<p style="text-align: justify;">দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা চলছে। ডলার সংকট, বিদ্যুৎ-জ্বালানির সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্যোক্তাদের আস্থাহীনতার পাশাপাশি এই স্থবিরতার বড় কারণ ঋণের উচ্চ সুদহার। কঠোর মুদ্রানীতির কবলে পড়ে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধিতে বড় ধাক্কা লেগেছে। এতে পুরনো ব্যবসার সম্প্রসারণ যেমন থমকে গেছে, তেমনি নতুন বিনিয়োগ ঠেকেছে তলানিতে। আর বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিল্পোৎপাদনও। চলমান অস্থিরতায় বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের বিক্রিতেও ধস নেমেছে। চাকরি হারাচ্ছেন কর্মীরা, বাড়ছে বেকারত্ব। </p> <p style="text-align: justify;">শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত না হওয়ায় নতুন বিনিয়োগে আস্থা পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। আর মাত্রাতিরিক্ত সুদ দিয়ে ব্যবসা করাও সম্ভব নয় বলেও মত দেন তাঁরা।</p> <p style="text-align: justify;">বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, এপ্রিলে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭.৫০ শতাংশ, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২.৪০ শতাংশ কম। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে ব্যাংকগুলোর বেসরকারি ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ১৭ লাখ ২১ হাজার ৮২২ কোটি, যা মার্চ মাসে ছিল ১৭ লাখ ১৯ হাজার ৫১২ কোটি টাকা। এর আগের মাস মার্চে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭.৫৭  শতাংশ, যা জুলাই-আগস্টের পটপরিবর্তনের পর টানা আট মাস ধরে নিম্নমুখী প্রবণতায় ছেদ টেনেছিল।</p> <p style="text-align: justify;">আগের মাস ফেব্রুয়ারিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৬.৮২ শতাংশ। তার আগের মাস জানুয়ারিতে এ খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭.১৫ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধির যে তথ্য আছে, তার বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১ সালের মে মাসে কভিড মহামারির মধ্যে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ৭.৫৫ শতাংশে নেমেছিল।</p> <p style="text-align: justify;">সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ছিলেন ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে বিনিয়োগ হচ্ছে না। বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থান কমে যাবে। দারিদ্র্য বিমোচনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’</p> <p style="text-align: justify;">এই অর্থনীতিবিদ বলেন, সাম্প্রতিককালে দেশের বেসরকারি খাতের অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। ব্যাংক ঋণই ব্যবসায়ীদের প্রধান ভরসা। কিন্তু সেখানে সুদহার বেশি। বিকল্প অর্থায়নের উৎস হিসেবে পুঁজিবাজারের অবস্থাও ভালো না।</p> <p style="text-align: justify;">ব্যাংকের উচ্চ সুদহারও বেসরকারি ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী ও ব্যাংকাররা। বর্তমানে ব্যাংকগুলো ঋণ দিচ্ছে ১৪ থেকে ১৬ শতাংশ সুদে। আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে ৯ শতাংশের ওপর থাকা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কারণেই ঋণের সুদহার বাড়াচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।</p> <p style="text-align: justify;">সুদের হার বাড়ার কারণে আমানতকারীরা কিছুটা লাভবান হলেও ব্যাংক ও ব্যবসায়ীদের জন্য নতুন করে সংকট তৈরি হয়েছে। একদিকে উচ্চ সুদ দিতে চেয়েও আমানত পাচ্ছে না ব্যাংক, অন্যদিকে ঋণসংকটে পড়ছে বেসরকারি খাত।</p> <p style="text-align: justify;">মূল্যস্ফীতি মোকাবেলায় সংকোচনমূলক নীতি বজায় রাখার ধারায় মুদ্রানীতিতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৯.৮০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।</p> <p style="text-align: justify;">ব্যাংকাররা বলছেন, বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা নতুন করে বিনিয়োগ বা ব্যবসা সম্প্রসারণে না যাওয়ায় বড় অঙ্কের ব্যাংক ঋণ বিতরণ হচ্ছে না। এ কারণে কারখানা স্থাপনের মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি কমেছে।</p> <p style="text-align: justify;">বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার পেছনে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও আর্থিক অস্থিরতাকে দায়ী করেছেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান। তিনি বলেন, ‘ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের হার আরোপ করা হচ্ছে, যা ব্যবসা ও বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহ করছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং দীর্ঘমেয়াদি নীতির স্থিতিশীলতার অভাবে বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। ফলে ঋণের চাহিদা কমছে, বিনিয়োগ থমকে যাচ্ছে। নতুন ব্যবসা না হলে কর্মসংস্থানও তৈরি হবে না, বরং বিদ্যমান চাকরিও ঝুঁকিতে পড়বে।’