<p>‘ঘরবাড়ি আছিন না ভালাই আছলাম, এইনো হেইনো থাকতাম। যেনো রাইত অইতো হেইনোই থাকতাম। কিন্তু সরকার আমারারে দলিলসহ ঘর দিয়া আশ্রয় দিছিন। অহন ওতো দিন পর তারার (প্রভাবশালী) জায়গা দাবি কইর‌্যা চুলের মুডি ধইর‌্যা মারধর কইর‌্যা ঘর ভাইঙ্গা রামদার ডর (ভয়) দেহাইয়া জোর কইর‌্যা বাইর কইর‌্যা দিছে। অহন কই যাইয়াম?’ এই বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন বৃদ্ধা মনোয়ারা বেগম (৭০)।</p> <p>গতকাল বুধবার (৭ আগস্ট) বিকেলে এমন দৃশ্য দেখা যায় ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার আঠারবাড়ি ইউনিয়নের বেহেত্তরী গ্রামে একটি সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পে।</p> <p>ওই স্থানের প্রভাবশালী দুই ভাই ও তার দলবল রামদা ও লাঠিসোঁটা নিয়ে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলোতে হামলা চালিয়ে দরজা-জানালা ও রান্নাঘর ভেঙে দেয়। ভয়ে বাসিন্দারা চলে যান। খবর পেয়ে গতকাল বুধবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে বেহেত্তেরী গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, আশ্রয়ণের কয়েকজন বাসিন্দা ঘরের নানা আসবাবপত্র, স্টোভ, গ্যাস সিলিন্ডার, শোয়ার চৌকি ইত্যাদি বের করে নিয়ে যাচ্ছে।</p> <p>আশ্রয়ণের একটি ঘরের বাসিন্দা মো. নুরুল ইসলাম ফকিরকে (৭৫) বিষণ্ণ মনে ঘরের বারান্দায় বসে থাকতে দেখা যায়। জানতে চাইলে নুরুল ইসলাম ফকির জানান, তিনি দুপুরের খাবার খেতে বসেছিলেন। ওই সময় হঠাৎ করে বেহেত্তরী গ্রামের কিছু লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে এসে তাদের ঘরগুলোতে ভাঙচুর চালাতে শুরু করে। হামলাকারীরা বলে, এখান থেকে তোদের আজই চলে যেতে হবে। না হলে তোদের খবর আছে। পরে তিনি শোয়ার চৌকি বাইরে নিয়ে যান। গ্যাসের সিলিন্ডার ও চুলা বারান্দায় এনে রাখেন। ঘরের আরো জিনিসপত্র গোছাচ্ছেন।</p> <p>নুরুল ইসলাম ফকির আরো বলেন, ‘সরকার আমাদের ঘর ও জমির দলিল দিয়েছে। এখন ভয়ে মাথার ছাদটা হারাতে হচ্ছে।’</p> <p>মনোয়ারা খাতুন নিজের ঘরের আসবাবপত্র অটোরিকশায় তুলছিলেন। আশ্রয়ণের সরকারি ঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পাশের বাড়ির দুইজন আইয়া কয় এইসব ঘর বলে তারার জায়গায় অইছে। তারার কাছে বলে দলিল আছে। পরে আমরা দলিল দেহাইলে কয় এইডি ঠিক না। জোর কইর‌্যা নিয়া ছিইর‌্যালতো চাইছে। পরে আমরাই পিছাইয়া যাই। ঘরের মালামাল পুইরালবো এই ডরে যাইতাছি গা। কই যাইয়াম কইতাম পারি না।’</p> <p>আনোয়ারা খাতুন নামে এক নারী জানান, সরকার আমাদের মাথার ওপরে একটা ছাতি দিছিল কিন্তু অহন এইডাইও নাই। অহন আবার ভবঘুরে হয়ে পড়লাম।</p> <p>জানা যায়, নান্দাইল-আঠারবাড়ি সড়কের পাশে বেহেত্তরী গ্রামে সারিবদ্ধ সুন্দর ৮টি ঘর। ওইসব ঘরে রয়েছে কমপক্ষে ৩০ জন সদস্য। তাদের অধিকাংশ কাজের সন্ধানে পাশে রেলস্টেশন কুলিগিরি বা দিনমজুর হিসেবে কাজ করে। আবার নারীরার বিভিন্ন কাজে বাইহরে থাকেন। অনেকে বিকেলে এসে দেখেন তাদের বসত ঘর ভাঙাচোরা। ঘরের টিনের চাল এদিক-সেদিক পড়ে রয়েছে। ঘরের ভেতরের মালামালও পাশের ফসলি ক্ষেতে পড়ে রয়েছে। তা দেখে অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। বৃদ্ধ ও শিশুদের নিয়ে তারা কোথায় যাবেন তা ভেবে পাচ্ছেন না।</p> <p>গ্রামে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যে জমিতে আশ্রয়ণের ঘর তোলা হয়েছে, সেটি ছিল খাসজমি। ওই জমি ভোগ করতেন ফজলুল কাদির ও ফখরুল ইসলাম। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হওয়ার পর তারা গতকাল বুধবার এসে সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পে হামলা চালান বলে অভিযোগ। অনেক ঘরের দরজা-জানালা ভেঙে দেওয়া হয়। একটি ঘরের বারান্দা ভেঙে মাটিতে ফেলে দেওয়া হয়। বাসিন্দাদের রান্নাঘর ও শৌচাগার ভেঙে ফেলা হয়। এ ছাড়া ঘরের সামনে দেওয়া টিনের বেড়াও ভেঙে দেওয়া হয়। কিছু গাছপালা কেটে ফেলা হয়। অভিযুক্ত ফখরুল ইসলামকে বাড়িতে পাওয়া যায়নি।</p> <p>ফজলুল কাদিরকে ভাঙচুরের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘আমার জমিতে সরকার জোর করে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর করেছে। তহন কিছু কইতাম পারছি না। অহন এই জমি ফেরত পাওয়ার জন্য বাসিন্দাদের ঘর খালি করে চলে যেতে কইছি।’ এ সময় এখানে এসে এক যুবক বলেন, ‘আপনেরা সাংবাদিক না? এইডা আপনেরার কাম না। উল্ডাপাল্ডা লেহুইন না যে।’</p> <p>পরে জানা যায়, ওই যুবকের নাম সাগর। তিনি প্রভাবশালী ফজলুল কাদেরের ছেলে। তিনিই তার দলবল নিয়ে রামদা ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালান। এই কথা তিনি দম্ভোক্তি করে স্বীকারও করেছেন।</p>