<p style="text-align: justify;">দেশের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অষ্টম ও নবম শ্রেণির নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার আগেই অবসরে যাচ্ছেন তাঁদের প্রশিক্ষকরা। এতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের বিষয়টি ঝুঁকির মুখে পড়তে যাচ্ছে। এসব শিক্ষকের প্রশিক্ষকরা যে প্রকল্পের অধীনে কাজ করছেন, এর মেয়াদ চলতি মাসে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এর আগে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সঙ্গে প্রকল্পটির ঋণের চুক্তিও শেষ হয়। এতে প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানোর বা নবায়নের কোনো সুযোগ নেই।</p> <p style="text-align: justify;">বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন যথাযথ হবে না। যেকোনোভাবে শিক্ষক প্রশিক্ষণের বিষয়টি সম্পন্ন করতে হবে। শিক্ষার্থীদের যথোপযুক্ত পাঠদানে এর বিকল্প নেই।</p> <p style="text-align: justify;">নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিকসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণের দায়িত্বে থাকা সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রগ্রাম (সেসিপ) প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ৩১ ডিসেম্বর। প্রকল্পের মূল লক্ষ্য মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা। প্রকল্পের কর্মকর্তারা সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার মানোন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়াসহ নিয়মিত তদারকি ও শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া।</p> <p style="text-align: justify;">নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে সেসিপ কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে তৈরি করা হয়েছে বিষয়ভিত্তিক মাস্টার ট্রেইনার। আগামী বছর থেকে মাধ্যমিকের অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট শ্রেণির শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। এই প্রশিক্ষণ কাজের শুরুতে চাকরিহারা হচ্ছেন মাস্টার ট্রেইনাররা। এতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন ঝুঁকির মধ্যে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।</p> <p style="text-align: justify;">প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, এই প্রকল্পে সরাসরি নিয়োগ পেয়েছেন এক হাজার ১৮৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। এর মধ্যে এক হাজার দুজন কর্মকর্তা ও ১৮৫ জন কর্মচারী আছেন। এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক মাস্টার ট্রেইনার আছেন ৫০৭ জন।</p> <p style="text-align: justify;">প্রকল্পের যুগ্ম পরিচালক সামসুন নাহার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগামী বছর মাধ্যমিকের অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হবে। এতে শিক্ষার্থীদের পাঠদানে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়েছে। প্রকল্পের বাকি কাজগুলো করা হলেও শিক্ষক প্রশিক্ষণের কাজ এখনো বাকি। তবে শুধু প্রশিক্ষণ নয়, সেসিপ কর্মকর্তাদের মাধ্যমে দেশের ২৫টি থানায় মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস চলমান। এর মধ্যে ঢাকায় রয়েছে ১৬টি। প্রকল্প শেষ হলে এসব দক্ষ জনবল চাকরি হারাবে।’</p> <p style="text-align: justify;">তিনি আরো বলেন, ‘১০ থেকে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এসব দক্ষ জনবল ছাড়া দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মনিটরিং অসম্ভব হয়ে পড়বে। এসব কর্মকর্তা শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির কাজও করে থাকেন। ফলে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে বা রাজস্ব খাতে স্থানান্তর যা-ই করা হোক, মাধ্যমিক শিক্ষার সার্বিক মানোন্নয়নে এসব দক্ষ জনবল আমাদের প্রয়োজন।’</p> <p style="text-align: justify;"><strong>দক্ষ জনবল রাখতে চায় মন্ত্রণালয়</strong><br /> প্রকল্প শেষ হলেও এসব দক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরি বহাল রাখতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে মাউশি। গত ১৫ নভেম্বর পাঠানো চিঠিতে সংশ্লিষ্ট জনবলের চাকরি বহাল রাখার পাশাপাশি ছয় মাসের জন্য ৩৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা চাওয়া হয়। এই চিঠির আলোকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ। তবে এই প্রস্তাবে অসম্মতি জানিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। পরে প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়ানোর প্রস্তাব জানিয়ে গত ৪ ডিসেম্বর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে আরো একটি চিঠি পাঠিয়েছে ওই বিভাগ।