<p style="text-align:justify">অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য আর বিনিয়োগে দেশ এখন কঠিন সময় পার করছে। ছোট-বড় সব ব্যবসাই রীতিমতো গতিহীন। আর বিনিয়োগ পরিস্থিতিও প্রায় স্থবির। কারখানাগুলোতে গ্যাসসংকট চরমে। বন্দরে কনটেইনারজট। মহাসড়কে যানবাহনের ধীরগতি। ডলার সংকটের পাশাপাশি সংস্কার পদক্ষেপের অংশ হিসেবে অনেক ব্যাংকে এলসি খোলা ও লেনদেনে কড়াকড়ি, উচ্চ সুদের হার, গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চাহিদা কমে যাওয়া আর বৈশ্বিক ক্রেতাদের আস্থাহীনতাকেই মূলত ব্যবসা ও বিনিয়োগ স্থবিরতার জন্য দায়ী করা হচ্ছে।</p> <p style="text-align:justify">এই স্থবিরতা যেমন ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা-বিনিয়োগে চলছে, তেমনি ভুগছে বড় বড় শিল্প খাতও। দেশের আমদানি-রপ্তানি খাতের শীর্ষ উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, বহুমুখী সংকটে তাঁদের ব্যবসা ও উদ্যোগ। কারো কারো ব্যবসা ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। কেউ কেউ বলছেন, তাঁরা মুনাফা করা দূরের কথা, এখন প্রতিদিনই লোকসান গুনছেন।</p> <p style="text-align:justify">বিদেশি ক্রেতারাও তাঁদের আস্থাহীনতার কথা জানাচ্ছেন। বিদ্যমান ব্যবসা চালিয়ে নেওয়াই যেখানে কঠিন হচ্ছে, সেখানে নতুন বিনিয়োগ কিংবা ব্যবসা প্রসারের কোনো সাহসই পাচ্ছেন না তাঁরা। তবে ব্যবসায়ীরা আশা করছেন, অন্তর্বর্তী সরকার এরই মধ্যে পদক্ষেপ নিয়েছে। সামনে পরিস্থিতির উন্নয়ন হবে।</p> <p style="text-align:justify">তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনার পাশাপাশি দেশের সমসাময়িক ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে কয়েকটি বড় গ্রুপ, উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা, আমদানি ও রপ্তানিকারকের সঙ্গে কয়েক দিন ধরে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা প্রায় সবাই দেশের বিদ্যমান ব্যবসা-বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।</p> <p style="text-align:justify">জানা যায়, গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী অচলাবস্থায় চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি-রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনারের স্তূপ জমে গেছে। এখনো তা স্বাভাবিক হয়নি। বন্যার কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক প্রায় অচল হয়ে পড়েছিল কয়েক দিন। এটি মাত্র স্বাভাবিক হয়েছে। তবে যানজট কাটেনি। এখনো পণ্যবাহী কনটেইনার বন্দরে পৌঁছাতে দিন পার হয়ে যাচ্ছে। এতে রপ্তানি পণ্যের লিড টাইম বেড়ে গিয়ে খরচ বাড়ছে। আমদানি পণ্য ঠিকমতো ঢাকা কিংবা দেশের বাজারে পৌঁছাতে দেরি হওয়ায় তা-ও খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে।</p> <p style="text-align:justify">শিল্পের কাঁচামাল সময়মতো কারখানায় পৌঁছাতে পারছে না। আর গত সরকারের সময় থেকেই গ্যাসসংকট প্রকট হয়েছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়া আর ডলার সংকটের কারণে ঠিকমতো জ্বালানি তেল ও গ্যাস আমদানি করা যায়নি। ফলে শিল্প-কারখানায় বিদ্যুৎ-গ্যাস সংকট বাড়ে। এক পর্যায়ে ব্যবসায়ীরা বেশি দাম দিয়ে গ্যাস কিনতে বেশি মাসুল দিচ্ছেন, এর পরও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ পাচ্ছেন না। ফলে অনেক সময় কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে।</p> <p style="text-align:justify">মূল্যস্ফীতি কমাতে গত সরকারের সময় থেকে কয়েক দফা ব্যাংকঋণের সুদের হার বাড়ানো হয়েছে। কয়েক দিন আগেও নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে ব্যাংকগুলো আবারও ঋণের সুদের হার বাড়াতে যাচ্ছে। এখন বেসরকারি খাতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৬ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিয়ে ঋণ নিতে হচ্ছে। এটা ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি চলে গেছে। যাঁরা আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত তাঁদের কমবেশি সবারই ব্যবসার খরচ অনেক বেড়ে গেছে।