<p>‘হ্যারা প্রেম কইরা বিয়ে করছে তো। স্বামীর এমন মৃত্যুর পর থেইকা আমার মেয়ে খাওনদাওন সব ছাইড়া দিছে। যখন বাসায় আমরা কেউ আছিলাম না, এই সুযোগে মেয়েটাও নিজের জীবন শেষ কইরা দিছে। আমার আরেক মেয়ে গেছিল কাঁচাবাজারে। আইয়া দেখে ঘরে ছিটকানি দেওয়া।’</p> <p>কথা শেষ করার পর কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকলেন মতিউর রহমান। এরপর ভাঙা গলায় এই প্রতিবেদককে বললেন, ‘ভাই, অহন আফসোস ছাড়া কিচ্ছু করার নেই আমাদের। আমাদের দুঃখ ছাড়া আর কিচ্ছু নেই।’</p> <p>গত ২০ জুলাই রাজধানীর শনির আখড়ার রায়েরবাগ এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান মতিউরের মেয়ের জামাই জিসান আহমেদ (২০)। স্বামীর মৃত্যুশোকে উন্মাদপ্রায় মিষ্টি বেগম (১৯) নাওয়াখাওয়া ছেড়ে দেন। দিনরাত কাঁদতেন। জিসানের মৃত্যুর ৯ দিনের মাথায় গত সোমবার দুপুরে আত্মহত্যা করেন মিষ্টি।</p> <p>পরিবার সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালে দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে করেন জিসান ও মিষ্টি। জিসানের বাবা বাবুল সরদার সাড়ে আট বছর ধরে দক্ষিণ সুদানে কর্মরত। ঘটনার সময় বাংলাদেশে ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না তিনি। ২০ জুলাই বেশ কয়েকবার দেশ থেকে ফোন গেলেও কথা বুঝতে পারছিলেন না বাবুল সরদার। ওই দিন রাত ১০টার দিকে আবার ফোন, এবার ১৫ সেকেন্ডের জন্য কিছু কথা শুনতে পান।</p> <p>‘জিসানের আব্বু, জিসান তো নাই, জিসান মারা গেছে! জিসানের মাথায় গুলি লাগছে। এখন ঢাকা মেডিক্যালে আছে।’ এই কয়েকটি বাক্য শোনার পরই অজ্ঞান হয়ে যান বাবুল সরদার। গতকাল শুক্রবার তিনি কালের কণ্ঠকে এ কথা জানান।</p> <p>সোমবার দেশে ফেরেন বাবুল সরদার। প্রিয় সন্তানের লাশ দেখে মূর্ছা যান তিনি। সেদিনই বিকেলে মাতুয়াইল কবরস্থানে দাফন করা হয় জিসানকে। ঠিক পরের সোমবার মিষ্টি সমাহিত হন রংপুর সদর উপজেলার পাগলাপীরে পারিবারিক কবরস্থানে।</p> <p><strong>যা ঘটেছিল সেদিন </strong></p> <p>রাজধানীর রায়েরবাগ এলাকার গ্যাস রোডে পাশাপাশি বাসায় থাকে জিসান ও মিষ্টিদের পরিবার। জিসান এলাকার বিভিন্ন দোকানে ভ্যানে করে ফিল্টারের জার ভর্তি পানি দেওয়ার কাজ করতেন।</p> <p>বাসার সামনেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান মেয়ের জামাই। আর সেই দৃশ্য বাসার ছাদ থেকে দেখেন শ্বশুর মতিউর রহমান।</p> <p>কালের কণ্ঠ’র কাছে সেদিনের ঘটনা তুলে ধরে মতিউর রহমান বলেন, ‘আমার জামাই ১০ বোতল পানি নিয়া আসছে, সাত বোতল দিছে, আর তিন বোতল বাকি আছিল। মেইন রোডে গোলাগুলির কারণে ভ্যানটা আমাগো বাসার গলিতে ঢুকাইছে। গণ্ডগোল গলির ভিতরেও চইলা আসল। আমরা উপর থাইকা ডাকতাছি, হ্যায় (জিসান) আসে নাই। খাম্বার (বৈদ্যুতিক খুঁটি) কাছে খাড়াইয়া উঁকি দিয়া দেখতাছিল, তখনই চোখের উপরে গুলি লাগে। ওইখানেই পইড়া যায়। সন্ধ্যা ৬টার আগে আগে ঘটনাটা ঘটে।’</p> <p><strong>কষ্ট না ভুলতেই আরেক আঘাত</strong></p> <p>জিসানের বাবা বাবুল সরদার বলেন, ‘ছেলের কষ্ট ভুলতে না ভুলতেই আমার ছেলের বউ আত্মহত্যা করল। ওরে এক সপ্তাহ কিছু খাওয়াইতে পারি নাই আমরা। খালি ছেলের কাপড়চোপড় নিয়া বইসা থাকত আর কাঁদত। স্বামীর মাথার এক দিক দিয়ে গুলি ঢুইকা আরেক দিক দিয়া বাইর হইছে—এই দৃশ্য সে সহ্য করতে পারে নাই।’ </p> <p>ক্ষুব্ধ কণ্ঠে তিনি বলেন ‘আমি সাড়ে আট বছর ধইরা দেশে অন্তত এক কোটি টাকা পাঠাইছি। কখনো দেশের সঙ্গে গাদ্দারির চেষ্টাও করি নাই। কিন্তু এটা আমার বাংলাদেশ, আজকে আমারে ছেলের ডেডবডি উপহার দিছে। আমি এই বিচার দেশবাসীর কাছে চাই।’</p> <p>জিসানের স্ত্রী মিষ্টির বাবা মতিউর রহমান নিস্পৃহ গলায় এই প্রতিবেদকের উদ্দেশে প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ‘কার কাছে বিচারটা চাইবেন? আপনে বলেন, কার কাছে গেলে বিচারটা পাওয়া যাইব?’</p> <p>এখন সুদানে ফেরত যাওয়া নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বাবুল সরদারের। তিনি বলেন, ‘আমার স্ত্রী এই শোকে খুব অসুস্থ। তারে ডাক্তার দেখাইছি একজনের কাছ থেইকা দুই হাজার টাকা ধার কইরা। আমার ছোট মেয়ে ক্লাস নাইনে পড়ে। সে পাঁচ-দশ টাকা কইরা জমাইছে। আইজ (শুক্রবার) সকালে সে আমারে কাঁদতে কাঁদতে ৫৩০ টাকা দিছে। আমি যে বিদেশ যামু, আমার কাছে কোনো টাকা-পয়সাও নাই।’</p>