<p style="text-align: justify;">গত ছয় মাসের মধ্যে মাত্র এক দিন ৯ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে রাজশাহীতে। সেটিও গত মার্চে। এর আগে গত সেপ্টেম্বরে ভারি বৃষ্টিতে আকস্মিক বন্যা হয়ে যায়। এরপর আর ভারি বৃষ্টির দেখা মেলেনি। বলা যায়, টানা বৃষ্টিহীন থাকায় মাঠ-ঘাট ফেটে চৌচির অবস্থা বিরাজ করছে। </p> <p style="text-align: justify;">এদিকে গত কয়েক বছর ধরে রাজশাহী অঞ্চলে অব্যাহতভাবে নামছে পানির স্তর। পানির অভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে গভীর সাবমার্সিবল পাম্পও। ফলে বিশুদ্ধ পানির সংকটও দেখা দিয়েছে রাজশাহী অঞ্চলে। এতে গরমের মাত্রা আরো বাড়ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। রাজশাহীতে এখন বইছে মাঝারি তাপপ্রবাহ। তীব্র গরমে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে জনজীবন। অস্বস্তিকর আবহাওয়ায় জ্বর, ডায়রিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। </p> <p style="text-align: justify;">বুধবার সকাল থেকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ১০, ২৪ ও ২৬ নম্বর ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, গরমে অনেক শিশু ডায়রিয়া, হাঁপানি ও জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। এ ধরনের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে প্রতিদিন।</p> <p style="text-align: justify;">এ ছাড়া হাসপাতালগুলোর আউটডোরে এসব রোগে আক্রান্তদের ভিড় বাড়ছে। গত এক সপ্তাহের মধ্যে ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়া রোগীর সংখ্যা বেশি মাত্রায় বাড়তে শুরু করেছে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।</p> <p style="text-align: justify;">কয়েক দশক ধরে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে দেশের বরেন্দ্র অঞ্চলের ৪০ শতাংশেরও বেশি ইউনিয়নে পানিশূন্যতা তৈরি হয়েছে। ফলে এসব এলাকায় খাবার ও সেচের পানির মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছে।</p> <p style="text-align: justify;">ওয়াটার রিসোর্স প্ল্যানিং অর্গানাইজেশনের (ওয়ারপো) পক্ষ থেকে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডাব্লিউএম) পরিচালিত সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে রাজশাহী অঞ্চলে পরিস্থিতি দিনকে দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। এতে করে পানি সংকটাপন্ন এলাকার পরিধি বাড়ছে। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলাজুড়ে ‘উঁচু বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূপৃষ্ঠ ও ভূগর্ভস্থ পানি পরিস্থিতির হাইড্রোলজিক্যাল অনুসন্ধান ও মডেলিং’ শীর্ষক গবেষণাটি ২০১৮ সালে শুরু হয় এবং গত বছরের জুন মাসে ওয়ারপো কর্তৃক অনুমোদিত হয়।</p> <p style="text-align: justify;">ওয়ারপোর ওই গবেষণা পর্যালোচনার সঙ্গে জড়িত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান জানান, গবেষণাটিতে পানি সংকটাপন্ন এলাকাগুলোতে সংকটের তীব্রতা অনুযায়ী বিকল্প হিসেবে ভূপৃষ্ঠের পানির উৎস্ ব্যবহার এবং ভূগর্ভস্থ এবং ভূপৃষ্ঠের পানির সম্মিলিত ব্যবহার উৎসাহিত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। </p> <p style="text-align: justify;">তিনি বলেন, ‘বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষের জীবন পানির ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় ক্ষয়িষ্ণু পানিসম্পদগুলো দ্রুত পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা জরুরি। এটি করা না গেলে আবহাওয়ার বিরূপ আচরণ থামানো যাবে না। গরম অব্যাহতভাবে বাড়বে। সেই সঙ্গে বন্যা ও প্রাকৃতি দুর্যোগও বাড়বে।’  </p> <p style="text-align: justify;">ওই গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৮৫ ও ১৯৯০ সালে এ অঞ্চলের গড় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ছিল ৮ মিটার। তবে খাবার পানি, সেচ, মাছ চাষ এবং শিল্পের মতো বিভিন্ন কাজে অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে ২০১০ সালের মধ্যে ভূগর্ভস্থ পানির গড় স্তর ১৫ মিটার ছাড়িয়ে যায় এ অঞ্চলে। ২০২১ সালের মধ্যে বিস্তৃত এলাকাজুড়ে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর গড়ে ১৮ মিটারে বৃদ্ধি পায় এবং কিছু কিছু এলাকা যেমন- চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরে একটি স্থানে সর্বোচ্চ ৪৬.৮৭ মিটার রেকর্ড করা হয়।</p> <p style="text-align: justify;">গবেষণায় আরো দেখা গেছে, রাজশাহী, নওগাঁ ও চাপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলের মোট ২১৪টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪০ দশমিক ৬৫ শতাংশ, অর্থাৎ কমপক্ষে ৮৭টি ইউনিয়নকে ‘অতি উচ্চ’ ও ‘উচ্চ পানি সংকটাপন্ন এলাকা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অতি উচ্চ পানি সংকটাপন্ন এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে পোরশা উপজেলার ৬ ইউনিয়নের সবগুলো এবং নাচোল উপজেলা ৪ ইউনিয়নের সবগুলো। যেখানে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর সবচেয়ে বেশি হ্রাস পেয়েছে। চলতি মৌসুমে রাজশাহীর তানোর ও গোদাগাড়ীর বেশ কিছু এলাকায় সাড়ে তিন শ ফুট নিচেও পানির স্তর পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী। ফলে পানির অভাবে আগে ৩৫০ ফিটের মধ্যে যেসব সাবমার্সিবল গভীর পানির পাম্প বসানো হয়েছিল, সেগুলোও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। </p> <p style="text-align: justify;">তানোরের মুণ্ডুমালা পৌরসভার মেয়র সাইদুর রহমান বলেন, ‘আমার এলাকায় তীব্র খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। এমনকি বরেন্দ্র বহুমূখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বসানো গভীর নলকূপের কোথাও কোথাও পানি উঠছে না। সাবমার্সিবল পানির পাম্প অধিকাংশই বন্ধ হয়ে গেছে। এ নিয়ে চরম সংকটে আছি আমরা।’</p> <p style="text-align: justify;">এদিকে টানা গরমে রাজশাহীর জনজীবনে পড়েছে মারাত্মক প্রভাব। সকাল ১০টার পরপরই রাস্তায় যেন আগুন বের হচ্ছে। দুপুরে পিচ ঢালা রাস্তা থেকে আগুনের ভাপ বের হচ্ছে যেন। গরম থেকে রক্ষা পেতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আখের রস ও শরবত পান করতে দেখা যাচ্ছে।</p> <p style="text-align: justify;">এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে অন্তত ৫০ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। যার মধ্যে ৩২ জনই শিশু। যাদের অধিকাংশই ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। গরম থেকে সাবধানতা অবলম্বন করতে গত তিন দিন ধরে রাজশাহী নগরীতে রেড ক্রিসেন্টের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হচ্ছে। <br /> রামেক হাসপাতালের (ইএমও) ইনচার্জ ডা. শংকর কে বিশ্বাস জানান, এখনো আমাদের হাসপাতালে রোগীর পরিমাণ সহনীয় পর্যায়ে আছে। তবে গরম যত বাড়ছে, ডায়রিয়া রোগীও তত বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে পানি ও তরল খাবার খওয়ার পরামর্শ দেন এই চিকিৎসক।  </p> <p style="text-align: justify;">অন্যদিকে রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষক আনোয়ারা খাতুন জানান, রাজশাহীতে গত মার্চের শেষ দিক থেকেই টানা দাবদাহ বিরাজ করছে। কখনো মৃদু আবার কখনো মাঝারি দাবদাহ বিরাজ করছে। সর্বশেষ গত তিন দিন রাজশাহীতে সর্বোচ্চ ৩৯ ডিগ্রির ঘরে ছিল তাপমাত্রা। আর সর্বনিম্ন ছিল ২৪ ডিগ্রি সেলিসিয়াস। সেই হিসাবে রাজশাহীতে এখন মাঝারি দাবদাহ বিরাজ করছে। </p> <p style="text-align: justify;">তিনি আরো জানান, রাজশাহীতে গত ছয় মাসের মধ্যে সর্বশেষ গত ২১ মার্চ মাঝারি বৃষ্টিপাত হয়েছে। গত ২১ মার্চ ৯ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। এর পর আরো দুই দিন বৃষ্টিপাত হয়েছে। তবে সেটি এক দশমিকের ঘরেও পৌঁছাতে পারেনি। সর্বশেষ গত ১৪ এপ্রিল বৃষ্টিপাত হয়েছে দশমিক ২ মিলিমিটার। এর আগে গত ৩১ মার্চ বৃষ্টিপাত হয় দশমিক ৬ মিলিমিটার।</p>