<p>বাংলাদেশের জাতীয় কবি, বাংলা সাহিত্যাকাশে এক উজ্জল নক্ষত্র বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি ২৪ মে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে (১৩০৬বঙ্গাব্দের ১১ ই জ্যৈষ্ঠ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতা কাজী ফকির আহমদ ছিলেন মসজিদের ইমাম ও মাযারের খাদেম এবং মাতা জাহেদা খাতুন ।</p> <p>ছোটবেলা থেকেই নজরুলের জীবন ছিল দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত। তাঁর ডাকনাম ছিল ‘দুখু মিয়া’। ১৯০৮ সালে তাঁর পিতার মৃত্যু হলে নজরুলের পরিবারে নেমে আসে অপরিসীম দুঃখ। পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য তিনি মাজারের সেবক, মসজিদের মুয়াজ্জিনের কাজ করেন।<br /> ১৯১১ সালে কবি নজরুল যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে কলকাতার মাথরুন স্কুলে পড়েন তখন মারাত্বক অর্থাভাবে পতিত হন তিনি। অর্থাভাব লাঘব করার জন্য তিনি রুটির দোকানে মাসিক এক টাকা বেতনে চাকরি নেন। টাকা এবং খাবার দেবে কিন্তু থাকার জায়গা দেবে না এই শর্তে কাজ নেন নজরুল। ফলে কোনও উপায় না দেখে নজরুল আসানসোলের রুটির দোকান সংলগ্ন একটি তিনতলা বাড়ির বারান্দায় সিড়ির নিচে রাত্রি যাপন করতেন। ওই বাড়িতেই থাকতেন পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর কাজী রফিজ উল্লাহ। রফিজ উল্লাহ সাহেবের বাড়ি ছিল ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল থানার কাজীর শিমলা গ্রামে। কাজী সাহেব একদিন সিঁড়ির নিচে ঘুমন্ত নজরুলকে দেখে কৌতুহলী  হয়ে পড়েন এবং নজরুলের জীবন কাহিনী শুনেছিলেন।<br /> রফিকুল ইসলামের লেখায় পাওয়া যায়, দারোগা সাহেব নাকি নজরুলকে পাঁচ টাকা বেতনে বাড়ির কাজে নিযুক্ত করেন কিশোর নজরুলকে। তখন পর্যন্ত দারোগা এবং তার স্ত্রী শামসুন্নেছা দম্পত্তি ছিলেন নিঃসন্তান। নজরুল দারোগাকে তাঁর পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। নজরুলের অনুরোধে আবেগাপ্লুত হয়ে কাজী সাহেব তার বড় ভাই কাজী সাখাওয়াতউল্লাহকে পত্রযোগে নজরুলকে ত্রিশালের কাজীর শিমলায় পাঠিয়ে দেন স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য। এভাবে নজরুলের আসানসোলের রুটির দোকান এবং কাজী রফিজউল্লাহের বাড়ির চাকরির সমাপ্তি ঘটে।</p> <p><strong>কাজীর শিমলায় নজরুল</strong> : আলাউদ্দিন আল আজাদ এর লেখায় পাওয়া যায়, ১৯১৪ সালে কাজী রফিজউল্লাহ দারোগা নজরুলকে ভর্তি করানোর জন্য তাঁর পাশের বাড়ির ছেলে কাজী ইসমাইলের সাথে ময়মনসিংহের সিটি স্কুলে পাঠান। নজরুলের নাকি স্কুলটি পছন্দ হয়েছিল কিন্তু জায়গীর না পাওয়ায় ঐ স্কুলে পড়ার সৌভাগ্য হয়নি নজরুলের। ঐ একই সালের জুন মাসে কাজী নজরুল ইসলাম ও ছোট ভাই কাজী আবুল হোসেন কে দরিরামপুর ইংরেজি হাইস্কুলে (বর্তমানে নজরুল একাডেমি) ভর্তি করান দারোগা সাহেব। কাজী আবুল হোসেন আসানসোলে নজরুলের সহপাঠী ছিলেন। তাই তিনি ভর্তি হোন সনদপত্রের ভিত্তিতে আর নজরুল ভর্তি হোন টেস্ট পরীক্ষা দিয়ে।</p> <p><strong>ত্রিশালে নজরুল</strong> : কাজীর শিমলা গ্রাম থেকে ত্রিশালের দরিরামপুরের দুরত্ব ছিল পাঁচ কিলোমিটার। এই পাঁচ কিলোমিটার পথ হেঁটে যেতে হতো নজরুলকে স্কুলে ক্লাস করার জন্য। বর্ষাকালে রাস্তা চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ত। ফলে স্কুলে যাতায়াতে খুব কষ্ট হতো নজরুলের। এই অসুবিধা লাঘব করার জন্য দারোগা সাহেব ত্রিশালের নামাপাড়ায় তাঁর আত্মীয় কাজী হামিদুল্লাহের বাড়িতে জায়গীর রাখেন নজরুলকে। কিন্তু হামিদুল্লাহ ছিলেন ধার্মিক, পরহেজগার ও গম্ভীর প্রকৃতির লোক। নজরুল নামাজ পড়তেন না, এজন্য তিনি নজরুলকে ঘৃণা করতেন এবং শাসনে রাখতেন। বিভিন্ন লেখকের লেখা থেকে পাওয়া যায়, কাজীর শিমলায় নজরুল তিন মাস অবস্থান করেছেন। সেখানে অনেক স্বাধীনতা ছিল নজরুলের। কিন্তু জায়গীর বাড়িতে এতো স্বাধীনতা ছিল না। তাই নজরুল বাঁশি বাজানো, গান গাওয়া, রাস্তাঘাট, বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো, একটি বটগাছে চড়ে বাঁশি বাজানো ইত্যাদি করতেন। নজরুল তখন তেমন পড়াশুনা করতেন না। তাই নজরুলকে আশ্রয়হীন হতে হয়। পরে তিনি বিচুতিয়া বেপারীর বাড়িতে জায়গীর থাকেন। বেপারী বাড়ির পূর্ব দিকে একটি ছোট পুকুর ছিল। সেই পুকুরের পাড়ে একটি ছোট ছনের ঘর ছিল। সেই ঘরেই নজরুল থাকতেন। অবশ্য পুকুরটিতে নজরুল গোসল করতেন না। পাশের বাড়ির আরেকটা পরিষ্কার পানির পুকুরে তিনি গোসল করেছেন। বিচুতিয়া বেপারীর পুত্রবধু নজরুলকে খাওয়াতেন।