<p>করোনা সংকটে বিশ্বজুড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে যে ধাক্কা এসেছে সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে চীন থেকে কারখানা সরাতে চায় জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। দেশগুলো বলছে, তারা এক দেশের ওপর নির্ভর থাকতে চায় না। কভিড-১৯ জানিয়ে দিয়েছে এই একদেশ-নির্ভরতা কতটা বিপজ্জনক আর অসহায় পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। তাই চীন থেকে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ইউনিটগুলো সরিয়ে নিয়ে অনুকূল পরিবেশের কোনো দেশে বসাতে তৎপর হয়ে উঠেছে দেশগুলো। এই সুযোগ কাজে লাগাতে এখন বেশ তৎপর হয়ে উঠেছে ভিয়েতনাম, ভারত, ইন্দোনেশিয়া এবং আরো কিছু দেশ। প্রশ্ন উঠেছে এসব কম্পানিকে নিজ দেশে আনার সুযোগ কি বাংলাদেশ কাজে লাগাবে? জানা যায়, বিনিয়োগ বিকাশে নিবেদিত বাংলাদেশের দুটি সংস্থা এই অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাদের তৎপরতা সরকারের সঙ্গে চিঠি চালাচালির মধ্যে সীমিত রেখেছে। সংস্থা দুটি হলো বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)।</p> <p>এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বলেন, ‘শিল্প-কারখানা আকর্ষণে বাংলাদেশকে সুস্পষ্ট ও ফলপ্রসূ কিছু প্রস্তাব দিতে হবে। তবে তার আগে আমলাতন্ত্রের সামগ্রিক মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। নিয়ন্ত্রণ না করে ব্যবসা-বাণিজ্যকে কিভাবে আরো সহজ করে দেওয়া যায় সে উদ্দেশ্যেই এই পরিবর্তন জরুরি।’</p> <p>দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ার জন্য কাজ করছে বেজা। এর মধ্যে তিনটি নির্দিষ্ট করা আছে জাপান, ভারত ও চীনের জন্য। যাতে তারা বাংলাদেশে তাদের পণ্য উৎপাদন ইউনিট সহজে স্থাপন করতে পারে। শতভাগ রপ্তানিমুখী জাপানি বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ কিছু প্রণোদনা প্যাকেজ তৈরির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিচ্ছে বেজা। এ ব্যাপারে তারা যে সুপারিশমালা তৈরি করেছে সেগুলো অনুমোদনের জন্য সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে।</p> <p>বর্তমানে বেজা রপ্তানি অঞ্চলের বিনিয়োগকারীদের ১০ বছরের ট্যাক্স হলিডের সুযোগ দিয়েছে। এর মধ্যে তিন বছর সম্পূর্ণরূপে কর মওকুফ থাকবে। পরবর্তী সাত বছর এ ছাড় ক্রমান্বয়ে কমে আসে। পবন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা এখন নতুন একটি প্যাকেজ দিতে চাচ্ছি, যাতে তিন বছরের এ ছাড় আরো বর্ধিত হবে। যেমন বেজা প্রস্তাব করেছে যেসব কম্পানি কমপক্ষে ১০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে তাদের ট্যাক্স হলিডে দেওয়া হবে সাত বছরের জন্য এবং যারা কমপক্ষে ২০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে তাদের দেওয়া হবে পুরো ১০ বছরের জন্যই।’</p> <p>জানা গেছে, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বেজা ১৫১টি দেশি ও বিদেশি প্রতিষ্ঠান থেকে দুই হাজার কোটি ডলারের ওপর বিনিয়োগ প্রস্তাব পেয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে এরই মধ্যে প্রায় ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ হয়েও গেছে। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, ভারত, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও মালয়েশিয়া থেকে আসবে প্রায় ৫৭৮ কোটি ডলার বিনিয়োগ।