<p>এক মাস আগেও সড়কের দুই পাশের গাছগুলোর ছায়াতলে মানুষ বিশ্রাম নিত। স্বস্তিতে চলাচল করত পথচারীরা। এখন সেখানে তীব্র দাবদাহের কারণে যেন মরুভূমির রূপ ধারণ করেছে। টাকার জন্য যেন আর গাছ কাটা না হয়―এমন আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের সাঁওতা গ্রামের মোস্তাক শাহরিয়ার। তিনি কুষ্টিয়া পলিটেকনিক ইনিস্টিটিউটের প্রথম বর্ষের ছাত্র। রাজিব নামের আরেক ছাত্র বলেন, ‘যেহেতু গাছগুলো আমাদের ছায়া দিচ্ছে, সড়কের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করছে, পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা করছে, সেহেতু গাছগুলো না কাটলে ভালো। তাঁর ভাষ্য, গাছপালা কমে যাওয়ার কারণেই বৃষ্টিপাত হচ্ছে না, তীব্র দাবদাহ চলছে।’ এ জন্য গাছ না কাটার জোর দাবি করেন তিনি।</p> <p>খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার লাহিনীপাড়া থেকে সান্দিয়ারা পর্যন্ত পানি উন্নয়ন বোর্ডের খাল ঘেঁষে প্রায় ২০ কিলোমিটার পাকা সড়ক রয়েছে। এই সড়কে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির আওতায় সমিতির মাধ্যমে ১০ বছর আগে কয়েক হাজার ফলদ ও বনজ গাছের চারা রোপণ করেছিল উপজেলা বন বিভাগ। দরপত্রের মাধ্যমে গত বছর যদুবয়রা থেকে সান্দিয়ারা পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার সড়কের আনুমানিক প্রায় ১০ হাজার গাছ কাটা হয়েছে। চলতি বছরেও ওই সড়কের লাহিনীপাড়া থেকে বাঁধবাজার পর্যন্ত তিন কিলোমিটার সড়কের প্রায় তিন হাজার গাছ কাটা হয়েছে।</p> <p>সম্প্রতি বাঁধবাজার থেকে মাদুলিয়া পর্যন্ত তিন কিলোমিটার সড়কে আরো তিন হাজার গাছ কাটার জন্য গাছের গায়ে নাম্বারিং করে দরপত্র সম্পন্ন করেছেন বন বিভাগের কর্মকর্তারা। তবে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও সড়কের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য গাছগুলো না কেটে বরং সুরক্ষার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় জনগণ, জনপ্রতিনিধি ও সাধারণ পথচারীরা।</p> <p>সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জিকে খালের লাহিনীপাড়া এলাকায় সড়কের ধারে সবুজের নয়নাভিরাম দৃশ্য আর নেই। কাটা গাছগুলোর গোড়া ও কিছু অংশবিশেষ পড়ে আছে। চাপড়া ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় এলাকার খালের পাকা ও কাঁচা সড়কের দুই পাশে মেহগনি, বাবলা, কড়াইসহ নানা জাতের কয়েক হাজার বড় বড় গাছ রয়েছে। সেগুলোর গায়ে নাম্বারিং করা। ওই সড়কে নিয়মিত চলাচল করেন ভ্যানচালক আব্দুল হাকিম। তিনি বলেন, ‘নিয়মিত ওই সড়ক দিয়ে মালামাল ও যাত্রী নিয়ে চলাচল করি। প্রায়ই সড়কে পাশের গাছের ছায়ায় বসে ক্লান্তি দূর করতে বিশ্রাম নিই। গাছগুলো কেটে ফেলা হলে আর বসতে পারবো না।’ </p> <p>নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চাকরিজীবী বলেন, আগে মানুষের মঙ্গলের বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়ে তারপর গাছ কর্তনের বিষয়ে অগ্রসর হওয়া উচিত। নাম প্রকাশ না করা শর্তে আরেক চাকরিজীবী দুঃখ প্রকাশ করে জানান, গাছগুলো যেহেতু সড়ক নির্মাণকাজে ও মানুষের চলাচলে সমস্যা করছে না, সেহেতু শুধু টাকার জন্য কেন কাটা হবে? নির্বিচারে গাছ কাটার কারণেই প্রকৃতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তিনি গাছ রক্ষার জোর দাবি জানান।</p> <p>উপজেলা বন বিভাগ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, আর্থ-সামাজিক ও মানুষের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০০৪ সাল থেকে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে বন বিভাগ। তারা প্রথমে স্থানীয়দের নিয়ে এলাকাভিত্তিক সমিতি গঠন করে। পরে বিভিন্ন সড়কের ধারে জ্বালানি কাঠের গাছের চারা রোপণ করে। গাছ দেখাশোনা করেন সমিতির সদস্যরা। গাছের বয়স যখন ১০ বছর পূর্ণ হয় তখন গাছ কাটা ও বিক্রির জন্য দরপত্র আহ্বান করে বন বিভাগ। গাছ বিক্রির ৫৫ ভাগ টাকা পান সমিতির সদস্যরা। সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদকে দেওয়া হয় ৫ ভাগ। আর বন বিভাগ ও সড়ক সংশ্লিষ্ট বিভাগ পাই ২০ ভাগ করে টাকা।</p> <p>জনগণের গাছ রক্ষার দাবির সাথে একমত পোষণ করেছেন চাপড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এনামুল হক মঞ্জু। তিনি বলেন, সড়কের সৌন্দর্য বৃদ্ধি, ছায়া ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে গাছগুলো থাকা দরকর। তিনি বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলবেন বলেও জানান। তবে কিছু গাছ ঝড়ে ভেঙে পড়লে মানুষের ঘর-বাড়ি ও দোকানপাটের ক্ষতি হবে। সেগুলো কাটার পক্ষে তিনি।</p> <p>এ বিষয়ে পরিবেশ গবেষক গৌতম কুমার রায় জানান, ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী দেশে ২৫ ভাগ বনভূমি বা গাছপালা থাকা দরকার। কিন্তু সেই তুলনায় গাছ আছে মাত্র ৯ ভাগের কম। তবু প্রতিদিনই গাছ উজাড় হচ্ছে। যে মুহূর্তে প্রচণ্ড দাবদাহ চলছে। পানির মহাসংকট চলছে। মানুষ গরমে নাভিশ্বাস করছে। পাখিকুল আশ্রয় পাচ্ছে না। সেই মুহূর্তে গাছগুলো কাটার ঘটনা সত্যি দুঃখজনক। তাঁর মতে, ‘আমরা উন্মাদ মৃত্যুর জাতি। যে উন্মাদ মৃত্যুর মাধ্যমে আমরা শুধু ধ্বংসকেই আনন্দের সাথে গ্রহণ করি, সৃষ্টিকে না।’</p> <p>উপজেলা বন বিভাগ কার্যালয়ের কর্মকর্তা আরিফুর রহমান জানান, ১০ বছর পূর্ণ হলেই সমিতির নিয়ম অনুসারে গাছ কেটে পুনরায় নতুন চারা রোপণ করা হয়। ইতিমধ্যে ওই সড়কের ১৩ কিলোমিটার এলাকার গাছ কাটা হয়েছে। অন্য গাছগুলো দরপত্রের মাধ্যমে কাটা হবে। তাঁর ভাষ্য, আইন অনুযায়ী গাছ রক্ষার কোনো সুযোগ নেই।</p> <p>যেহেতু দাবদাহ চলছে, সেহেতু এই মুহূর্তে গাছগুলো থাকা দরকার বলে মনে করছেন কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ( ইউএনও) এস এম মিকাইল ইসলাম। তিনি জানান, বন বিভাগের সঙ্গে আলাপ করে বিধি মোতাবেক কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।</p>