</p> <p style="text-align: justify;">এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে মূলধনী যন্ত্র আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে ১৪১ কোটি ৯১ লাখ ডলারের। আগের অর্থবছরের একই সময় যা ছিল ১৯৫ কোটি ৬২ লাখ ডলার। শতকরা হিসাবে কমেছে ২৭.৪৬ শতাংশ।</p> <p style="text-align: justify;">অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক নির্বাহীরা বলছেন, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের প্রধান উৎস হলো বেসরকারি খাত। শিল্পের উৎপাদন, বিপণন কিংবা সেবা খাতের বেশির ভাগই বেসরকারি খাতনির্ভর। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে খাতটিকে ঋণবঞ্চিত করা হচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে।</p> <p style="text-align: justify;">বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি উদ্বেগজনক হারে কমেছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি খুবই এলার্মিং সিচুয়েশন দেখেছে। বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে শিল্পের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। স্মুথ অপারেশন নিশ্চিত করার জন্য শিল্পের সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি প্রয়োজন। এ ছাড়া নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সরবরাহ-উৎপাদন, ব্যবসা পরিচালনা এবং স্মুথ সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা ধরে রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’</p> <p style="text-align: justify;">ডিসিসিআই আয়োজিত বেসরকারি খাতের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিদ্যমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ পর্যালোচনায় তিনি বলেন, ‘উদ্যোক্তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের হার ডাবল ডিজিটে উন্নীতকরণ, মন্দ ঋণ কমাতে নজরদারি বাড়ানো, আর্থিক খাতে সুশাসন ও স্বচ্ছতা আনয়ন এবং ঋণের সুদহার হ্রাস একান্ত অপরিহার্য।’</p> <p style="text-align: justify;">বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ‘কলকারখানায় পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ না থাকা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা কারণে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমেছে। তিনি আরো বলেন, ‘অর্থনীতির সার্বিক অবস্থার এখনো উন্নতি না হওয়ায় ব্যবসায়ীদের নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ কম। তাঁরা ওয়েট অ্যান্ড সি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন।’ তা ছাড়া ব্যাংকের ঋণের সুদহার বেশি হওয়ায় ব্যবসা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।</p> <p style="text-align: justify;">বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর মুদ্রানীতি ঘোষণার দিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, মূল্যস্ফীতি না কমা পর্যন্ত নীতিসুদহার ১০ শতাংশে রাখা হবে। মূল্যস্ফীতি কমলে নীতিসুদহার কমানো হবে। গভর্নর বলেছেন, ব্যবসায়ীরা চাপ দিলেই যে সুদহার কমিয়ে দেব তা হবে না। আগে মূল্যস্ফীতি কমবে তারপর পলিসি রেট, আস্তে আস্তে কমানো হবে।</p> <p style="text-align: justify;">এদিকে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অন্তর্বর্তী সরকার এক লাখ চার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, যা চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরের বাজেটে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯৯ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি বাজেট মেটাতে চলতি বছরের চেয়ে বেশি মাত্রায় ব্যাংকনির্ভর হওয়া একটি নেতিবাচক দিক বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, এতে বেসরকারি খাত ঋণ পাবে না। ঋণপ্রবাহ আরো কমে যাবে। যার প্রভাব পড়বে কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগে।</p> <p style="text-align: justify;">বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) নবনির্বাচিত সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, ‘বর্তমানে দেশে একটি অন্তর্বর্তী সরকার রয়েছে, যার ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। বিনিয়োগ কমে যাওয়ার কারণে অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। যাঁরা নতুন শিল্প স্থাপন বা ব্যবসা শুরু করতে চাচ্ছেন, তাঁরাও একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের জন্য অপেক্ষা করছেন।’</p> <p style="text-align: justify;">বিজিএমইএর নতুন সভাপতি বলেন, ‘যত দ্রুত একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে একটি বৈধ সরকার গঠিত হবে, তত দ্রুত দেশের অর্থনৈতিক গতি ফিরে আসবে, বিনিয়োগ বাড়বে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে।’</p>