<p>মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার টাঙ্গাইল-৪ কালিহাতী আসনটি নানা কারণে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থান। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একেবারে হ-য-ব-র-ল হয়ে পড়েছে এখানকার রাজনীতি। চলছে বাগবিতণ্ডা আর কাঁদা ছোড়াছুড়ি। ১৩টি ইউনিয়ন আর ২টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত উপজেলায় আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে রয়েছে ব্যাপক কোন্দল আর বিরোধ। এদিকে এ আসনটিতে নজর পড়েছে সিদ্দিকী পরিবারের। সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে আলোচনায় এসেছেন শুকলা সিরাজ। সম্ভাব্য অধিকাংশ প্রার্থীই করছেন গণসংযোগ। সব মিলিয়ে কালিহাতীর রাজনৈতিক পরিবেশে রিবাজ করছে হ-য-ব-র-ল। দলীয় নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ রয়েছেন অস্বস্তিতে।</p> <p>টাঙ্গাইলের প্রভাবশালী সিদ্দিকী পরিবারের পৈত্রিক নিবাস কালিহাতী উপজেলার নাগবাড়ী ইউনিয়নের ছাতিহাটী গ্রামে। তারা এখন কেউই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নেই। তবুও কালিহাতীতে এ পরিবার বড় ফ্যাক্টর। সিদ্দিকী পরিবারের ৪ ভাই এবং এক পুত্রবধূকে কালিহাতীর মাঠে ঘাটে গণসংযোগে দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে প্রকাশ্যে এসেছে তাদের পারিবারিক বিরোধও। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকার পর কিছুদিন ধরে ব্যাপক গণসংযোগ চালাচ্ছেন। তার সঙ্গে স্ত্রী সাবেক এমপি লায়লা সিদ্দিকীসহ স্থানীয় আওয়ামীপন্থী অনেক নেতাকর্মী প্রকাশ্যে গণসংযোগে অংশ নিচ্ছেন। লতিফ সিদ্দিকী হজ্ব, তাবলীগ জামাত এবং প্রধানমন্ত্রীর পুত্র জয়কে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার হন। তিনি কালিহাতীর আসন থেকে ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ১৯৭৩, ১৯৯৬, ২০০৮ এবং ২০১৪ সালে এমপি হয়ে মন্ত্রী হন</p> <p> সম্প্রতি লতিফ সিদ্দিকী তার ছোট ভাই বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বিরোত্তমের প্রতিষ্ঠিত দল কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের (গামছা) একাধিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে উপস্থিত থেকে বক্তব্য দিয়েছেন। বিভিন্ন সামাজিক ও পারিবারিক অনুষ্ঠানেও তারা মিলিত হচ্ছেন। অনেকের ধারণা কাদের সিদ্দিকী যদি আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হন, সেখানে লতিফ সিদ্দিকী জোটের প্রার্থী হতে পারেন। তবে লতিফ সিদ্দিকী গামছায় যোগ দেবেন কি না, এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কৌতুহলের সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে লতিফ সিদ্দিকী বলেন আমি আওয়ামী লীগার, আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে শেখ হাসিনার কর্মী। নির্বাচন করব কি না সেটা সময়ই বলে দেবে।</p> <p>এদিকে বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশ ও গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর সাক্ষাতের পর থেকে কালিহাতীতে সক্রিয় ও মনোবল বেড়েছে গামছার নেতাকর্মীদের। বঙ্গবীর টাঙ্গাইল-৮ (সখিপুর বাসাইল) থেকে এবার নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি ৮নং আসন থেকে ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে এমপি হয়েছিলেন। তার ছোট ভাই সরকারি সাদত কলেজের সাবেক ভিপি শামীম আল মনসুর আজাদ সিদ্দিকীকে নিয়ে কালিহাতীতেও সভা-জনসভা করছেন। কাদের সিদ্দিকী বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর পক্ষে জোরালোভাবে বক্তব্য রাখছেন। কালিহাতী উপজেলা কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি লুৎফর রহমান সিদ্দিকী কালের