<p>কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার চরপলাশ গ্রামে ‘কথিত’ কবিরাজ সবুজ মিয়ার চিকিৎসা-সভা নিয়ে তোলপাড় চলছে জেলাজুড়ে। তেল ও পানি বেচে এ সভা থেকে আয়োজকদের অন্তত ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকার বাণিজ্য হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। স্থানীয় লোকজনের কেউ কেউ বলছে, বাণিজ্যের জন্যই আয়োজন করা হয় এই চিকিত্সা-সভা। তবে আয়োজকদের পক্ষ থেকে বিষয়টি অস্বীকার করা হয়েছে। গতকাল সোমবার সরেজমিনে চরপলাশ গ্রামে গিয়ে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।</p> <p>চরপলাশ গ্রামের এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কবিরাজের জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে এ বাণিজ্যের ছক সাজানো হয়। গত শনিবার এখানে অন্তত ৫০ থেকে ৬০ হাজার লোক বিভিন্ন রোগব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় সমবেত হয়। তাদের প্রায় সবাই আয়োজকদের বসানো দোকান থেকে পানি ও তেল কেনে। প্রতি বোতল পানি ২৫ টাকা এবং প্রতি শিশি তেল ৩০ টাকা করে বিক্রি হয়। এ হিসাবে কম করে হলেও ২৫ লাখ টাকা আয় হয়েছে আয়োজকদের। এ ছাড়া সমাবেশস্থলে আরো বিভিন্ন ধরনের দোকানপাট ছিল। এগুলোও আয়োজকদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। </p> <p>আরেকজন জানালেন, যেখানে সমাবেশ করা হয়েছে সেখানে স্থানীয় মঞ্জু মিয়ার কাঁচা-পাকা ধানের ক্ষেত ছিল। সেই ক্ষেত মালিককে ১০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে আয়োজকরা কবিরাজের আসর বা কথিত চিকিৎসা-সভার আয়োজন করেন। আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, অর্ধশতাধিক প্রভাবশালী লোকের সমন্বয়ে গঠিত হয় এ আয়োজক কমিটি, যাদের বেশির ভাগই ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী। </p> <p>আয়োজকদের একজন সাবেক পুলিশ সদস্য চরপলাশ গ্রামের মো. সুমন। তিনি দাবি করেন, কোনো কমিটি নয়, স্থানীয় লোকজনের কবিরাজের বাড়িতে গিয়ে চিকিত্সা নিতে অসুবিধা হয় বিধায় এখানে এ আয়োজন করা হয়। তারা এই কবিরাজের ভক্ত। কবিরাজের পানিপড়া ও তেলপড়া ব্যবহারে অনেকে উপকৃত হয়েছে। এ কারণেই এত লোকের সমাগম। তিনি বলেন, কবিরাজ চিকিৎসার জন্য কোনো টাকা-পয়সা নেন না। তিনি নিজের খরচে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে লোকজনের সেবা করেন। যারা উনার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছে তারা মূলত সাধারণ মানুষের ভালো চায় না। </p> <p>অন্যদিকে এ ধরনের চিকিৎসার আয়োজনকে সচেতন ব্যক্তিরা কুসংস্কার আখ্যা দিয়েছেন। স্থানীয় সুখিয়া গ্রামের বাসিন্দা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইমদাদুল হক হূদয় বলেন, ‘আমরা যখন মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠাচ্ছি, যখন জ্ঞান-বিজ্ঞানে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে তখন এ ধরনের কুসংস্কারের চর্চা হলে দেশ ও সমাজ পিছিয়ে যাবে।’ </p> <p>একই গ্রামের হলুদ মিয়া জানালেন, মানুষের কথা শুনে তিনিও সেখানে গিয়েছিলেন। পানি ও তেলপড়া এনেছিলেন। ব্যবহারও করেছিলেন; কিন্তু কী উপকার হলো কিছু বুঝতে পারছেন না। </p> <p>কিশোরগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অজ্ঞতা ও কুসংস্কারে বশবর্তী হয়ে লোকজন চরপলাশে গিয়েছিল। এ ধরনের চিকিত্সা পদ্ধতিকে নিরুত্সাহ করতে হবে।</p> <p>প্রসঙ্গত, গত শনিবার কথিত কবিরাজ সবুজ মিয়ার চিকিৎসা নিতে ৫০ থেকে ৬০ হাজার মানুষ সমবেত হয়। বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে বিভিন্ন জেলা ও আশপাশের এলাকা থেকে কবিরাজের একটু পানিপড়া ও তেলপড়া নিতে হাজির হয় তারা। সবাই পানি ও তেলের বোতল উঁচিয়ে ধরে আর কবিরাজ মাইকে ফুঁ দেন। রোগবালই থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় আগত লোকজন পানিপড়া ও তেলপড়া নিয়ে বাড়ি ফেরে। </p> <p>স্থানীয় লোকজন জানায়, তেলপড়া ও পানিপড়া নিতে আসা লোকজনের মধ্যে নারীদের সংখ্যাই বেশি ছিল। কথিত চিকিত্সা-সভার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে জেলাজুড়ে শুরু হয় নানা সমালোচনা। এলাকায় দেখা দেয় মিশ্র প্রতিক্রিয়া।</p> <p>তবে চারপলাশ গ্রামের অনেকে আবার ঝাড়ফুঁকে উপকৃত হয়েছে বলে দাবি করেছে। আর তারা বিশ্বাস থেকে সেখানে গিয়েছিল বলেও জানায়।</p> <p>সবুজ মিয়া নামের ওই কবিরাজ ভালুকা উপজেলার রাজ্য ইউনিয়নের পায়লাবের প্রামের অধিবাসী। তিনি বনে কাঠ কেটে জীবিকা নির্বাহ করেন। স্বপ্নপ্রাপ্ত হয়ে এ ধরনের কবিরাজি করেন বলে তাঁর ভক্তরা জানিয়েছে। </p> <p>গত শনিবারের এই সমাবেশে উপজেলা চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম রেনু, সুখিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল হামিদ টিটুসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। এ ধরনের সমাবেশে জনপ্রতিনিধিদের উপস্থিতিও সমালোচিত হচ্ছে।</p> <p>পাকুন্দিয়া থানার ওসি মো. মফিজুর রহমান বলেন, ‘একজন কবিরাজের আগমন উপলক্ষে এমন প্রস্তুতি আমাদের জানা ছিল না। জানার পরপরই আইন-শৃঙ্খলা ঠিক রাখতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে পুলিশ ফোর্স পাঠানো হয়। তবে কবিরাজ মাইকে ফুঁ দেওয়ার পরপরই সবাই মাঠ ত্যাগ করে, কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা হয়নি।’</p>