</p> <p>কভিড-১৯ পরবর্তী পরিস্থিতিতে বিশ্বে বিনিয়োগ চিত্রের আমূল পরিবর্তন ঘটবে। তাই বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে প্রতিটি দেশকে বিশেষ প্রচেষ্টা চালাতে হবে। বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম সম্প্রতি জানিয়েছেন, বিদেশি বিনিয়োগ টানতে তাঁরা প্যাকেজ প্রস্তাবনা তৈরি করছেন। ‘বিডা শুধু সুপারিশমালা পেশ করতে পারে’ উল্লেখ করে তিনি জানান, জাপানের দুটি সংস্থার সঙ্গে তিনি বিনিয়োগ সুবিধা নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন, যার একটি হচ্ছে ‘জাইকা’ অন্যটি ‘জেটরো’।</p> <p>পিডাব্লিউসি (প্রাইসওয়াটারহাউস কুপার্স) বাংলাদেশের ম্যানেজিং পার্টনার মামুন রশীদ বলেন, ‘চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধের ফায়দা তুলতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। এখন দ্বিতীয় সুযোগ এসেছে। সুযোগটা কি আমরা নেব না?’</p> <p>কম্পানি আনতে তৎপর ভারত : চীন থেকে কম্পানিগুলোকে যাতে নিজ দেশে নিয়ে আসা যায় এ জন্য ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছে ভারত। কম্পানিগুলোকে জায়গা দিতে তারা এত জমি আলাদা করে রেখেছে যার আয়তন দুটি লুক্সেমবার্গের (ক্ষুদ্র ইউরোপীয় দেশ) সমান। সম্প্রতি ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের হাজারের অধিক কম্পানিকে চীন থেকে নিজেদের ঘরে নিয়ে আসতে চায় ভারত। এর মধ্যে রয়েছে মেডিক্যাল ডিভাইস জায়ান্ট অ্যাবট ল্যাবরেটরিজসহ বড় আরো অনেক কম্পানি। গত এপ্রিল পর্যন্ত ভারত সরকার ও তাদের বিদেশি মিশন এক হাজারের অধিক আমেরিকান কম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তাদের ম্যানুফেকচারিং প্লান্টগুলো চীনের বদলে ভারতে আনার জন্য বিভিন্ন প্রণোদনার অফার করা হচ্ছে।</p> <p>নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভারতীয় কর্মকর্তাদের একটি সূত্র জানায়, ভারত মেডিক্যাল সরঞ্জাম উৎপাদন ও সরবরাহকারী, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ প্রতিষ্ঠান, টেক্সটাইল, চামড়া, গাড়ির যন্ত্রাংশ ইত্যাদি খাতের কম্পানিগুলোকে প্রাধান্য দিচ্ছে। আলোচনায় অন্তত ৫৫০টি খাতের কম্পানির সঙ্গে কথা হয়েছে। চীনে থাকা জাপানি কম্পানিগুলোকেও প্রভাবিত করছে নয়াদিল্লি।</p> <p>পিছিয়ে নেই ভিয়েতনাম : উৎপাদন নৈপুণ্য আর পণ্যমান রক্ষায় একনিষ্ঠতার পরিচয় দেওয়ায় ভিয়েতনাম এরই মধ্যে ‘চায়না প্লাস ওয়ান’ (চীনে যা পাওয়া যায়, এরাও তা দিতে সক্ষম) বলে অভিহিত হতে শুরু করেছে। ফলে চীন ছাড়তে আগ্রহী অনেক কম্পানির কাছে তুলনামূলক অগ্রাধিকার পাচ্ছে ভিয়েতনাম। এসব কম্পানিকে কাছে টানতে তাঁরা প্রশাসনিক প্রক্রিয়াও সহজ করে দিচ্ছে। ব্যবসা ও বিনিয়োগ সহজীকরণে গুরুত্ব দিচ্ছে।</p> <p>চীনের অদূরে অবস্থিত হওয়ায় ভিয়েতনামে যন্ত্রপাতি স্থানান্তর ব্যয়ও হবে কম। তা ছাড়া এ দেশে আগে থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য করছে আন্তর্জাতিকভাবে সুখ্যাত অনেক কম্পানি। সবচেয়ে বড় কথা, কভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে দ্রুত সাফল্য দেখিয়ে ভিয়েতনাম বিশ্বের প্রশংসাও পেয়েছে। এই বিষয়গুলো তাদের ব্যাপারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মনে দৃঢ় আস্থা তৈরির সহায়ক বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।</p> <p>এর সমান্তরালে চীন ছাড়তে প্রস্তুত প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলাদেশে আনার ব্যাপারে বেজা ও বিডার চলমান তৎপরতা অনেকটাই ‘চীন পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণের গুরুত্ব’ বর্ণনা করে সরকারকে লেখা চিঠিপত্র আদান-প্রদানেই সীমিত রয়েছে বলে জানা গেছে।</p>