<p>কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচআর) চেয়ারম্যান মহিব উল্লাহকে হত্যায় জড়িত ছিল ১৯ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী। হত্যাকাণ্ডের দুই দিন আগে মরকজ পাহাড়ে কিলিং মিশনের জন্য বৈঠক করে সন্ত্রাসীরা। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, মহিব উল্লাহকে থামাতে হবে। দিনে দিনে তিনি রোহিঙ্গাদের নেতা হিসেবে পরিচিত হচ্ছেন। প্রত্যাবাসনসহ রোহিঙ্গাদের স্বার্থ নিয়ে কাজ করছেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী পাঁচজন অস্ত্রধারীসহ ১৯ জন মাত্র দুই মিনিটে গুলি করে হত্যা করে তাঁকে। চাঞ্চল্যকর এ হত্যায় জড়িত চারজনকে গ্রেপ্তারের পর এসব তথ্য জানিয়েছেন আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) কর্মকর্তারা।</p> <p>এদিকে গত শুক্রবার ভোরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে ছয়জনকে হত্যার পর মহিব উল্লাহ খুনে অস্ত্র হাতে অংশ নেওয়া আজিজুল হকসহ চারজনকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানায় পুলিশ। গতকাল শনিবার আসামি আজিজুল হক কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম জেরিন সুলতানার আদালতে ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এর অগে আরো পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ, যাঁদের মধ্যে মোহাম্মদ ইলিয়াস মাঝি নামের এক আরসা মতাদর্শী সন্ত্রাসী আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।</p> <p>পুলিশ কর্মকর্তারা দাবি করছেন, শুক্রবারের ছয় খুনের সঙ্গে মহিব উল্লাহ খুনের যোগসূত্র তাঁরা পাননি। তবে রোহিঙ্গারা বলছে, আরসা ও এর মতাদর্শী সংগঠনের সন্ত্রাসীরাই দুই খুনের ঘটনায় জড়িত। তারা এলাকায় ভিন্ন কোনো সংগঠন এবং প্রত্যাবাসনের পক্ষে কার্যক্রম দেখতে চায় না। মহিব উল্লাহর মতোই ইসলামিক মাহাজ নামের একটি সংগঠন প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করছিল। তাদের বিরোধিতার কারণেই শুক্রবার ভোরে মাদরাসায় হামলা চালিয়ে ছয়জনকে হত্যা করা হয়।</p> <p>এদিকে ছয় খুনের পর উখিয়ার ১৮ নম্বর ক্যাম্পে চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে। মাদরাসাটি ঘিরে পাহারা বসিয়েছে পুলিশ। তবে স্থানীয় লোকজন বলছে, আশপশের ক্যাম্প থেকে আরসার মতাদর্শী আল ইয়াকিন ও ‘উলামা কাউন্সিলের’ শতাধিক সন্ত্রাসী এসে মাদরাসায় হামলা করে। এদের মধ্যে অন্তত ১০ জন সন্ত্রাসীকে নিয়ে আতঙ্কে আছে ক্যাম্পের বাসিন্দরা। ইসলামিক মাহাজ ও মহিব উল্লাহর মতাদর্শীদের বিরুদ্ধে আরো হামলা হতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।</p> <p>গতকাল পর্যন্ত এপিবিএন সন্দেহভাজন ১০ জনকে আটক করে উখিয়া থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে। তবে গত রাত পর্যন্ত কোনো মামলা করা হয়নি। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে কোনো বাদী না পাওয়ায় মামলায় দেরি হচ্ছে। গতকাল দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে এপিবিএন-১৪-এর অধিনায়ক পুলিশ সুপার নাঈমুল হক বলেন, গতকাল ভোর ৪টার দিকে কুতুপালং শিবিরের লম্বাশিয়া পুলিশ ক্যাম্পের পার্শ্ববর্তী লোহার ব্রিজ এলাকা থেকে একটি ওয়ান শ্যুটার গানসহ আজিজুল হককে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর তথ্য মতে মোহাম্মদ রশিদ প্রকাশ মুর্শেদ আমিন, মোহাম্মদ আনাছ ও নূর মোহাম্মদ নামের তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁরা সবাই কুতুপালং শিবিরের বাসিন্দা। তাঁদের মধ্যে আজিজুল হক স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। </p> <p>জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে নাঈমুল হক বলেন, মহিব উল্লাহকে হত্যার দুই দিন আগে রাত ১০টার দিকে লম্বাশিয়া মরকজ পাহাড়ে একটি মিটিং করা হয়। ওই কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া গ্রেপ্তার হওয়া আসামি আজিজুল হকসহ চারজন উপস্থিত ছিলেন। কারণ হিসেবে বলা হয়, মাস্টার মহিব উল্লাহ রোহিঙ্গাদের বড় নেতা হয়ে উঠেছেন। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনসংক্রান্তে বিশেষ ভূমিকা পালন করায় দিনে দিনে মহিব উল্লাহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়ে উঠেছেন। তাই তাঁকে থামাতে হবে। পরবর্তী সময়ে তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে এশার নামাজের পর গ্রেপ্তারকৃত মুর্শেদ আমিন প্রত্যাবাসন বিষয়ে কিছু লোক কথা বলবে জানিয়ে মহিব উল্লাহকে অফিসে ডেকে নিয়ে যান। অফিসে গেলে মুর্শেদ আমিন অন্য দুই সন্ত্রাসী আনাছ ও নুর মোহাম্মদকে জানান। এ দুজন কিলিং মিশনের অপেক্ষমাণ অন্য সদস্যদের সংবাদ দেন। সংবাদ পেয়ে মুখোশধারী সাতজন এসে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। অফিসে ঢুকে কিলারদের একজন মাস্টার মহিব উল্লাহকে বলেন, ‘মহিব উল্লাহ উঠ।’ তিনি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালে প্রথম কিলার একটি গুলি, দ্বিতীয় কিলার দুটি এবং সর্বশেষ আরেকজন একটি, মোট চারটি গুলি করেন। মহিব উল্লাহ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। হত্যাকাণ্ডের পর কিলাররা অফিসের পেছনের পেঁপেবাগান হয়ে পালিয়ে যান। এরপর গ্রেপ্তার এড়াতে তাঁরা বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে চলে যান। এ সময় তাঁদের মোবাইল ফোনও বন্ধ করে দেন। </p> <p>গত ২৯ সেপ্টেম্বর খুনের পরের দিন মহিব উল্লাহর ছোট ভাই হাবিবুল্লাহ অজ্ঞাতপরিচয় সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় হত্যা মামলা করেন। উখিয়া থানা পুলিশ আগে পাঁচজনকে দুই দফায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তাঁদের মধ্যে মোহাম্মদ ইলিয়াস কক্সবাজার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।</p> <p>একই চক্রে ধারাবাহিক হত্যা, থমথমে ক্যাম্প</p> <p>গতকাল সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বালুখালী ক্যাম্প ১৮-এর এইচ-৫২ ব্লকে ছয় খুনের পর সাধারণ রোহিঙ্গারা তাদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। তারা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য ওই ব্লকে শুধু পুলিশি টহলের পরিবর্তে স্থায়ী পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপনের দাবি করেছে। দারুল উলুম নাদওয়াতুল উলামা আল-ইসলামিয়া মাদরাসা পাহারা দিচ্ছে পুলিশ।</p> <p>বালুখালী ১৮ নম্বর ক্যাম্পের এইচ-৫২ ব্লকের রোহিঙ্গা যুবক আবদুল আজিজ বলেন, ‘প্রতিটি ক্যাম্পের প্রতিটি ব্লক থেকে আরসা ও আল ইয়াকিনকে কমবেশি সহযোগিতা দেওয়া হতো। কিন্তু আমাদের ব্লক থেকে তারা কোনো ধরনের হেল্প বা প্রশ্রয় পেত না। তাই তারা এই ব্লকের লোকদের ওপর সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ ছিল এবং বারবার আমাদের ঘায়েল করার চেষ্টা করেছে। ঘটনা শেষে চলে যাওয়ার সময়ও তারা এই ক্যাম্পের ১০ বছরের বেশি বয়সী সব পুরুষকে খতম করে দেবে বলে হুমকি দিয়ে যায়।’</p> <p>স্থানীয় বাসিন্দারা বলছে, আল ইয়াকিন ও উল্লামা কাউন্সিল নামে সক্রিয় আরসার মতাদর্শী সন্ত্রাসীরা ১৮ নম্বর ক্যাম্পে শক্তি বাড়াতে চায়। ওই ক্যাম্প ও আশপাশে তাদের অনেক অনুসারী সন্ত্রাসী আসে। শুক্রবারের ছয় খুনে এদের অনেকে অংশ নিয়েছে। তারা মহিব উল্লাহ খুনেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। এদের মধ্যে ১৮ নম্বর ক্যাম্পের খালেদ, মৌলভি আতিকুর রহমান, রহমত করিম, মৌলভি আজিজ, জাবের, হাশিম, হাসেম উল্লাহ, শামসু, ৫২ নম্বর ব্লকের আবদুল মালেক ও রফিক সক্রিয়।</p> <p>গতকাল সন্ধ্যায় এপিবিএন-১৪-এর অধিনায়ক পুলিশ সুপার নাঈমুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মহিব উল্লাহ ও ছয় খুনে একই গ্রুপ জড়িত—এমন তথ্য আমরা পাইনি। তবে তারা সন্ত্রাসী গ্রুপ। রোহিঙ্গাদের শান্তি চায় না।’</p> <p>পুলিশ সূত্র জানায়, গতকাল পর্যন্ত সন্দেহভাজন ১০ জনকে আটক করেছে এপিবিএন-৮। তাদের মধ্যে ওয়ান শ্যুটার গান, ছয় রাউন্ড গুলি ও একটি ছুরিসহ মজিবুর রহমান নামের একজনকে শুক্রবার হাতেনাতে ধরা হয়। পরে ব্লক রেইড দিয়ে ১১ নম্বর বালুখালী ক্যাম্পের মৌলভি নুর হোসেন ওরফে মৌলভি মাজেদ (৪২), গণি ওরফে ইউনুস ওরফে আব্দুল্লাহ (৩৫), ১২ নম্বর ক্যাম্পের মৌলভি করিমুল্লাহ (২৮) এবং ৮ নম্বর ক্যাম্পের মৌলভি নুরুল বশরকে (৩০) আটক করা হয়েছে বলে জানা গেছে।</p> <p>উখিয়া থানার ওসি আহমেদ মঞ্জুর মোর্শেদ বলেন, ঘটনার তদন্ত চলছে। কয়েকজন আটক আছে। তবে কেউ বাদী হয়ে মামলা দিতে চাইছে না। এ কারণে মামলা দিতে দেরি হচ্ছে।</p>