<p style="text-align: justify;">‘শুনতিছি ঘূর্ণিঝড় রিমাল আসতিছে। আগে চার-পাঁচবার বাঁধ ভেঙে আমরা সব ভাইসে পুড়ে গেছি। বাচ্চা-গাচ্চা নিয়ে খুবই দুরবস্থা থাকতি হুইছে। এখানে শুধু চিংড়ি হয়, তা-ও ভেসে যাওয়ায় সবাই পথে বসিছে। যেই একটু কাছে কিছু টায়্যা পয়সা গুছাই ভালোভাবে দুবেলা বউ-বাচ্চা নিয়ে  চলতি পারি, একটু উন্নতির দিক যাই। সেই বাঁধ ভেঙ্গি আমাদের সব শেষ কুরি দেয়। কিন্তু বাঁধ কেউ টেকসই  বান্দে না।’</p> <p style="text-align: justify;">এভাবেই নিজেদের দুরবস্থার কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন খুলনা কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি  ইউনিয়নে গোলখালী গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ লোকমান আলী। </p> <p style="text-align: justify;">তিনি বলেন, ‘আইলার পর ১৫ বছর চলে গেলেও এখনো চারপাশে কপোতাক্ষ, শাকবাড়িয়া ও আড় পাঙ্গাশিয়া নদীবেষ্টিত দক্ষিণ বেদকাশির মানুষকে বাঁচাতে কোনো স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হয়নি। তবে কাজ চলছে শুনছি টেকসই বেঁড়িবাধের, তা কবে দেখতি পাব কে জানে। নদীতে পানি বাড়ার ভয়ে নদীভাঙনের আতঙ্কে ঘূর্ণিঝড়ের খবর পেলেই রাতে ভাঙন আতঙ্কে ঘুমাতে পারি নে।’ </p> <p style="text-align: justify;">শুধু লোকমান আলীর একাই নির্ঘুম রাত কাটাই না, এই উপকূলীয় মানুষের একই অবস্থা। টেকসই বেড়িবাঁধ না থাকায় কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদীর তীরবর্তী বাসিন্দাদের আতঙ্ক বিরাজ করছে। স্বাভাবিকের তুলনায় জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় উপকূলের ওয়াপদা ও বেড়িবাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়ার ভয় পেয়ে বসে। বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কায় উপকূলের লাখ লাখ মানুষের নির্ঘুম রাত কাটছে।</p> <p style="text-align: justify;">স্থানীয় দক্ষিণ বেদকাশি  ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আছের আলীও জানালেন হতাশার কথা। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, যেখানে ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ, সেখানে কাজ না করে ভালো জায়গায় কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। আমার ইউনিয়নে ১৪ কিলোমিটার মধ্যে ৫ কিলোমিটার বাঁধ জরাজীর্ণ। ইউনিয়নের গোলখালী থেকে কোবাদক, কোবাদক থেকে ঘড়িলাল, ঘড়িলাল থেকে চরামুখা খেয়াঘাট, খেয়াঘাট থেকে হলদিবুনিয়া পর্যন্ত বেশি ঝুঁর্কিপূর্ণ। বড় কোনো দুর্যোগ হলেই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গোটা ইউনিয়ন প্লাবিত হবে।</p> <p style="text-align: justify;">তিনি বলেন, অবকাঠামোগত যত উন্নয়নই হোক না কেন, প্রতিবছরই বাঁধ ভেঙে সব ম্লান হয়ে যাচ্ছে। ইউনিয়নে ৩২ হাজার মানুষ বসবাস করে। অথচ সাইক্লোন শেল্টার আছে মাত্র ৯টি। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, দক্ষিণ বেদকাশিতে ১১০০ কোটি টাকার মেগাপ্রকল্পের কাজ চলছে। পর্যায়ক্রমে ওই ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায়ও কাজ করা হবে।</p> <p style="text-align: justify;">শাকবাড়িয়া নদীর তীরবর্তী ছোট আংটিহারা গ্রামের বাসিন্দা আবু সাঈদ খান বলেন, শাকবাড়িয়া নদীর তীরবর্তী মানুষ ঘূর্ণিঝড়ের বার্তা পেয়ে গভীর রাত থেকে আতঙ্ক বিরাজ করে এবং নির্ঘুম রাত কাটে। এ ছাড়া বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষা দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের পূর্ব দিকে শাকবাড়িয়া, মাঝখানে দক্ষিণে আড় পাঙ্গাশিয়া ও পশ্চিম দিকে কপোতাক্ষ নদী। এ কারণে ঘূর্ণিঝড়ের খবর পেলেই আতঙ্কে স্থানীয়দের নির্ঘুম রাত কাটে।