<p style="text-align: justify;">দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলা খুলনা দেশের অন্যতম প্রধান জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা অঞ্চল। তাই স্বভাবতই, খুলনার একেবারে দক্ষিণে অবস্থিত কয়রা উপজেলা প্রায়ই বৈরী আবহাওয়ার কবলে পড়ে। এবার ঘূর্ণিঝড় রিমালের কবলে পড়ে বিধ্বস্ত হওয়া খুলনার কয়রা উপজেলার উপকূলের ভিটে মাটি রক্ষায় মানুষের সময় কাটছে এখন বাঁধে। খেয়ে না খেয়ে কষ্টের মধ্যে থেকেও তারা দিন পার করছেন ভাঙণ কবলিত বাঁধ মেরামত ও ঝূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বেঁড়িবাধ উঁচু করতে। </p> <p style="text-align: justify;">জোয়ার ঠেকাতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বেড়িবাঁধে স্বেচ্ছাশ্রমে মাটি দিয়ে উঁচু করছেন এলাকাবাসী। নিজেদের ভিটেমাটি রক্ষার শেষ চেষ্টা এটি।  দুই দিনের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েও আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই স্থানীয় জনগণ বাঁধের স্থানে হাজির হন। </p> <p style="text-align: justify;">এলাকার মসজিদের মাইকে এলাকাবাসীকে ঝুড়ি আর কোদাল নিয়ে বাঁধে আসার আহ্বান জানানো হয়। নিজেদের ভিটেমাটি রক্ষার তাগিদে ভাঙা বাঁধের কাছে কোদাল হাতে জড়ো হতে শুরু করেন হাজারো মানুষ। নদীতে ভাটার টানে পানি নামতে শুরু করলেই শুরু হয় কাজ। দুপুরে নদীতে জোয়ার আসার আগ পর্যন্ত একটানা মাটি কেটে, বস্তায় বালু ভরে, বাঁশ পুঁতে, বাঁধ উঁচু করার চেষ্টা চলছে। </p> <p style="text-align: justify;">পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ১৩/১৪-২ নম্বর পোল্ডারের আওতাধীন খুলনার কয়রা উপজেলার দশহালিয়া এলাকায় গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা যায়। তবে শুধু দশহালিয়া গ্রামেই নয়, কপোতাক্ষ ও কয়রা নদীবেষ্টিত কয়রা উপজেলার মহেশ্বরীপুর, শিকারিবাড়ি, বাবুরাবাদ, নয়ানী, সিংয়েরচক, ৪ নং কয়রা, ৬ নং কয়রা, মদিনাবাদ, সুতিয়া বাজার, পাথরখালী, কালীবাড়ি, আংটিহারা, গোলখালী, জোড়শিং, চরামুখা, হরিণখোলা, গ্রামেও স্থানীয় চেয়ারম্যানদের সহযোগিতায় স্বেচ্ছাশ্রমে বাধ উঁচু করতে কাজ করছেন। উঁচু জোয়ার ঠেকাতে রিমালে ক্ষতিগ্রস্ত বেঁড়িবাধ মেরামতে দিন রাত স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ শুরু করেছেন গ্রামের নারী-পুরুষরা। রাস্তায় দিয়েছেন উঁচু দেয়াল।  <br /> কয়রার মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা রাজা গাজি বলেন, আমরা ঝড়ের পূর্বাভাস পাওয়ার পর থেকে এলাকার লোকজন বাঁধ থেকে যায়নি। যে যে ভাবে পারছি দুর্বল বাঁধ উঁচু করার চেষ্টা করেছি। আমাদের ভিটেমাটি-সম্পদ রক্ষা করতে এই চেষ্টা। ইউনিয়নে ৭ টি পয়েন্ট দিয়ে পানি প্রবেশ করলেও এলাকাবাসি পানি আটকাতে সক্ষম হন। </p> <p style="text-align: justify;">কয়রা সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এস এম বাহারুল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজের কোনো স্বচ্ছতা নেই। কোথায় কাজ করে কি কাজ করে কত টাকার কাজ করে না জানে স্থানীয় প্রশাসন না জানে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি। তারা বার বার নিজেদের পছন্দের ঠিকাদার দিয়ে দায় সারা কাজ করে যায়। আর জনগণ স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে গ্রামের বাঁধ রক্ষায় জীবন প্রাণ দিয়ে কাজ করে যায়।’</p> <p style="text-align: justify;">খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে কয়রার মহারাজপুর, মহেশ্বরীপুর, বাগালী, আমাদী, কয়রা সদর, উত্তর ও দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের ১৭ স্থানে পাউবোর বেড়িবাঁধ উপচে ও ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢোকে। সকালে নদীতে জোয়ার শেষ হলে স্থানীয়রা সেসব স্থানে মেরামত করে। দশহালিয়া নামক স্থান দিয়ে শুধু লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। </p> <p style="text-align: justify;">সংশ্লিষ্ট সূত্রে ও স্থানীয়দের  সাথে কথা বলে  জানা যায়, প্রতি বছরই তারা ভাঙনের কবলে পড়েন। প্রতি বছর বাঁধ বেধে এখন ভিটেমাটি রক্ষায় জীবনবাজি রেখে স্বেচ্ছায় বাঁধ নির্মাণে আরো অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তারা। সেইসঙ্গে স্বেচ্ছায় বাঁধ নির্মাণের ফাঁকেই পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়। </p> <p style="text-align: justify;">গত ২৬ মে  কয়রার দশহালিয়া এলাকায় ভেঙে যাওয়া ১০০ মিটার জায়গা মেরামত চলছে স্বেচ্ছাশ্রমে। দশহালিয়া ও উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় জরুরি কাজ দেখিয়ে নাম মাত্র সেখানে জিও ব্যাগ, গানি ব্যাগ, সিনথেটিক ব্যাগ, বাঁশ ও জিও ফেব্রিক সরবরাহ করে পাউবো। <br /> এতেই পাউবোর খরচ ১০-১৫ লাখ টাকা। শুধু দহালিয়ায় খরচ ৫ লক্ষ। অন্যদিকে, বাঁধ ভাঙে, স্বেচ্ছায় কাজ করে হতাশায় ডোবে মানুষ। এ এলাকায় ১ কিলোমিটার জায়গায় বাঁধের জন্য ১ কোটি ৩০ লাখ টাকারও বেশি অর্থের চাহিদা যাচ্ছে মন্ত্রণালয়ে। </p> <p style="text-align: justify;">এদিকে কয়রার নাগরিক নেতারা বলেন, গত ১০ বছরে জরুরি কাজের নামে কয়রায় বেড়িবাঁধ সংস্কার ও নির্মাণ বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে ১৪৫ কোটি টাকারও বেশি। কিন্তু তাতে প্রকৃতপক্ষে কয়রার মানুষের কোনো উপকার হয়নি। এক জায়গা বার বার ভাঙে আর বার বার দায় সারা কাজ করে। </p> <p style="text-align: justify;">কয়রা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নীশিত রঞ্জন মিস্ত্রি বলেন, একই স্থানে বারবার ভাঙা দুঃখজনক। কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণেই এই ভোগান্তি। সরকার ইতিমধ্যে ওই এলাকায় টেকসই বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। কাজও হচ্ছে তবে খুবই ধীর গতি। তবে দ্রুত স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজটি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত জনমনে স্বস্তি নেই।  </p> <p style="text-align: justify;">জোড়াতালিতেও বাঁধ সংস্কারের নামে যেটুকু কাজ হয়, সেখানেও রয়েছে আমলা-কর্মকর্তা-জনপ্রতিনিধি-ঠিকাদার মিলিয়ে সরকারি তথা জনগণের অর্থ লুটপাটের অসাধু চক্র। টেন্ডারে কাজ পেয়ে মূল ঠিকাদার নিজের লাভটা রেখে কাজটা বিক্রি করে দেন আরেকজনের কাছে। এভাবে হাতবদল হলে কাজের মান খারাপ হতে বাধ্য- এটাই দেখে এসেছি এতদিন। এবার আর এমনটি চাই না। </p> <p style="text-align: justify;">কয়রা সবুজ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক এ্যাড আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, কয়রায় নদী ভাঙনের কারণে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ ভিটেমাটি হারিয়ে রাস্তাঘাটে, পরের জমিতে কোনোরকমে আশ্রয় নেন। অনেকে আবার সর্বস্ব হারিয়ে শহর-বন্দরে পাড়ি দেন, যাদের প্রকৃত হিসাব সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের নেই। শুধু দক্ষিণ বেদকাশী নয়, উপকূলীয় এ উপজেলার প্রায় আড়াই লক্ষাধিক মানুষকে নদীভাঙনের সঙ্গে লড়াই করে বাঁচতে হয়। এখন বাঁধ মেরামতে কাটছে তাদের দিন। </p> <p style="text-align: justify;">কয়রা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, কয়রায় ঘূর্ণিঝড় রিমালের ঝোড়ো বাতাসে বিধ্বস্ত বাড়ির সংখ্যা ৩০ হাজারের মতো। ২৮ হাজার ৩৯৬টি ঘরবাড়ি আংশিক ও ১ হাজার ৬২৬টি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গাছপালা। এই সংখ্যা গণনার বাইরে। এ ছাড়া অতিবৃষ্টিতে ও কয়েক জায়গায় লোনাপানিতে তলিয়ে গেছে প্রায় ৫০০ মাছের ঘের। কৃষির ক্ষতির পরিমাণ এখনো নিরূপণ করা শেষ হয়নি।</p> <p style="text-align: justify;">কয়রার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আছের আলী মোড়ল জানান, ‘ইউনিয়নের ছোট আংটিহারা, কোবাদক থেকে ঘড়িলাল, ঘড়িলাল থেকে চরামুখা খেয়াঘাট, খেয়াঘাট থেকে হলদিবুনিয়া পর্যস্ত বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার রিমালের প্রভাবে বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে আরো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। এলাকাবাসী কিছু এলাকায় স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ উঁচু করার কাজ করছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে সিনথেটিক বস্তা দেওয়া হয়েছে। তাতে মাটি ভরে বাঁধ উঁচু করার কাজ চলছে।    </p> <p style="text-align: justify;">খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিভাগীয় উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘আমরা জনগণের সাথে থেকেই সার্বক্ষণিক তদারকি করছি। বাঁধ নির্মাণের সকল সরঞ্জামাদি আমরা সরবরাহ করছি। শ্রমিকের মজুরিও পরিশোধ করা হবে। এ কাজে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও ব্যক্তিগতভাবে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করছেন।'</p> <p style="text-align: justify;">কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তারিক উজ জামান বলেন, ব্যাপক শঙ্কা ছিল বাঁধ নিয়ে কিন্তু স্থানীয় লোকজনের সার্বিক সহযোগিতা ও স্বেচ্ছাশ্রমের ফলে বাঁধ উঁচু করায় বাঁধের ক্ষতি তুলনামূলক কম হয়েছে। ভাঙা বাঁধ অধিকাংশ বাঁধ আটকানো হয়েছে। দশহালিয়া স্থানে বাঁধ আটকানোর কাজ চলছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের তালিকা তৈরি করছে। দ্রুত তারা কাজ শুরু করবেন। </p> <p style="text-align: justify;">ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান তিনি।</p>