</p> <p style="text-align:justify">একদিকে বেশি দামে ডলার কিনে এলসি খুলতে হচ্ছে, অন্যদিকে ব্যবসা বা বিনিয়োগের জন্য ঋণও নিতে হচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ সুদে। এভাবে ব্যবসা-বিনিয়োগ প্রসারে খরচ বেড়ে যাওয়ায় তাঁরা ক্ষতির মুখে আছেন। সম্প্রতি বিতর্কিত এস আলম গ্রুপের লুটপাটের কারণে ছয়-সাতটি ব্যাংক প্রায় নাজুক অবস্থায় চলে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব ব্যাংক সংস্কারের পদক্ষেপ নেয়। এরই অংশ হিসেবে পর্ষদ ভেঙে দেয়। এমনকি এসব ব্যাংক কোনো ঋণপত্রও (এলসি) খুলতে পারছে না।</p> <p style="text-align:justify">এর পাশাপাশি ব্যাংক থেকে টাকা তোলায়ও কড়াকড়ি চলছে। একজন গ্রাহক সপ্তাহে মাত্র চার লাখ টাকা তুলতে পারছেন। এর ফলে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী যাঁদের প্রতিদিনই লেনদেন করতে হয়, তাঁরা পণ্য কেনা বা বুকিংয়ের দায় শোধেও সমস্যা মোকাবেলা করছেন।</p> <p style="text-align:justify">এসব সমস্যার সঙ্গে যোগ হয়েছে গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সহিংসতা, লুটপাটের ঘটনা। এসব অপ্রীতিকর ঘটনা এখনো চলছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে কারখানায় আগুন দেওয়া, ভাঙচুর অব্যাহত থাকায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, এমনকি কারখানা বন্ধও রাখতে হচ্ছে। এসব ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য কয়েক দিন আগে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে দেখা করেছেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী ও বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা। তাঁরা অবিলম্বে ব্যবসাবান্ধব পরিস্থিতি কামনা করে সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।</p> <p style="text-align:justify">বৈঠকে উপস্থিত এফবিসিসিআইয়ের বর্তমান ও সাবেক দুই প্রেসিডেন্টের সঙ্গেই কথা হয় এই প্রতিবেদকের। এ ব্যাপারে শীর্ষ এই ব্যাবসায়িক সংগঠনের প্রেসিডেন্ট মাহবুবুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা সরকারকে বিষয়টি জানিয়েছি। আমরা বলেছি, পণ্যের সাপ্লাই চেইন ঠিক করতে হবে। ব্যবসায়ীরা যাতে ব্যবসা করতে পারেন, এলসি খুলতে পারেন—এই নিশ্চয়তা দিতে হবে। তাঁরা যেন কাঁচামাল ও নিত্যপণ্য স্বাভাবিকভাবে আমদানি করতে পারেন সেদিকেও নজর দিতে হবে।</p> <p style="text-align:justify">কাস্টমসের বেশ কিছু সমস্যা আছে। সেগুলোও নিষ্পত্তি করতে হবে। আমরা এনবিআর চেয়ারম্যানকেও বিষয়টি জানিয়েছি। বন্দর ও মহাসড়কের ধীরগতির কিছুটা উন্নতি হচ্ছে। এটা যেকোনো মূল্যে সচল রাখতে হবে। আশা করি শিগগিরই পরিস্থিতির উন্নতি হবে।’</p> <p style="text-align:justify">এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট মীর নাসির হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখন অগ্রাধিকার হলো আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা। বৈশ্বিক ক্রেতাদের আস্থা ফিরিয়ে আনা, যাতে আমাদের যেটুুকু ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে উঠতে পারি। এখানে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতেরও দায়িত্ব রয়েছে। সরকারও সহমর্মী। সরকারের বয়স তো বেশি হয়নি। একটু ধৈর্য ধরতে হবে। শিগগিরই সব পাওয়া যাবে না। কিছু সমস্যা আগে থেকেই ছিল। রাতারাতি এর সমাধান সম্ভব নয়। আমি আশাবাদী।’