</p> <p>কবির স্মৃতি বিজড়িত এই বাড়িতেই তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে নির্মিত হয়েছে তিনতলা বিশিষ্ট “নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র”। প্রথম তলায় অডিটোরিয়াম, দ্বিতীয় তলায় অফিসরুম এবং তৃতীয় তলায় লাইব্রেরি রয়েছে। এছাড়াও কবি যে ঘরে ঘুমাতেন সেই ঘরটি পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে। পাশেই একটি পুকুর খনন করা আছে। নজরুল স্মৃতিকেন্দ্রটি দেখাশুনার জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে একজন সহকারী পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত)  ও লাইব্রেরিয়ান সহ ছয়জন নিয়োগ দেয়া হয়েছে । এখানে শিশু কিশোরদের এক বছর মেয়াদী নজরুল-সংগীত প্রশিক্ষণ কোর্স চালু রয়েছে।<br />  “নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র ” এর সহকারী পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) আক্তারুজ্জামান বলেন,প্রতিদিন এখানে অসংখ্য দর্শনার্থী ভিড় করে নজরুলকে জানার চেষ্টা করে। নজরুলের সংগীত লালন করার জন্য এখানে শুদ্ধ বাণী ও সুরে শিশু কিশোরদের এক বছর মেয়াদী নজরুল-সংগীত প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করা হয়েছে। এতে করে নজরুল সম্পর্কে মানুষ আরো বেশি বেশি জানতে পারবে।</p> <p>গ্রন্থাগারিক রাসেল হোসাইন জানান, স্মৃতিকেন্দ্রে যদি কবির স্মৃতিবিজড়িত জিনিসপত্র যেখানে আছে সেগুলো সংগ্রহ করে রাখা যেত তাহলে  আরো বেশি দর্শনার্থীর সমাগম ঘটত এবং নজরুল সম্পর্কে মানুষ আরো বেশি বেশি জানতে পারত।</p> <p>নজরুল ত্রিশালের নামাপাড়ায় শুকনিবিলের নিকটে যে বটগাছে চড়ে বাঁশি বাজাতেন সেই বটগাছের পাশেই শুকনিবিলের মাঝে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে কবির নামে বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। নজরুলের সাহিত্যকর্মের ওপরে গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে “নজরুল ইন্সটিউট”।<br /> বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড.মোহীত উল আলম বলেন, প্রতিবছর নজরুলের জন্মজয়ন্তীতে তিনদিন ব্যাপী নজরুল জন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠান পালন করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের “গাহি সাম্যের গান” মুক্তমঞ্চে । জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৭তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষ্যে নজরুল গবেষণা ও নজরুল সঙ্গীতে অবদানের জন্য এবার তিনজন গুণী ব্যক্তিকে ‘নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় সম্মাননা’ প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই লক্ষ্যে তিনজন গুণী ব্যক্তির নামের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। গবেষণায় অবদান রাখার জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হক, সঙ্গীতে অবদান রাখার জন্য শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল এবং বাংলাদেশের বাইরে নজরুল গবেষণায় অবদান রাখার জন্য ভারতের আজহারউদ্দীন খান’কে ‘নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় সম্মাননা- ২০১৬’ প্রদান করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।<br /> এছাড়াও কাজীর শিমলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কবির স্মৃতি রক্ষার্থে পাঠাগার । এ্টা দুইতলা বিশিষ্ট । ইহা দেখাশুনার জন্য গ্রন্থাগারিকসহ চারজন  রয়েছেন ।<br /> তৎকালীন দরিরামপুর হাইস্কুলের বর্তমান নাম নজরুল একডেমি। এখানে একটি নজরুল মঞ্চ ও একটি নজরুল ডাক বাংলো রয়েছে। প্রতিবছর নজরুলের জন্মজয়ন্তীতে তিনদিন ব্যাপী নজরুল বইমেলাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় । সারা দেশ থেকে এখানে দর্শকের আনাগোনা ঘটে। ত্রিশালে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করে এই তিনদিন।<br />  নজরুল ত্রিশাল থেকে চলে যাওয়ার নির্দিষ্ট কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায়না। কেউ কেউ মনে করেন নজরুল সপ্তম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণিতে প্রথম কি দ্বিতীয় হয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ফারসি বিষয়ে আটানব্বই পেয়েছিলেন নজরুল। অধিকাংশ শিক্ষার্থীই ফেল করেছিলেন ফারসি বিষয়ে। তাই প্রধান শিক্ষক গ্রেস মার্ক দিয়ে পাশ করে দিতে বললে নজরুলও গ্রেস মার্ক দাবি করেন। মার্ক না পেয়ে নজরুল বলেন, যে স্কুলে ন্যায় বিচার নেই, সেই স্কুলে নজরুল পড়বে না। এই ঘটনার দুই দিন পরে নজরুল ও আবুল হোসেন ময়মনসিংহে যান। সন্ধ্যা নাগাদ আবুল হোসেন ফিরে এলে নজরুল আর আসেননি।</p>