<p>শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠেছে রাজধানীসহ সারা দেশ। ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে গতকাল রবিবার দুপুরের পর থেকে শুরু হয় সড়ক অবরোধ। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও দেশের বিভিন্ন মহাসড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। এতে সড়কে নেমে আসে স্থবিরতা।</p> <p>দুপুরের পর থেকেই যানজটে নাকাল রাজধানীবাসী। মহাসড়কে দূরপাল্লার যাত্রীরা পড়ে চরম ভোগান্তিতে। গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত অনেক সড়ক দখল করে রেখেছিলেন শিক্ষার্থীরা। তবে কিছু সড়ক তাঁরা আগেই ছেড়ে দেন।</p> <p>এদিকে গতকাল রাত ৮টায় শাহবাগে অবরোধ কর্মসূচি শেষে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফরম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। চলমান চার দফা দাবি থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে এক দফা দাবিতে নামিয়ে এনে ফের সারা দেশে ‘ব্লকেড’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। শিক্ষার্থীদের বর্তমান এক দফা দাবি হলো সব গ্রেডে সব ধরনের অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে সংসদে আইন পাস করতে হবে।</p> <p>কর্মসূচি ঘোষণা করে কোটা আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘কোটাবৈষম্যের চূড়ান্ত সমাধান করতে হবে। আমাদের বলা হচ্ছে, এটি আদালতের বিষয়। আমরা স্পষ্ট বলতে চাই, আমাদের দাবি শুধু আদালতের কাছে নয়, আমরা নির্বাহী বিভাগের কাছেও জানতে চেয়েছি কেন ২০১৮-এর পরিপত্র বাতিল করা হলো। সরকারের কাছে এখনো সুযোগ রয়েছে নতুন করে পরিপত্র ঘোষণা করার। এবার যখন মাঠে নেমেছি, আর কোনো আপসে যাব না।’</p> <p>তিনি বলেন, ‘অনির্দিষ্টকালের জন্য আমাদের ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। সারা দেশে সোমবার ব্লকেড কর্মসূচি চলবে। আমরা আজ (গতকাল) শাহবাগ থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত গিয়েছি। সোমবার ফার্মগেট পার হয়ে যাব। সোমবার লাইব্রেরির সামনে থেকে আবারও সাড়ে ৩টায় জড়ো হওয়ার ঘোষণা দিচ্ছি।’</p> <p>গতকাল অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে শিক্ষার্থীরা রাজধানীর বাইরে ঢাকা-আরিচা, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-বরিশাল, ঢাকা-পাবনা, ঢাকা-যশোর, কুষ্টিয়া-খুলনা, বরিশাল-খুলনাসহ অনেক সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ করেন। এমনকি ময়মনসিংহ-জামালপুর রেলপথে জামালপুর অগ্নিবীণা এক্সপ্রেস ট্রেন আধাঘণ্টার মতো আটকে রাখেন শিক্ষার্থীরা।</p> <p>আজ সোমবার বিকেল সাড়ে ৩টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে থেকে মূল ব্লকেড আন্দোলন শুরু হবে। এ ছাড়া একই সময়ে সারা দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে এই ব্লকেড কর্মসূচি শুরু হবে।</p> <p>গতকাল দুপুর থেকে কোটাবিরোধী আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিল ও খণ্ড খণ্ড অবরোধের কারণে চানখাঁরপুল মোড়, সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়, শাহবাগ মোড়, নীলক্ষেত, ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের মোড়, কারওয়ান বাজার মোড়, হাতিরপুল, আগারগাঁও, মহাখালী ও পল্টন এলাকার গুরুত্বপূর্ণ মোড় অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। রাজধানীর চানখাঁরপুল মোড় অবরোধ করায় বন্ধ হয়ে যায় মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারে যানবাহন ওঠানামা। এর ফলে বেশ কিছু সময় ঢাকায় প্রবেশ করতে পারেনি কোনো গাড়ি।