</p> <p style="text-align:justify">পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর প্রেসিডেন্ট খন্দকার রফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন. ‘আমাদের কারখানাগুলোতে একটি সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠী অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করছে। ভাঙচুর-লুটপাট করছে। ক্রেতাদের কাছে ভুল বার্তা যাচ্ছে। যদিও আমরা তাঁদের যতটা পারি বোঝানোর চেষ্টা করছি। তাঁরা আশাবাদী যে পরিস্থিতি আরো স্বাভাবিক হবে।</p> <p style="text-align:justify">তবে এই পরিস্থিতিতে আমরা নতুন কোনো বিনিয়োগে যেতে পারছি না। এমনকি ব্যবসা প্রসারেও কোনো চিন্তা আপাতত নেই। দেশের আর্থিক খাতেও স্থিতিশীলতা দরকার। ক্রেতারা যদি জানেন যে কোনো কোনো ব্যাংকে এলসি খুলতে সমস্যা, তখন তাঁরা আতঙ্কিত হন। তবে আশা করি, সরকার পরিস্থিতির দ্রুত উন্নয়নে সক্ষম হবে।’</p> <p style="text-align:justify">কথা হয় দেশের অন্যতম শীর্ষ ব্যবসায়ী গ্রুপ প্রাণের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াস মৃধার সঙ্গে। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এমনিতেই অনেক দিন ধরে অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি স্লথ। এর মধ্যে গত প্রায় দেড় মাস আন্দোলন ও ক্ষমতার পালাবদলের প্রেক্ষাপটে দেশের একটি গোষ্ঠী, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ঘরানার মানুষ রীতিমতো আত্মগোপনে। তাঁরা বলতে গেলে প্রকাশ্যে আসছেন না। তাঁদের কোনাকাটা কমে গেছে। আবার তাঁদের অনেকে আমাদের এজেন্ট বা ডিস্ট্রিবিউটর ছিলেন। তাঁরা দোকানপাট খুলছেন না। স্বাভাবিক ব্যবসায় ফেরেননি।</p> <p style="text-align:justify">আমাদের উৎপাদন প্রায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কমে গেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকের পর্ষদ পরিবর্তন হচ্ছে। ফলে অনেক করপোরেট হাউসের ঋণ পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। সব মিলিয়ে একটা আস্থার জায়গা তৈরি করতে হবে। সরকার যদি শক্ত বার্তা দেয় যে কোনো অন্যায় হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তাহলে ব্যবসায় পরিস্থিতির উন্নতি হবে।’</p> <p style="text-align:justify">দেশের নির্মাণশিল্পের উপকরণ রড ও স্টিল খাতও ধুঁকছে। খাতটির প্রবৃদ্ধি তো বাড়েইনি বরং কমেছে। উদ্যোক্তারা জানান, গ্যাসসংকটে তাঁদের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এর সঙ্গে ডলারসহ নানা সমস্যায় তাঁদের লোকসান হচ্ছে। ব্যবসার প্রসার নেই, বরং ৩৬-৩৭ শতাংশ নেতিবাচক অবস্থায় চলছে ব্যবসা।</p> <p style="text-align:justify">এ ব্যাপারে বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারন সম্পাদক সুমন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গ্যাসসংকটে কারখানা ঠিকমতো চলছে না। সুদের হার ৯ শতাংশ থেকে ১৫-১৬ শতাংশ। ডলারের উচ্চ দর। এর মধ্যে বন্যার কারণে সাপ্লাই চেইনে সমস্যা। বিক্রি নেই। দোকানদাররা বলেন, মাল নিয়ে কী করব? সরকারি-বেসরকারি সব খাতের উন্নয়নকাজ বন্ধ। বাজারে চাহিদাই নেই। সব মিলিয়ে স্টিল খাতের অবস্থা করুণ। এভাবে চললে কিভাবে শিল্পায়ন হবে?’</p> <p style="text-align:justify">পুরান ঢাকার মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আজমল হক বাবলু জানান, এমনিতেই ডলার সংকটে আমদানির জন্য এলসি খোলা যাচ্ছে না। তার ওপর উচ্চ সুদের হারে ব্যবসা এখন কঠিন সময় পার করছে। লেনদেনেও কড়াকড়ি রয়েছে। এ ছাড়া চলমান পরিস্থিতির কারণেও চাহিদা কমে গেছে।</p> <p style="text-align:justify">কুমিল্লায় প্রায় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে রপ্তানিমুখী চামড়া ও চামড়াজাতীয় পণ্যের কারখানা করেছেন শাহজাদা আহমেদ রনি। তিনি জানান, কিছুদিন ধরেই বিদ্যমান পরিস্থিতির কারণে ক্রেতারা অর্ডার বাতিলের হুমকি দিচ্ছেন। তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করছেন। ভয়ে-আতঙ্কে কারখানা খোলা রেখেছেন। ইচ্ছা ছিল সামনে কারখানা বাড়াবেন। তবে পরিস্থিতির কারণে এখন আর সেই চিন্তা করছেন না।</p>