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>যে কারণে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে অসম্মতি</strong><br /> পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমডি) বিভাগ থেকে প্রকল্পের বিষয়ে বলা হয়, গত ৩ জুলাই পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে ৯৭.৫০ শতাংশ। এর মধ্যে প্রকল্পটি তিনবার সংশোধন করা হয়েছে এবং চারবার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া গত ২৬ সেপ্টেম্বর এডিবি থেকে দেওয়া ঋণচুক্তির মেয়াদও শেষ হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদও শেষ হবে ৩১ ডিসেম্বর। এখন এই প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ালে অযথা ব্যয় বাড়বে। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জনবলের জন্য থোক বরাদ্দ দিতে পারে। গত ২৩ নভেম্বর আইএমডির এক চিঠিতে এ তথ্য জানানো হয়।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>মেয়াদ বৃদ্ধি নয়, থোক বরাদ্দ দাবি</strong><br /> সেসিপ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজেরাই প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর পক্ষে নন। মেয়াদ বাড়ানো হলে কর্মবিরতিতে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে সেসিপ কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ পরিষদ।</p> <p style="text-align: justify;">সংগঠনের সভাপতি মো. আব্দুল হাকিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সেসিপের জনবল রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের লক্ষ্য নিয়ে গত বছর প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল। প্রকল্প চলমান থাকার কারণে এই কার্যক্রমে ধীরগতি দেখা দেয়। প্রকল্পের মূল কাজ শেষ। তাই প্রকল্পের মেয়াদ না বাড়িয়ে বরং আমাদের দক্ষ জনবল দিয়ে কাজ করাতে হবে। এ জন্য ওয়ার্ক অর্ডারের মাধ্যমে থোক বরাদ্দ দিতে হবে। এই প্রক্রিয়াই হবে রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের প্রথম ধাপ।’</p> <p style="text-align: justify;">সেসিপের একাধিক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, নতুন শিক্ষাক্রম সম্পূর্ণ মনিটরিং ও বাস্তবায়ন একাডেমিক সুপারভাইজাররা করে থাকেন। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ছাড়া জেলা পর্যায়ে রাজস্ব খাতের আর কোনো জনবল নেই। প্রতিটি জেলায় আমরা সাতজন করে মনিটরিংয়ের কাজ করে থাকি। থানা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাসহ সিনিয়র সিস্টেম অ্যানালিস্টও সেসিপের জনবল। ফলে এই জনবল না থাকলে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন থমকে যাওয়ার পাশাপাশি এমপিওকরণের কাজও বন্ধ হয়ে যাবে।</p> <p style="text-align: justify;">তাদের ভাষ্য, অনেক কর্মকর্তা ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে কাজ করছেন। অনেকের চাকরির সময় আছে তিন থেকে পাঁচ বছর। প্রকল্পে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বা পোষ্য আছেন ৭৮ জন। এই বয়সে চাকরি হারালে তাঁদের পরিবার কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? আবার নতুন করে এমন দক্ষ জনবল তৈরি করতে আরো ১০ থেকে ১৫ বছর সময় লাগবে। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষা ব্যবস্থাই পিছিয়ে পড়বে।</p> <p style="text-align: justify;">এ বিষয়ে শিক্ষাবিদ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একটি শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা থাকে। এর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ। ধারাবাহিকভাবে কিভাবে শিক্ষার্থীদের শিখন শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে, এ বিষয়ে আগে শিক্ষকদের পর্যাপ্ত ধারণা নিতে হবে। শিক্ষক প্রশিক্ষণ ছাড়া যেকোনো শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন অসম্ভব। দুই-তিন দিনের প্রশিক্ষণ নয়, বরং তাঁদের ধারাবাহিকভাবে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।’</p> <p style="text-align: justify;">সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তর সূত্রে জানা যায়, সেসিপের এক হাজার ১৮৭ জন কর্মকর্তা কর্মচারীর চাকরি প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে স্থানান্তরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে সম্মতি জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়। প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে জনবল স্থানান্তরে কিছু জটিলতা থাকলেও তা শিথিল করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। এর পরও চারটি কারণ দেখিয়ে রাজস্ব খাতে স্থানান্তরে অসম্মতি জানায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ।</p>