</p> <p>অবরোধের কারণে তৈরি হওয়া যানজটে ভোগান্তিতে পড়েছে নিউ মার্কেট, নীলক্ষেত, সায়েন্স ল্যাবসহ আশপাশের সড়ক ব্যবহারকারীরা। নীলক্ষেত থেকে সায়েন্স ল্যাব অভিমুখী সড়ক, শাহবাগ থেকে সায়েন্স ল্যাব অভিমুখী সড়ক, ধানমণ্ডি এবং মোহাম্মদপুর থেকে সায়েন্স ল্যাবমুখী সব সড়কেই তৈরি হয়েছে তীব্র যানজট।</p> <p>গতকাল দুপুর থেকেই পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ‘বাংলা ব্লকেড’ করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। বিকেল ৩টার কিছু সময় পর গ্রন্থাগারের সামনে থেকে মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অংশ প্রদক্ষিণ করে ভিসি চত্বর হয়ে টিএসসি মোড় হয়ে শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন আন্দোলনকারীরা। বিকেল ৪টার দিকে আন্দোলনকারীদের কিছু অংশ পরীবাগ মোড় আর কিছু অংশ বাংলামোটর মোড় অবরোধ করে৷ এদিকে বিকেল ৩টায় একই দাবিতে চানখাঁরপুলসংলগ্ন মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারে ওঠা ও নামার র‌্যাম্প অবরোধ করেন আন্দোলনকারীরা।</p> <p>এর আগে দুপুর ২টায় সর্বপ্রথম রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব মোড় অবরোধ করেন ঢাকা কলেজের কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা।</p> <p>বিকেল ৩টার দিকে ইডেন মহিলা কলেজ থেকে মিছিল নিয়ে নীলক্ষেত মোড় অবরোধ করেন ইডেন কলেজের আন্দোলনকারীরা। বিকেল ৪টার পর সায়েন্স ল্যাব মোড় থেকে আরো আন্দোলনকারী এসে নীলক্ষেত মোড়ে জড়ো হন। কিছু সময় পর সরকারি তিতুমীর কলেজ থেকেও আন্দোলনকারীরা নীলক্ষেত মোড় অবরোধে যোগ দেন। সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত নীলক্ষেত মোড় অবরোধ করে রাখা হয়। সন্ধ্যা ৭টার পর আন্দোলনকারীরা একটি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শাহবাগে যান।</p> <p>রাজধানীর যানজটে ভোগান্তির চিত্র জানতে কথা হয় আগারগাঁওয়ের বাসিন্দা নাঈম ইসলামের সঙ্গে। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, রবিবার সকালে আগারগাঁও থেকে ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর হয়ে শাহবাগ পৌঁছতে তাঁর সময় লেগেছে প্রায় দুই ঘণ্টা। তা-ও মোটরসাইকেলে। সাধারণত এই পথ ২৫ থেকে ৩৫ মিনিটে তিনি যাতায়াত করেন।</p> <p>কথা হলে ঠিকানা পরিবহনের বাসচালক মো. আব্দুল্লাহ বিকেলের দিকে বলেন, ‘আমি চানখাঁরপুল এলাকায় আটকা পড়িনি। গাড়ি নিয়ে চলে আসতে পেরেছি। কিন্তু এখন সায়েন্স ল্যাবে এসে দেখি রাস্তা বন্ধ। এখানেই আধাঘণ্টার ওপর আটকে আছি। কখন নড়তে পারব বুঝতে পারছি না।’</p> <p>কারওয়ান বাজার জোনের সহকারী কমিশনার (ট্রাফিক) স্নেহাশীষ কুমার দাস গতকাল সন্ধ্যার দিকে বলেন, ‘দুপুরের দিকে শাহবাগমুখী সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক ছিল না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। কোটাবিরোধী আন্দোলনের ফলে কোনো গাড়ি কারওয়ান বাজার থেকে শাহবাগের দিকে যেতে পারছে না। ফলে এ যানজট ফার্মগেট-তেজগাঁও ছাড়িয়ে বিজয় সরণি পর্যন্ত পৌঁছেছে।’</p> <p>এদিকে কোটাবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে রাজধানীতে গতকাল পূর্বনির্ধারিত রথযাত্রাও ছিল। রথযাত্রার কারণে বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত ঢাকার স্বামীবাগ থেকে ঢাকেশ্বরী মন্দির পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকায় এর প্রভাব পড়েছে অন্যান্য সড়কে। রথযাত্রা উপলক্ষে সকাল থেকে জয়কালী মন্দির মোড়, ইত্তেফাক মোড়, মতিঝিল শাপলা চত্বর, দৈনিক বাংলা মোড়, রাজউক ভবন চত্বর, গুলিস্তান ও হাইকোর্ট মোড়ে যানজট ছিল। তবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এ উৎসবকে কেন্দ্র করে যানজটের বিষয়ে আগেই সতর্কবার্তা দিয়েছিল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ।</p> <p>গতকাল সকাল ১১টার দিকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে সমাবেশ করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থীরা। তাঁদের কর্মসূচি চলে দুপুর ১টা পর্যন্ত। এতে সড়কের উভয় পাশে যানজট সৃষ্টি হয়। এ সময় পথচারীদের হেঁটে রাস্তা পার হতে দেখা গেছে।</p> <p>কুমিল্লা সদর দক্ষিণের কোটবাড়ি বিশ্বরোড এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক গতকাল আবারও অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজসহ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজ, জেলার বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীরা এই কর্মসূচিতে অংশ নেন। অবরোধের কারণে মহাসড়কের উভয় দিকে অন্তত ১০ কিলোমিটারজুড়ে যানজট সৃষ্টি হয়।</p> <p>আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাবেয়া ভূঁইয়া অন্তু, কাজী সানজিদাসহ বেশ কয়েকজন বলেন, ‘আমরা কোটা চাই না। মেয়েরা এখন মেধায় অগ্রসর। বিশ্ববিদ্যালয়েও মেয়েদের আসন ছেলেদের প্রায় সমান। উচ্চশিক্ষায়ও মেয়েদের সংখ্যা বেশি। এত বেশি কোটা থাকা বৈষম্যমূলক। তাই কোটা বাতিল চাই।’</p> <p>ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক, বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক, বরিশাল-খুলনা মহাসড়কসহ অভ্যন্তরীণ সব গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করেছেন কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। গতকাল সকাল ১১টায় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, বিএম কলেজ, বরিশাল কলেজ, হাতেম আলী কলেজ ও মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল শেষে সড়কগুলো অবরোধ করেন।</p> <p>এদিকে মহাসড়ক অবরোধের কারণে বরিশাল নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে রহমতপুর পর্যন্ত, বরিশাল নগর ও খয়রাবাদ সেতু প্রান্তে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়। এতে বরিশাল থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া এবং ঢাকা থেকে বরিশালের উদ্দেশে ছেড়ে আসা বাসের যাত্রীদের দীর্ঘ সময় বাসেই অবস্থান করতে হয়। চরম ভোগান্তিতে পড়ে যাত্রীরা। একই সঙ্গে বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা ও ঝালকাঠি—এ রুটগুলোতে বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যানবাহনে থাকা যাত্রীদের পড়তে হয় চরম ভোগান্তিতে। তবে অ্যাম্বুল্যান্সসহ জরুরি প্রয়োজনের যানবাহনের চলাচল স্বাভাবিক ছিল। গণপরিবহন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হেঁটে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দেয় অনেকে।</p> <p>গত ৫ জুন হাইকোর্ট ২০১৮ সালে সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের পরিপত্রটি বাতিল ঘোষণা করলে আন্দোলন শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা। তখন শিক্ষার্থীরা চার দফা দাবি জানিয়েছিলেন।</p> <p><strong>[প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন আমাদের বিভিন্ন জেলা প্রতিনিধি ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিরা]</strong></p> <figure class="image"><img alt="বাংলা ব্লকেডে স্থবির সড়ক" height="600" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/07.July/08-07-2024/2_kaler-kantho--08-7-2024.jpg" width="1000" /> <figcaption>সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। এর ফলে সড়কে তীব্র যানজট তৈরি হয়। বাংলামোটর মোড়ে। ছবি : কালের কণ্ঠ</figcaption> </figure> <p> </p>