<p>ঢাকা বন বিভাগের পক্ষ থেকে ৬৭ দফায় মোট ৬ হাজার ১২৮ দশমিক ১৯ একর জবর দখলকৃত সংরক্ষিত বনভূমি উদ্ধারের লক্ষ্যে জেলা প্রশাসনে উচ্ছেদ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে গত ১৭ এপ্রিল থেকে উদ্ধার অভিযান শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে ৭৫ কোটি টাকার বনভূমি উদ্ধার হয়েছে। এই প্রক্রিয়া চলমান থাকবে। উদ্ধার অভিযানে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের দখল করা ভাওয়াল রিসোর্ট রয়েছে বলে জানা গেছে। স্বেচ্ছায় দখল না ছাড়লে যেকোনো সময় অভিযান চালানো হবে।</p> <p>রবিবার (২১ এপ্রিল) গাজীপুর জেলা প্রশাসন ও ঢাকা বন বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দায়িত্বশীল সূত্র এই সংবাদ নিশ্চিত করেছে।</p> <p>ঢাকা বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক মো. সামসুল আরেফিন গণমাধ্যমকে জানান, বনভূমি উদ্ধার অভিযান শুরু করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই পৃথক অভিযানে প্রভাবশালী, হ্যাচারি, রিসোর্ট মালিকদের দখলে থাকা প্রায় ৯ একর বনভূমি উদ্ধার করা হয়েছে। এটি বনভূমি জবর দখলকারীদের কাছে একটি বার্তা। বনের জমি অবৈধ দখলে রাখা যাবে না। কেউ চাইলে নিজেরাই স্বেচ্ছায় বনের জমি ছেড়ে দিতে পারে। জবর দখলকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।</p> <p>বন বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, বেনজীর আহমেদের দখল করা বনভূমি উদ্ধারের জন্য অনেক আগেই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে উদ্যোগ নেওয়া ছিল। এখন শুধু বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তবে দখলকৃত বনভূমি উদ্ধারে দখলদারের পরিচয়কে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না,  আইনগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দখল হওয়া সকল বনভূমি উদ্ধার করা হবে বলে দাবি করে ওই সূত্র।</p> <p>প্রাপ্ত তথ্যমতে, ১৭ এপ্রিল ভাওয়াল গড়ের শ্রীপুর এলাকায় বনভূমি উদ্ধার অভিযান শুরু হয়। ঢাকা বন বিভাগ শ্রীপুরে ৩৪ বনভূমি দখলবাজের তালিকা করে জেলা প্রশাসকের জেলা কমিটির অনুমোদনক্রমে বনভূমি উদ্ধার অভিযান শুরু হয়েছে। বন বিভাগ ইতিমধ্যে পৃথক স্থানে অভিযান চালিয়ে প্রায় ৯ একর বনভূমি উদ্ধার করেছে। উদ্ধার হওয়া বনভূমির বাজারমূল্য প্রায় ৭৫ কোটি টাকা।</p> <p>১৭ এপ্রিলে শ্রীপুরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার শোভন রাংসা’র নেতৃত্বে উচ্ছেদ অভিযানে ছিলেন ঢাকা বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক মো. সামসুল আরেফিন, সহকারী কমিশনার (ভূমি) আল মামুন, বিট কর্মকর্তা মো. আলাল খান, মো. আ. মান্নান, বনি শাহাদাতসহ বিভিন্ন বিটের বন প্রহরী।</p> <p>বিষয়টি নিশ্চিত করে সহকারী বন সংরক্ষক ও শ্রীপুরের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. মোখলেছুর রহমান জানান, উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের সাইটালিয়া গ্রামে আল নূর হ্যাচারি তেলিহাটি মৌজার আরএস ৭০৩৭ দাগে ১.৪১ একর এবং ৭০৪১ দাগে ১.৩৮ একরসহ ২.৭৯ একর বনভূমি জবরদখল করেছিল। অভিযানে ৭০৩৭ দাগের ১.৪১ একর ভূমি দখল মুক্ত করা হয়। ৭০৪১ দাগের ১.৩৮ একর ভূমি আগামী তিন দিনের মধ্যে নিজেরা অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে নেবে। </p> <p>সাতখামাইর মৌজায় ফজলু হ্যাচারি আরএস ৩০৩২৪ দাগে ১.৩৫ একর বনভূমি দখল করে হ্যাচারি নির্মাণ করে। অভিযানে ওই হ্যাচারি গুঁড়িয়ে দিয়ে বনের জমি উদ্ধার করা হয়। একই দিনে বন বিভাগ তেলিহাটি ইউনিয়নের পেলাইদ গ্রামের মাটির মায়া নামক রিসোর্টে অভিযান চালাতে যায়। রিসোর্ট মালিক স্বেচ্ছায় বন বিভাগের দুই একর ভূমির দখল ছেড়ে দেয়। তিনি দাবি করেন উদ্ধার হওয়া পৌনে পাঁচ একর বন ভূমির বর্তমান মূল্য প্রায় ১৫/২০ কোটি টাকা।  </p> <p>ওই কর্মকর্তা আরো জানান, শ্রীপুরের শীর্ষ ৩৪ জন বনভূমি দখলকারীর তালিকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে দেওয়া আছে। ওই তালিকা থেকে তিনটি দখল উচ্ছেদের অনুমোদন দেওয়া হয়। ১৭ এপ্রিল বুধবার অনুমোদিত ওই তিনটি স্থানে অভিযান পরিচালনা করা হয়। বাকীগুলো পর্যায়ক্রমে অনুমোদন সাপেক্ষে উচ্ছেদ করা হবে।</p> <p>খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভাওয়াল গড়ের দুটি রেঞ্জের অধীনে প্রায় ৩০ হাজার একর বনভূমি রয়েছে। প্রভাবশালী, শিল্প মালিক, খামার মালিক, রিসোর্ট মালিক, প্রভাবশালী ব্যক্তি, শ্রমিক, দিনমজুরদের অবৈধ দখলে আছে শত শত একর বনভূমি। প্রতিটি বিটে বনের জমিতে রয়েছে হাজার হাজার বসতবাড়ি ও দোকান। এ ছাড়া বিভিন্ন শিল্প কারখানার দখলে রয়েছে শত শত একর বনভূমি। </p> <p>২০১৬ সালের এক তালিকায় দেখা যায়, ৫২ প্রতিষ্ঠানের দখলে রয়েছে বনের জমি। এর আগে ৯৫ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দখলে ছিল বনভূমি। চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি বন বিভাগ শিমলাপাড়া বিটের ফরিদপুর গ্রামের নয়নপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রায় ষাট কোটি টাকা মূল্যের চার একর বিশ শতাংশ বনের জমি উদ্ধার করে। সর্বশেষ গত ১৭ এপ্রিল সাতখামাইর বিটের তিনটি পৃথক স্থানে অভিযান চালায় বন বিভাগ। এ সময় সাইটালিয়া গ্রামের আল-নূর হ্যাচারির দখল থেকে প্রায় আট কোটি টাকা মূল্যের এক একর ৪১ শতাংশ জমি উদ্ধার করা হয়। উত্তর পেলাইদ গ্রামের মাটির মায়া রিসোর্ট থেকে প্রায় চার কোটি টাকা মূল্যের দুই একর বনভূমি উদ্ধার করা হয়। একই দিনে সাতখামাইর গ্রামের ফজলুর রহমান হ্যাচারির দখল থেকে প্রায় তিন কোটি টাকা মূল্যের এক একর ৩৫ শতাংশ বনের জমি উদ্ধার করা হয়।</p> <p>সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, গাজীপুরের সরকারি বনাঞ্চল এক শ্রেণির বনদস্যু দখল করে অবৈধভাবে নানা স্থাপনা, কলকারখানা গড়ে তুলছে। এতে একদিকে বনভূমি উজার হচ্ছে, অন্যদিকে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জলবায়ুর ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এ দখলকার্যে বন বিভাগের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করছে। গাজীপুর জেলায় জবর দখলকারীরা বন অধিদপ্তরের ঢাকা বনবিভাগ ও বন্যপ্রাণী বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন ৬ হাজার ৮৬ দশমিক ৮৪ একর সংরক্ষিত বনভূমি ইতিমধ্যে দখল করে উজার করেছে। দখলকৃত এসব জায়গায় কলকারখানা, দোকানপাট, কটেজ, রিসোর্ট, ঘরবাড়িসহ নানা স্থাপনা নির্মাণ করেছে। বনবিভাগ ৬৭ দফায় মোট ৬ হাজার ১২৮ দশমিক ১৯ একর সংরক্ষিত বনভূমি উদ্ধারের লক্ষ্যে জেলা প্রশাসনে উচ্ছেদ প্রস্তাব প্রেরণ করলেও দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা তারা নেয়নি। ফলে জবর দখলকারীরা প্রতিনিয়ত বন উজাড় বৃদ্ধি করছে। এতে গাজীপুরের ঐতিহ্যবাহী বনাঞ্চল উজাড়, জীববৈচিত্র্য বিলীন হচ্ছে, পাশাপাশি জীবন সংকটে রয়েছে উদ্ভিদ, প্রাণী ও অনুজীব জগত। এ ছাড়াও নষ্ট হচ্ছে এ অঞ্চলের পরিবেশের ভারসাম্য, ঘটছে জলবায়ূর পরিবর্তন।</p> <p>প্রসঙ্গত, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমদের দখল করা ঢাকা বন বিভাগের ৬.৭৩ একর বন ভূমিতে ভাওয়াল রিসোর্ট করা হয়েছে বলে বন বিভাগের দাবির প্রেক্ষিতে সংবাদ প্রকাশ করে দৈনিক কালের কণ্ঠ, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনসহ অসংখ্য মিডিয়া। এই জমি উদ্ধারের জন্য রাজপথে মানববন্ধন করে ভাওয়াল গড় বাঁচাও আন্দোলন নামের একটি সংগঠন। জমি উদ্ধারের জন্য আলটিমেটামও দেয় এই পরিবেশবাদী সংগঠন। একই দাবিতে রবিবার (২১ এপ্রিল) গাজীপুর পরিবেশ আন্দোলন নামের আরেকটি সংগঠন মানববন্ধন করে জবরদখল উচ্ছেদের দাবি জানায়।</p>