<article> <p style="text-align: justify;">একটি দেশের চলমান রাজনীতি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রতি যদি সাধারণ জনগণের আস্থা ক্রমে তলানিতে চলে যায়, তাহলে সেই দেশটিকে অবশ্যই দুর্ভাগা বলতে হবে। এমন একটি দুর্ভাগ্য বরণ করছে যেন বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশের ভাগ্য এমন হওয়ার কথা ছিল না। উজ্জ্বল ঐতিহ্য নিয়ে হাজার বছর ধরে এগিয়ে চলা গর্বিত দেশ বাংলা।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">যুগে যুগে নানা রাজনৈতিক পালাবদল ঘটেছে এ দেশে। আট শতকের মাঝপর্ব থেকে বৌদ্ধ পাল রাজারা কী মমতায় অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রায় ৪০০ বছর ধরে বাংলাকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। এরপর বাংলার সিংহাসন দখলকারী দাক্ষিণাত্য থেকে আসা ব্রাহ্মণ সেন শাসকরা সুশাসন উপহার দিতে পারেননি। ফলে ধীরে ধীরে জনবিক্ষোভ তৈরি হয়।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">তাই ১৫০ বছরের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে সেন শাসকদের দম্ভ। জনপ্রতিরোধ না থাকায় তেরো শতকের শুরুতেই বহিরাগত তুর্কি রক্তধারী সুলতানদের হাতে বাংলার কর্তৃত্ব চলে যায়।</p> <p style="text-align: justify;">সুলতান ও মোগল যুগ মিলে প্রায় ৬০০ বছরের মুসলিম শাসন ছিল বাংলার সমৃদ্ধির গৌরবময় কাল। ফিরে আসে অসাম্প্রদায়িক আবহ।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">আবার হোঁচট খেতে হয় আঠারো শতকের মাঝপর্বে পলাশীর বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে। ইংরেজদের ২০০ বছর ভালো-মন্দের মিশেলে কালাতিপাত করতে হয়েছিল বাঙালিকে। ভারত বিভাজন এ দেশবাসীকে স্বস্তি দিতে পারেনি। পাকিস্তানি শাসকদের বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে শুরু থেকেই প্রতিবাদী হতে হয়েছে বাঙালিকে। এ সময় থেকে নিজেদের রাজনৈতিক পরিচিতি গড়ে উঠতে থাকে বাঙালির।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">শেরেবাংলা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানীর মতো নেতারা সততার সঙ্গে বিভিন্ন যুগপর্বে বাঙালির রাজনৈতিক চেতনাকে সমৃদ্ধ করেন। পাকিস্তানবিরোধী উত্তাল রাজনীতির পাঞ্জেরি হিসেবে এক পর্যায়ে রাজনীতির মঞ্চে দৃঢ়ভাবে হাল ধরেন শেখ মুজিব। রাজনীতির উত্তাল পথে নেতৃত্ব দিয়ে বঙ্গবন্ধু হয়ে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতার আসনে বসেন এই মহান মানুষটি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলার রাজনীতি বাঙালির আশা-ভরসার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় এ সময়। রাজনীতির প্রতি মানুষের আস্থা ও ভরসা ছিল বঙ্গবন্ধু পর্বে। এই আস্থা আর প্রত্যাশার শক্তিতেই এ দেশবাসী মুক্তিযুদ্ধে সফল হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সোনার বাংলা গড়ার পথে স্বপ্ন বুনেছিল বাঙালি, কিন্তু দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের থাবা বিদীর্ণ করে বাঙালির স্বপ্নের ভুবনকে। বাঙালির কাণ্ডারি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয় নির্মমভাবে।</p> <p style="text-align: justify;"><img alt="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/06.June/21-06-2024/2/kalerkantho-ed-1a.jpg" height="288" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/06.June/21-06-2024/2/kalerkantho-ed-1a.jpg" width="321" />বাঙালির রাজনীতির সুস্থ ধারা আবার হোঁচট খায়। এমন পরিবর্তিত বাংলাদেশে নতুন রাজনীতি নিয়ন্ত্রকের পোশাকে আবির্ভূত হন সেনাপুরুষ জিয়াউর রহমান। গণতান্ত্রিক ধারার অবসান ঘটিয়ে, মুক্তিযোদ্ধার গৌরব পেছনে ফেলে সময়ের সুবিধায় গণতান্ত্রিক ধারার অবসান ঘটান তিনি। অনেকটা নিজেই নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে