>ফোর্বস সাময়িকীর মতে, ঋণ নেওয়া এবং পরিশোধের জন্য দুটি বিষয় জরুরি। প্রথমত, ঋণের শর্তাবলি কী ছিল তা সব সময়ের জন্যই মাথায় রাখা। যেমন―মাসিক কিস্তি পরিশোধের দিনক্ষণ ইত্যাদি। ডেডলাইনের কমপক্ষে তিন দিন আগেই পরিশোধের চেষ্টা করা। কারণ সাধারণত এখানে টেকনিক্যাল সমস্যা থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে কিন্তু আপনি বা আমি শর্ত ভঙ্গের শাস্তি হিসেবে জরিমানা, বাড়তি সুদসহ নানা রকম ঝামেলার মুখোমুখি হতে পারি। দ্বিতীয়ত, ভালো ঋণ ও মন্দ ঋণের পার্থক্য বোঝা। শিক্ষার জন্য ঋণ আপনার ভবিষ্যতের বিনিয়োগ। এটি আগামী দিনে আরো বহুগুণে মুনাফা দেবে। এটি তাই ভালো ঋণ। অন্যদিকে যেমন আইফোনের জন্য ঋণ করা। এটি যদি আপনার শিক্ষা বা ক্যারিয়ারে খুব বেশি কাজে না লাগে তখন এটিই হবে মন্দ ঋণ।</p> <p>কর-সংক্রান্ত জ্ঞান আপনার আর্থিক ব্যবস্থাপনা সহজ করবে। আয়-ব্যয় ও সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে আমাদের প্রথম থেকেই কর-সংক্রান্ত জ্ঞান রাখা ও কর প্রদানের অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি। করের জ্ঞান আপনার বিনিয়োগ সহজ করে দেবে। কোন খাতে বিনিয়োগে আপনি কর অব্যাহতি পাবেন সেটি জানতে পারবেন। একই সাথে বছর শেষে হিসাব করে আয়কর রিটার্ন দাখিল জরুরি। এটি আপনাকে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণে সাহায্য করবে। এখন ব্যাংকের ঋণসহ সরকারি ও বেসরকারি বেশ কিছু সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ দেখানো আবশ্যক। আপনার রিটার্ন দেওয়া থাকলে আপনি তাই অনেকের থেকে এগিয়ে থাকবেন। এ ছাড়াও ভবিষ্যতে বিনিয়োগ বা ব্যবসা বাড়াতে গেলে কর প্রদানের স্বচ্ছতাই আপনাকে দুশ্চিন্তামুক্ত ও হয়রানিমুক্ত ব্যবসা করতে সাহায্য করবে। অন্যথায় আজকের কর ফাঁকিই আগামী দিনে কাল হতে পারে!</p>