কণ্ঠকে বলেন, যেহেতু লতিফ সিদ্দিকী আমাদের দলে সদস্য নন, তাই তিনি কোন দলে থেকে নির্বাচন করতে পারেন সেটা বলতে পারব না। আমাদের নেতাকর্মীদের চাওয়া বঙ্গবীর কিংবা আজাদ সিদ্দিকী। তবে বঙ্গবীরের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। </p> <p>সিদ্দিকী পরিবারের আরেক ভাই মুরাদ সিদ্দিকী টাঙ্গাইল সদর আসন থেকে একাধিকবার নির্বাচন করে উল্লেখ্যযোগ্য ভোট পেয়ে পরাজিত হয়েছেন। সদরে রয়েছে তার নিজস্ব ভোট ব্যাংক। মুরাদ সিদ্দিকী দীর্ঘদিন ধরে আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগে যোগদানের চেষ্টা করছেন। তিনি সদরের পাশাপাশি কালিহাতীর বিভিন্ন স্থানে সভা-জনসভা ও গণসংযোগ করছেন।</p> <p>সম্প্রতি দেলদুয়ারের আটিয়ায় লতিফ সিদ্দিকীর গাড়ি বহরে মুরাদ সিদ্দিকী বাধা দেন। ঘটনাটি ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি করে। এতে দুই ভাইয়ের বিরোধ প্রকাশ্যে চলে আসে। মুরাদ সিদ্দিকী কালের কণ্ঠকে বলেন, আমি আওয়ামী লীগ করতে চাই। আমি গামছা করব না। নির্বাচনের বিষয়ে সময়মতো সিদ্ধান্ত নেব।</p> <p>কালিহাতীর আওয়ামী রাজনীতির অভ্যন্তরীণ বিরোধ কোন্দল নতুন বিষয় নয়। স্থানীয় এমপি হাছান ইমাম খান সোহেল হাজারীর সঙ্গে উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের চরম দ্বন্দ বিরাজমান। কোন্দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশীরা হলেন- বর্তমান এমপি, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজহারুল ইসলাম তালুকদার এবং জেলা আওয়ামী লীগের কৃষি-সমবায় বিষয়ক সম্পাদক ব্যবসায়ী নেতা আবু নাসের। তারা সরকারের উন্নয়ন তথ্য-চিত্র তুলে ধরে গণসংযোগ, সভা মতবিনিময় করছেন। তবে এমপি বিরুদ্ধে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার মোল্লাসহ অন্যরা একাট্টা রয়েছেন।</p> <p>দীর্ঘ ৩২ ধরে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বপালনকারী মোজহারুল ইসলাম তালুকদার বলেন, আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সোহলে হাজারী এমপি হলেও দলের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি বিএনপি-জামায়াতের ও ব্যক্তিগত লোক নিয়ে চলাচল করেন। সরকারি উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড আওয়ামী লীগকে ছাড়াই মনমতো করে থাকেন। বিগত উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আমি মনোনয়ন পেলেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে বিদ্রোহী প্রার্থীকে বিজয়ী করান এমপি। আমি বিপদে আপদে সুখে দুখে সারাজীবন দলের সঙ্গেই আছি-থাকব।</p> <p>আবু নাসের এফবিসিসিআই এবং জনতা ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন। তিনি বলেন, নির্বাচিত হয়ে আমাদের এমপির নির্দেশে কালিহাতীর অসংখ্য ত্যাগী নেতাকর্মীকে পিটিয়ে রক্তাক্ত এবং হুমকি ধমকি দেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে শিক্ষাগত সার্টিফিকেট জালিয়াতির মামলাও হাইকোর্টে চলমান আছে। আবু  নাসের আরো বলেন, মুক্তিযোদ্ধা ও অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা, প্রান্তিক কৃষকদের সুদমুক্ত ঋণের ব্যবস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার প্রদানসহ বন্যা, করোনা ও ঈদে কালিহাতীর মানুষের পাশে ছিলাম আছি।</p> <p>লতিফ সিদ্দিকীর পদত্যাগের পর উপ-নির্বাচনে এবং ২০১৮ সালে এমপি হন হাছান ইমাম খান সোহেল হাজারি। এমপি হাছান ইমাম খান সোহেল হাজারী বলেন, এখন মানুষ এমপির পেছনে ঘুরে না, এমপিই মানুষের পেছনে ঘুরে। গত ৭ বছরে কালিহাতীতে স্মরণকালের সবচেয়ে উন্নয়ন হয়েছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমার কোনো দূরত্ব নেই। নেতাকর্মীদের আহত করার অভিযোগ সত্য নয়। শিক্ষা সনদের মামলার বিষয়টি হাইকোর্টেই সমাধান হবে। লতিফ সিদ্দিকীর বিষয়ে এমপি বলেন, তিনি একজন নাস্তিক এবং আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত। শুনেছি তিনি গামছায় যোগ দিয়েছেন।