ক্ষমতার মসনদ কেড়ে নিলেন। তাঁর গড়া বিএনপি নামের দলটিকে নিয়ে দেশপ্রেমের শক্তিতে রাজনৈতিক নতুন দর্শন নিয়ে দেশ গড়ায় ভূমিকা রাখতে পারতেন। কিন্তু জিয়াউর রহমানের জন্য তা কঠিন ছিল। কারণ পাকিস্তান পর্বের দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসে তিনি ছিলেন একজন অজ্ঞাত পুরুষ। কোনো রাজনৈতিক উত্তরাধিকার তাঁর ছিল না। তবু তিনি নিজের প্রজ্ঞা ও দেশপ্রেমের শক্তিতেই মানুষের আশাবাদের প্রতীক হতে পারতেন। তেমন প্রেক্ষাপটও তাঁর ছিল। কারণ বঙ্গবন্ধু-উত্তর আওয়ামী লীগ নেতাদের তখন ছন্নছাড়া দশা। এমন পরিস্থিতির আনুকূল্য গ্রহণের সুযোগ তিনি গ্রহণ করতে পারতেন।</p> <p style="text-align: justify;">অধিক কালক্ষেপণের দরকার পড়েনি। অচিরেই জিয়াউর রহমান স্বরূপ উন্মোচন করলেন। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত পক্ষ পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু হয়ে গেলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বড় রাজাকার শাহ আজিজুর রহমানকে বানালেন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। পাকিস্তানি এজেন্ডা পালন করতে থাকলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসেবে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় না করিয়ে খুনিদের আশ্রয়দাতা হয়ে গেলেন। কলঙ্কিত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে খুনিদের বিচারের পথ বন্ধ করে দিলেন। এবার পুরস্কৃত করা শুরু করলেন খুনিদের। তাদের অনেককে বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন করলেন। তা ছাড়া সেনাবাহিনীতে দায়িত্ব পালন করা মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের করতে থাকলেন কোণঠাসা। পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনা কর্মকর্তা—যাঁরা পাকিস্তানি পন্থা মগজে নিয়ে এসেছেন, তাঁরা সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেতে থাকলেন। সেনানিবাসের গোপন বিচারের ছলনায় অনেক মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে নিজের পথকে নিষ্কণ্টক করতে থাকলেন। এভাবে নিজেই কলঙ্কিত করলেন নিজের মুক্তিযোদ্ধা পরিচিতি।</p> <p style="text-align: justify;">নিজের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে গিয়ে বিভিন্ন দল থেকে সুবিধাবাদী রাজনৈতিক নেতাদের বিএনপিতে যুক্ত করলেন জিয়াউর রহমান। এবার মুক্তিযুদ্ধ না দেখা তরুণ প্রজন্মের একাংশকে অর্থ ও অস্ত্রশক্তির লোভে ফেলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিচ্ছিন্ন করতে লাগলেন। আরেক অংশের আদর্শিক চেতনাকে সুচতুরভাবে খণ্ডিত করলেন। বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে বিকৃতভাবে ভিলেন বানাতে লাগলেন। এভাবে জিয়াউর রহমান তাঁর দলে একটি বড় সমর্থকগোষ্ঠী তৈরি করতে সক্ষম হন, যা মোকাবেলা করার ক্ষমতা সে সময়ের দুর্বল আওয়ামী লীগ বা রাজনীতিতে বিধ্বস্ত বাম নেতাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এভাবে চলমান রাজনীতির প্রতি মানুষের আস্থা কমে যেতে থাকে।</p> <p style="text-align: justify;">জিয়াউর রহমান নিহত হলে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি আবার সংগঠিত হয় জিয়াউর রহমানের আদর্শ ও কূটনীতিকে ধারণ করে। পাকিস্তান-পন্থা আরো সক্রিয় হয়। এবার খালেদা জিয়ার মন্ত্রিপরিষদ কালিমা লিপ্ত হয় একাত্তরের ঘাতক, বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী রাজাকার, আলবদরদের অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে। দেশ ঘোরতর অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যায়। ইতিহাস বিকৃত করে পাকিস্তানবিরোধী দীর্ঘ আন্দোলনে অচেনা জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে প্রচার করতে থাকে। ১৫ আগস্টের শোক আর শক্তিকে নতুন প্রজন্মের কাছ থেকে সরিয়ে রাখতে খালেদা জিয়ার জন্মদিন পরিবর্তন করার নিকৃষ্ট পথে হাঁটতে থাকলেন বিএনপি নেতারা। মুক্তিযুদ্ধের এক যুগ পরে জন্ম নেওয়া আমার অনেক বিএনপিভক্ত ছাত্রের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, ওরা বিএনপির এই অন্ধকার অতীতটা জানে না। আওয়ামী লীগবিরোধী একটি মনোভাব তৈরি করা হয়েছে ওদের সামনে। এর দায় বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতাদেরও কম নয়।