ফাইল ফটো
বাপ-দাদার মুখি শুনিলাম, বাঁধ দিছিলো জোয়ারের পানি ঠেকাতি, নোনা-জলোচ্ছ্বাস ঠেকাতি; এখন সেই বাঁধ হইছে নতুন যন্ত্রণা। বাঁধ না থাকলি আমরা ডুবে মরি, আর বাঁধ থাকলি কাইটে-কুইটে নোনা পানি তুলি। আর ঝড় হলিতো বাঁধ ভাইঙ্গে অথবা উপচে পইড়ে পানি আইসে তলায় যায়। আইলায় বাঁধ ভাইঙ্গে এই পাড়াটা বিলীন হইয়ে গেল। আর এবারে বাঁধ ভাইঙ্গে তলায় আছি।
কথাগুলো বলছিলেন দাকোপ উপজেলার জালিয়াখালির অনিল রায়। ২০০৯ সালের ২৫ মে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় আইলায় এখানে বাঁধে ভাঙ্গন দেখা দেয়। বাঁধ যথাসময়ে মেরামত না করায় ধীরে ধীরে এখানকার একটি পাড়া ঢাকী নদীতে বিলীন হয়ে যায়। আংটির মতো ঘুরিয়ে একটি নতুন বাঁধ (রিং বাধ) দেয়া হয়েছিল। গত বুধবার রাতে (২০ মে) আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের তোড়ে রিং বাঁধটি ভেঙ্গেছে। ফলে এবারেও তারা পানির তলায় ডুবে গেছেন। আইলার পরে এই বারো বছরের মধ্যে যদি বাঁধটি ঠিকঠাক দেয়া হতো, তাহলে বাঁচা যেতো বলে তিনি মন্তব্য করেন। আবার আফসোসও করেন এই বলে যে, বিশ^ব্যাঙ্কের টাকায় যে বাঁধ দেয়া হচ্ছে, তাও ঠিকঠাক দেয়া হচ্ছে না। অনেক পরিবারই বাঁধের বাইরে থেকে যাচ্ছেন। এতে জোয়ারে, নদী-ভাঙ্গনে ওই পরিবারগুলোর ভেসে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রতিক্রিয়ায় খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার কমপক্ষে দশ জায়গায় এবং কয়রা উপজেলার কমপক্ষে বারো জায়গায়; সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার কমপক্ষে বিশ জায়গায় এবং আশাশুনি উপজেলার কমপক্ষে দশ জায়গায় বাঁধ ভেঙ্গেছে। এরমধ্যে কয়রা উপজেলার আংটিহারা এলাকার ভাঙ্গন খুবই ভয়াবহ। কিলোমিটারেরও বেশী জায়গা জুড়ে এখানে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। এলাকাবাসী নিজেদের রক্ষার জন্যে নিজেরাই ভাঙ্গা বাঁধ মেরামত করছেন। কারণ, অতি দ্রুত এই ভাঙ্গন ঠেকানো না গেলে গেলে একটি বিশাল এলাকা জলমগ্ন হযে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে, দেশের পশ্চিম উপকূলীয় এই অঞ্চলে (খুলনা ও সাতক্ষীরা) বসতির সাথেই নদী-বাঁধের একটি সম্পর্ক আছে। আগে এলাকাবাসী নিজেদের মত করে বছরের একটি সময়ে বাঁধ দিতো। উনিশশ’ ষাটের দশকে কোস্টাল ইমব্যাঙ্কমেন্ট প্রজেক্টÑসিইপি’র আওতায় স্থায়ী বাঁধ দেয়া হয়। আবার উনিশশ’ আশির দশকের শুরুতে বাঁধ কেটে নোনা পানি তুলে শুরু হয় চিংড়ি চাষ। এতে প্রায় তিন দশকের বেশী সময় বাঁধ কাঁটা-ছেড়া করায় হয়ে পড়ে খুবই দুর্বল। যা এখন জোয়ারের চাপও সইতে পারে না। অমাবশ্যা, পূর্ণিমার সময় এলে এখানকার মানুষগুলো আঁতকে থাকে এই বুঝি, বাঁধ ভেঙ্গে যায় বা পানি উপচে পড়ে। এই অঞ্চলের বাঁধই সবচেয়ে পুরনো, অর্ধ শতাব্দী কাল পার করেছে। ফলে বাঁধগুলো দুর্বল।
জানতে চাইলে দাকোপ উপজেলার ভাইস-চেয়ারম্যান গৌরপদ বাছাড় কালের কণ্ঠকে বলেন, উপজেলার কমপক্ষে দশ জায়গায় বাঁধে ভাঙ্গন ও ফাটল দেখা দিয়েছে, যা দ্রুততার সাথে মেরামত করার চেষ্টা চলছে। শ্যামনগর আতরজান মহিলা মহাবিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যক্ষ, সমাজকর্মী আশেক-ই-এলাহী বলেন, সাতক্ষীরার কমপক্ষে ২৩ জায়গায় বাঁধে বড় ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। আর প্রায় পুরো জায়গায় নদীগুলোর পানি উপচে পড়েছে। কয়রার সমাজকর্মী আবু সাঈদ খান বলেন, দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের ছয় জায়গায়, উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের দুই জায়গায় এবং কয়রা সদরের দুই জায়গায় বাঁধে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। এখানকার আংটিহারা এলাকার স্লুইজ গেটের পাশে দীর্ঘ প্রায় দুই কিলোমিটার জায়গা জুড়ে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে।
এ বিষয়ে খুলনা-৬ আসনের (পাইকগাছা-কয়রা) সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান বাবু কালের কণ্ঠকে বলেন, কয়রা ও পাইকগাছা উপজেলায় কমপক্ষে পঞ্চাশ জায়গায় বাঁধে ফাটল ও ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। শুধুমাত্র কয়রা উপজেলার চল্লিশ কিলোমিটার বাঁধ বিধ্বস্ত। পাইকগাছা উপজেলার সোলাদানা, দেলুটি ও লস্কও ইউনিয়নে বাঁধ বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অবশ্য, বাঁধের পুরো ক্ষয়ক্ষতি এখনও নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। তিনি বিষয়টি নিয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রীর সাথে কথা বলেছেন উল্লেখ করে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে স্থায়ীভাবে বাঁধ দেওয়ার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। দুর্বল এই বাঁধগুলো স্থায়ীভাবে সংস্কার-পুন:নির্মাণ না করা গেলে উপকূলের এই মানুষগুলোকে প্রাকৃতিক এই দুর্যোগ থেকে রক্ষা করা খুবই কষ্টকর।
মন্তব্য