</p> <p>এ আসনে বিএনপিতেও রয়েছে ভয়াবহ কোন্দল। দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে দলীয় কর্মসূচি পালন করেন নেতাকর্মীরা। মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত হয় না তাদের। উপজেলা বিএনপি এবং অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোর কমিটিতে কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক (ঢাকা) বেনজীর আহমেদ টিটোর অনুসারীরা স্থান পেয়েছেন। ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় এ নেতা দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী। এখানে ২০০৮ সালে বিএনপি দলীয় মনোনয়ন পেয়ে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য শিল্পপতি লুৎফর রহমান মতিন ৮৭ হাজার ভোট পেয়ে পরাজিত হন। মতিনসহ কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা দলের সহসভাপতি ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল হালিম, উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি শুকুর মাহমুদ, কালিহাতী পৌরসভার সাবেক মেয়র আলী আকবর জব্বার, পেশাজীবী নেতা অধ্যাপক আব্দুল আওয়াল ও ডা. শাহালম মনোনয়ন প্রত্যাশীরা টিটোর বিরুদ্ধে একাট্টা। টিটোপন্থীদের সঙ্গে বিএনপির অপর পক্ষের মারামারি ও ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে। তবে চলমান সরকার বিরোধী আন্দোলনে দুই পক্ষকে মাঠে তেমনটা দেখা যায়নি।</p> <p>স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠক প্রয়াত মন্ত্রী শাজাহান সিরাজের মেয়ে ও ঢাকার গুলশান সোসাইটির মহাসচিব ব্যারিস্টার সারওয়াত সিরাজ শুক্লা কালিহাতীতে দুই বছর যাবৎ সামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে গণসংযোগ ও প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন। বন্যায় ত্রাণ ও শীতে কম্বল এবং ঈদ উপহার বিতরণ করে তিনি আলোচনায় এসেছেন। এ আসন থেকে তার বাবা শাজাহান সিরাজ জাসদ ও বিএনপি থেকে ১৯৭৯, ১৯৮৮, ১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে এমপি হয়ে মন্ত্রী হন। শাহজাহান সিরাজের অনুসারীদের রয়েছে একটি ভোট ব্যাংক। মূলত তাদেরকে সঙ্গে নিয়েই শুক্লা সিরাজ গণসংযোগ করেন। তিনি কোন দল থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন তা স্পষ্ট করেননি। তবে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছেন। এখানে জাতীয় পার্টির তৎপরতা নেই বললেই চলে।</p> <p>কালিহাতীতে জন্মেছেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, বরেণ্য সাহিত্যিক ড. আশরাফ সিদ্দিকী, বরেণ্য অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ও ভাষা সৈনিক মির্জা মাজহারুল ইসলামের মতো গুণি ব্যক্তিত্ব। এখানে শাজাহান সিরাজ ও লতিফ সিদ্দিকীর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও তাদের মধ্যে ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং কোন্দলের কারণে নেতাকর্মীরা রয়েছেন অস্বস্তিতে। সাধারণ মানুষ শঙ্কা প্রকাশ করেন। তাদের চাওয়া হানাহানিমুক্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। </p> <p>জানা যায়, ১৯৭৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ৫ বার, বিএনপি প্রার্থী ৩ বার, জাসদ (সিরাজ) ২ বার এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী ১ বার জয়লাভ করেছেন। এ আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৫৪ হাজার ৫৬৫ জন ভোটার। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৭৮ হাজার ৯০৮ জন এবং নারী ১ লাখ ৭৫ হাজার ৬৫৭ জন।</p>