<p>নাট্যাঙ্গনের মানুষ যাঁকে নির্বিবাদে শ্রদ্ধা করেন, তিনি সৈয়দ জামিল আহমেদ। জীবনের প্রায় পুরোটা সময় তিনি নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছেন নাটকের সঙ্গে। তাঁর লেখায়, নির্দেশনায় ও প্রশিক্ষণে সমৃদ্ধ হয়েছে নাট্যাঙ্গন। সোমবার (১২ আগস্ট) বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন লিয়াকত আলী লাকী। অনেকে তাঁর স্থলে সৈয়দ জামিল আহমেদকে চাইছেন। এসব প্রসঙ্গে তাঁর ভাবনা-পর্যালোচনা শুনেছেন কামরুল ইসলাম।</p> <p><strong>প্রসঙ্গ লাকী</strong><br /> দীর্ঘ ১৩ বছর শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন লিয়াকত আলী লাকী। এ নিয়ে শিল্পাঙ্গনের মানুষের অভিযোগের অন্ত নেই। তাঁর বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগও ছিল। শিল্পকলার লাকী অধ্যায় নিয়ে সৈয়দ জামিল আহমেদ বলেন, ‘আশির দশকের শুরুর দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে নাট্যোৎসব হয়েছিল, সেখানে লাকী ছিল কালচারাল সেক্রেটারি। সেখান থেকে তাঁকে চিনি। আসলে বাংলাদেশে আমরা আবেগে-উচ্ছ্বাসে ভেসে যাই। যখন যে ভালো, তাঁর সব ভালো; যে খারাপ, তাঁর সব খারাপ। আমি কখনো দেখিনি, যে মানুষ ভালো, তার সব কিছুই ভালো। লিয়াকত আলী লাকীকে আমি বহুবার বলেছি, ছেড়ে দেন না কেন? হয় ফেডারেশন (বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন) রাখেন, না হয় এখানে (শিল্পকলা) থাকেন। তিনিও বলেছেন ছেড়ে দেবেন। আবার তিনি অনেক কাজও করেছেন। সবটা নিয়ে একটা খোলামেলা আলোচনা হওয়া উচিত। সেখানে আত্মপক্ষ সমর্থনেরও সুযোগ থাকবে। ঢালাওভাবে বলতে চাই না, কেউ একদম ভালো কিংবা কেউ একেবারে খারাপ। আমরা মানুষ, সবারই ব্যর্থতা আছে। লাকীরও আছে, সেটা আমি তাঁকে বারবার বলেছিও।’ </p> <p><strong>আগ্রহ নেই পদে</strong><br /> লাকীর পদত্যাগের আগে থেকেই সৈয়দ জামিল আহমেদকে শিল্পকলা একাডেমির দায়িত্বে চাইছেন অনেকে। কিন্তু এ নিয়ে তিনি একেবারেই নির্মোহ। বলেন, ‘আমি শিল্পকলা একাডেমির ভেতরে ঢুকব না। পুরো ব্যবস্থায় এত গণ্ডগোল লেগে আছে! লাকী তো সর্বশেষ দায়িত্বে ছিল, আরো আগে থেকেই এখানে নানা অনিয়ম-জটিলতা লেগে আছে। জায়গাটা অবশ্যই স্বচ্ছ হওয়া দরকার। যিনি জনগণ ও নাট্যকর্মীদের প্রতিনিধি, এ রকম একজন আসুক দায়িত্বে। কিন্তু আমি শিল্পকলার ভেতরে কখনো ঢুকব না। আমার একটাই কাজ, থিয়েটার করা। নাটক করতে চাই, নির্দেশনা দিতে চাই। আপনারা যদি পারেন, আমাকে একটু জায়গা দেন, যেখানে একটা স্টুডিও করতে পারব, নিজের মতো করে নাটক করতে পারব। এর পাশাপাশি বরাবরের মতো অন্যায়ের প্রতিবাদ করে যাব। ছাত্রজীবন থেকে শিক্ষকতা, নাটকে—সবখানে আমি এটা অব্যাহত রেখেছি। এইটুকু জায়গা পেলেই আমি খুশি থাকব।’ </p> <p><strong>নতুনের কাছে প্রত্যাশা</strong><br /> চিরায়ত নিয়মে নতুন করে কেউ শিল্পকলার উঁচাসনে বসবেন। তাঁর কাছে কোনো প্রত্যাশা আছে? ‘কোনোভাবে দলীয়করণ করা যাবে না। যে দলই আসুক না কেন, তাদের পদলেহন করা যাবে না। আমি দেখেছি, শিল্পকলায় কোনো সরকারি ব্যক্তি আসবে, এ কারণে সব নাটকের কাজ বন্ধ করে দিয়েছে! আমি চাই এমন একজন মানুষ দায়িত্বে আসবেন, যিনি সবার কথা বলার সুযোগ রাখবে। শেখ মুজিব, জিয়াউর রহমান যাকে নিয়েই নাটক হোক, তার মধ্যে ভালো-মন্দ উভয়ই তুলে ধরা যাবে। এ রকম একটি শিল্পকলা চাই। যদি জামায়াতও নাটক করতে চায়, করতে দিন। শুনি তাদের কী কথা। বিপরীতে আমরাও বলব, সবাই মিলে বলব। যেমন মালভূমিতে হাজার ফুল ফোটে, তেমনি হাজার কথা হোক। দল-মত-নির্বিশেষে এখানে সবার বলার অধিকার থাকবে’—উত্তর সৈয়দ জামিল আহমেদের।</p> <p><strong>ছাত্র-জনতার আন্দোলন</strong><br /> অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে বরাবরই সরব সৈয়দ জামিল আহমেদ। তাই ছাত্র-জনতার এই আন্দোলন তাঁকেও আন্দোলিত করেছে। তিনি বলেন, ‘ছাত্ররা যে আন্দোলন করেছে, এটার প্রতি আমার পূর্ণ সমর্থন ছিল। আমি রাস্তাঘাটে কিংবা রাজনৈতিক মঞ্চে গিয়ে কথা বলার মানুষ না। আমি নাটক করার মানুষ। রাষ্ট্র নিয়ে সব সময় কথা বলেছি। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ করা চলবে না, বলেছি মৌলবাদের বিরুদ্ধেও। ছাত্ররা যেটা করেছে, এটা গৌরবময় অর্জন। ভবিষ্যতে যাতে এটা নষ্ট না হয়, তার জন্য সবাইকে মিলে কাজ করতে হবে। আমার ক্লাসে, নাটকে, লেখায় সব সময় বলব এটার কথা।’ </p> <p><strong>তরুণ প্রজন্ম যেমন</strong><br /> অনেকে বলেন, এ প্রজন্মের অভিনয়শিল্পীরা থিয়েটারচর্চায় অনাগ্রহী। এটা মানতে নারাজ সৈয়দ জামিল আহমেদ, ‘ঠিক অনাগ্রহ নয়। এটা নতুন যুগ। এখানে নিজের সবটা নিজেকে দেখতে হয়। সত্তর-আশির দশকে মানুষ যে উদ্বৃত্ত সময় থিয়েটারে দিতে পেরেছিল, এখনকার তরুণরা সেটা পারে না। এই তরুণরা খুব বুদ্ধিমান। অনেক পড়ে, জানে। আমার কাছে যারা এসেছে বা যাদের প্রশিক্ষণের জন্য বেছে নিয়েছি, তারা তো কাজ করেছে। তারা যখন কাজ করে, সম্পূর্ণ নিষ্ঠা দিয়ে করে। নইলে আমি কিভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়ার স্পর্ধা করি? এই প্রজন্মের অংশগ্রহণ ছাড়া তো সম্ভব হতো না।’</p>