</p> <p style="text-align: justify;">খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলায় ১৫৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। ঝুঁকিতে থাকা স্থানগুলো হচ্ছে- সদর ইউনিয়নের মদিনাবাদ লঞ্চঘাট থেকে গোবরা পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার, হরিণখোলা-ঘাটাখালী এলাকায় এক কিলোমিটার, ৬ নম্বর কয়রা এলাকায় ৬০০ মিটার, ২ নম্বর কয়রা এলাকায় ৫০০ মিটার, মহারাজপুর ইউনিয়নের মঠবাড়ী-দশহালিয়া এলাকায় দুই কিলোমিটার, উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের কাটকাটা থেকে শাকবাড়িয়া গ্রাম পর্যন্ত এক কিলোমিটার, কাশিরহাটখোলা থেকে কাটমারচর পর্যন্ত ৭০০ মিটার, পাথরখালী এলাকায় ৬০০ মিটার ও মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের শেখেরকোনা, নয়ানি, শাপলা স্কুল, তেঁতুলতলার চর ও চৌকুনি এলাকায় তিন কিলোমিটার। মহারাজপুরের পবনা নামক স্থানে ৬০০ মিটার স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে নদীতে পানি বাড়লে এসব এলাকায় পানি ঢুকে জনজীবন বিপর্যন্ত করতে পারে। </p> <p style="text-align: justify;">মহারাজপুর ইউনিয়নের পবনা এলাকার রাধা রানী জানান, ভাঙন আতঙ্কে প্রতিনিয়ত ছেলেমেয়ে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতে হয় তাদের। স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ না করায় আইলার পর প্রায় দুই বছর ধরে জোয়ারভাটা খেলে। এতে তাদের সব কিছু শেষ হয়ে গেছে। পরে সাময়িকভাবে সংস্কার করা হলেও বর্তমানে যে অবস্থা, তাতে বাঁধ ভেঙে আবারও প্লাবিত হতে পারে গোটা ইউনিয়ন।</p> <p style="text-align: justify;">স্কুল শিক্ষার্থী সাইদুল কবির জানায়, ‘বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় প্রতিবছরই তাদের স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। এতে পিছিয়ে পড়ছে তারা। সে বলে, ‘আমরা আর ডুবতে চাইনে। আমরা আর নির্ঘুম রাত কাটাতে চাইনে।’</p> <p style="text-align: justify;">অতীতের তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর সেই ভয়াল ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে আঘাত হেনেছিল। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডর নামে আরো একটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলা, ২০১৬ সালের ২১ মে রোয়াণু, ২০১৭ সালের ৩০ মে মোরা, এরপর মহাসেন, ২০১৯ সালের ২ মে ফণী, ২০২০ সালের ২০ মে আম্ফান, মোখা, হামুনসহ অতীতের ঘূর্ণিঝড়ে কয়রা উপকূলীয় অঞ্চলে মানুষের প্রাণহানিসহ গবাদি পশুর ব্যাপক ক্ষতি হয়।</p> <p style="text-align: justify;">পাউবোর খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম বলেন, কয়রা বেড়িবাঁধের অনেক কাজ ইতিমধ্যে হয়েছে, চলমানও আছে। কয়রার ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের তালিকা করা হয়েছে। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় কাজ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কয়েক জায়গায় কাজও চলছে। বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ না এলে কয়রা শঙ্কামুক্ত। বেড়িবাঁধে মেগাপ্রকল্পের কাজ চলছে, ওটা শেষ হলে কয়রা বেড়িবাঁধের ঝুঁকি একেবারেই কমে যাবে।</p> <p style="text-align: justify;">উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বি এম তারিক-উজ-জামান বলেন, ঘূর্ণিঝড় রিমালের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে উপকূলের বাসিন্দাদের জন্য সব ধরনের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়েছি এবং সবাইকে নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে আসার জন্য মাইকিং করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে আশ্রয়কেন্দ্র খুলে দেওয়ার পাশাপাশি নিরাপত্তায় প্রস্তুত রয়েছে পুলিশ বাহিনী ও চিকিৎসাসেবায় মেডিক্যাল টিম। ইতিমধ্যে নতুন করে কয়েকটি সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পর্যায়ক্রমে আরো সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করা হবে-চাহিদা পাঠানো হয়েছে। </p> <p style="text-align: justify;">তিনি বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডকেও দ্রুত বাঁধগুলো সংস্কারের নির্দেশনা দিয়েছি ও তাদের ঘূর্ণিঝড় রিমাল মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। <br />  </p>