<p>মো. জোবায়ের (১৫), জামান মিয়া (১৭) ও হুমায়ুন কবির (২০)। তিনজনের বাড়ি ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার ভিন্ন গ্রামে। তারা তিনজনই জীবিকার তাগিদে ঢাকা ও নরসিংদীতে কাজ করতো। তাদের মধ্যে দুজন দোকানের কর্মচারী ও আরেকজন একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতো। হতদরিদ্র ওই তিনজনই মাস শেষে আয়ের একটা অংশ বাড়িতে পাঠাতো, চলতো সংসার। কিন্তু এখন আর তাদের আয় বাড়িতে আসবে না। গত ২০ ও ২১ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনটি তাজা প্রাণ ঝরে যায়। এরপর হাসপাতাল ও সড়কের পাশে পড়ে থাকা লাশ উদ্ধার করে বাড়িতে এনে তড়িঘড়ি দাফন করা হয়। ভয়-আতঙ্ক ও ঝামেলা এড়াতে তিন পরিবারের কেউ-ই এখন মুখ ফুটে বিচার চাচ্ছেন না। তবে চাপা ক্ষোভ ও কষ্ট নিয়ে সময় যাচ্ছে মায়েদের, কান্না থামাতে পারছেন না কেউ। </p> <p>স্থানীয় সূত্র ও পরিবারের লোকজন জানায়, নান্দাইল উপজেলার সদর ইউনিয়নের সাভার পূর্বপাড়া গ্রামের মো. হাবিবুর রহমানের ছেলে মো. হুমায়ুন কবির। জীবিকার তাগিদে গত প্রায় চার বছর ধরে গাজীপুরের সাইনবোর্ডের ভুষির মেইল মেম্বারবাড়ি এলাকায় একটি মুদির দোকানে কর্মচারীর কাজ শুরু করেন। স্ত্রী ও একমাত্র শিশুসন্তানকে নিয়ে ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন। কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে গত ২০ জুলাই তিনি দোকানের ভেতরেই ছিলেন। দোকানের মালামাল নিয়ে ভ্যান আসতেই ভ্যানচালক গুলিতে আহত হন। এ সময় হুমায়ুন দোকান থেকে বেরিয়ে আসেন। তিনিও গুলিবিদ্ধ হন। পরে আহত অবস্থায় হুমায়ুনকে একটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে তিনি সেখানে মারা যান। পরদিন লাশ বাড়িতে এনে দাফন করা হয়। জানা যায়, নিহতের স্ত্রী আয়েশা আক্তার সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। ছেলে হারিয়ে মা ফরিদা খাতুন এখন পাগলপ্রায়। তার কান্না থামাতে পারছেন না কেউ। </p> <p>একই উপজেলার চন্ডীপাশা ইউনিয়নের চামারুল্লাহ গ্রামের মো. আজিজুল ইসলাম কুসুমের ছেলে মো. জোবায়ের ঢাকার যাত্রাবাড়ি এলাকায় একটি দোকানের কর্মচারী ছিল। গত প্রায় দুই বছর ধরে সেখানেই বসবাস করতো। হতদরিদ্র বাবা-মাকে মাস শেষে কিছু টাকা পাঠাতো। গত ২০ জুলাই দুপুরের পর প্রতিদিনের মতো তিনি খাবার খেতে পাশেই মালিকের বাসায় যাচ্ছিলেন। এ সময় যাত্রাবাড়ী ব্রিজের নিচে যেতেই বেশ কয়েকটি গুলি লাগে তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায়। এতে ঘটনাস্থলেই সে মারা যায়। খবর পেয়ে পরিবারের লোকজন রাতেই সড়কের পাশে থাকা লাশ উদ্ধার করে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যান। মা নাসিমা আক্তার সন্তান হারিয়ে এখন দিশেহারা। এখন তিনি শুধু কান্না করেন।</p> <p>উপজেলার জাহাঙ্গীরপুর ইউনিয়নের দেউলডাংরা গ্রামের মো. শহিদুল ইসলামের ছেলে মো. জামান মিয়া গত প্রায় পাঁচ বছর ধরে নরসিংদী সদরের একটি ডাইং কারখানায় কাজ করছিল। কোটা সংস্কার আন্দোলন চলার সময় গত ২১ জুলাই জামান মেস থেকে খেয়ে দেয়ে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কারখানার দিকে রওনা হয়। সড়ক পাড় হয়ে কারখানার ফটকের দিকে এগিয়ে যাবার সময় তার পেটের বামপাশ দিয়ে গুলি ঢুকে ডানপাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। সে দেড় ঘণ্টা ধরে সড়কে পড়ে ছিল। পুলিশ বা সাধারণ মানুষ কেউ এগিয়ে যায়নি। পরে খবর পেয়ে নরসিংদীতে অবস্থানরত আত্মীয়-স্বজনরা জামানকে উদ্ধার করে নরসিংদী সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। সংকটাপন্ন অবস্থায় তাকে ঢামেক হাসপাতপালে পাঠানো হয়। সেখানে অস্ত্রোপচারের চারদিন পর ২৫ জুলাই সকালে জামান মিয়ার মৃত্যু হয়। ওই দিন রাতেই লাশ বাড়িতে এনে গভীর রাতে দাফন করা হয়। ছেলের এই অকাল মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না মা মিনারা বেগম। </p> <p>গত তিন দিনে নিহত তিনজনের বাড়িতে গেলে দেখা যায়, তিন মায়-ই সন্তান হারিয়ে শয্যাশায়ী। তারা কেবল কান্নাই করে যাচ্ছেন। গুরুতর অসুস্থ হওয়ায় পরিবারের লোকজন মায়েদের নিয়ে শঙ্কায় আছেন। এই কয়দিনে কেউ তাদের খোঁজখবর নিতে আসেননি। গ্রামের লোকজন জানান, এমনভাবে তিনটি তাজা প্রাণ চলে যাওয়ায় তারা খুবই মর্মাহত। সরকারের কাছে তাদের দাবি, নিহতের পরিবারের খোঁজ-খবর নিয়ে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হোক।</p>