</p> <p style="text-align: justify;">তবে অবস্থা পাল্টাতে থাকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা প্রবাস থেকে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরার পর। এই ঐতিহ্যবাহী দলটি নিজের মতো করে ঘুরে দাঁড়ালে সবচেয়ে ভালো ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর শূন্যতা তো পূরণ সম্ভব নয়। তাই আওয়ামী লীগ নিজের ঐতিহ্য-আভিজাত্য ভুলে বিএনপির প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়াতে থাকল। আচরণে দেখা গেল তারা বঙ্গবন্ধুকে জিয়াউর রহমানের পাশে প্রতিযোগী হিসেবে দাঁড় করাল যেন। নতুন প্রজন্মের সামনে  মেসেজ সেভাবেই গেল। এতে লাভ হলো জিয়াউর রহমানের। রাজনীতির মাঠে তিনি অভিজাত হয়ে উঠলেন। এমন বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ অনুসারী নতুন প্রজন্ম বিভ্রান্ত হতেই পারে। দিশাহারা আওয়ামী লীগ নেতারাও দ্রুত রাষ্ট্রক্ষমতায় চলে আসার জন্য রাজনীতির সরল পথে না হেঁটে নানা গলিপথ খুঁজতে লাগলেন। এভাবে গণতান্ত্রিক ধারাকে দুর্বল করে দিয়ে নানা চাতুর্যে ক্ষমতায় যাওয়া ও টিকিয়ে রাখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন। আওয়ামী লীগ সরকার নিয়ন্ত্রকদের ক্ষমতাপ্রিয় মনোভাব সিভিল প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও ব্যবসায়ীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল করে দেয়। নির্বাচন সহযোগী এসব পক্ষকে দুধ কলা দিয়ে পুষতে থাকে। নিকট অতীতের রাজনৈতিক দলগুলোর মতো প্রশাসনিক শক্তি আর অর্থ শক্তি দিয়ে নির্বাচন গড়াপেটায় একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে সরকারি দল। আওয়ামী লীগও এ ধারার বাইরে নয়। এর বিষময় প্রভাব দেখা যাচ্ছে সমাজে আর মানুষের জীবনযাত্রায়। দলীয় সরকারের নৈতিক শক্তির দুর্বলতার সুযোগে দুর্নীতি শাখা-প্রশাখা মেলে। পঙ্গু করে দিতে থাকে দেশের অর্থনীতিকে। বাজার নিয়ন্ত্রণের লাগাম হাতছাড়া হয়ে যায়। এমন বাস্তবতায় রাজনীতির প্রতি মানুষের আস্থা কেমন করে থাকে!</p> <p style="text-align: justify;">ক্ষমতার রাজনীতিতে দাপুটে সব দলের অভিন্ন চরিত্রে এখন মুখ থুবড়ে পড়ছে গণতন্ত্র। সবচেয়ে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে মানসিকভাবে সাধারণ মানুষের রাজনীতিবিচ্ছিন্নতা। মানুষ ক্রমে রাজনীতির প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে পড়ছে। রাজনীতিবিদদের প্রতি আস্থা হারাচ্ছে। ভরসা করতে পারছে না কাউকে। এ দেশের ক্ষমতাসীনরা বড় একটি ধাক্কা খাওয়ার আগ পর্যন্ত ক্ষমতার দাপটে মুক্তদৃষ্টিতে সংকট দেখতে পান না। হোঁচট খাওয়ার আগ পর্যন্ত ভাবেন ঠিক দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেন। যথার্থ নীতি নির্ধারণের বদলে নেতাদের কণ্ঠ চলে বেশি। এসব এখন সাধারণ মানুষের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।</p> <p style="text-align: justify;">যে পথে হাঁটছে সঠিক নেতৃত্বহীন বিএনপি, তাতে দলটির রাজনৈতিক সংকট আরো তীব্র হবে। সাধারণ মানুষের আস্থা থেকে আরো দূরে সরে যাবে। একইভাবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের অবাস্তব পথে ক্ষমতার দম্ভ নিয়ে হাঁটা এ দেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে এগিয়ে চলা রাজনৈতিক দলের মারাত্মক আক্রা রয়েছে এ দেশে। আওয়ামী লীগ নেতাদের বড় দুর্বলতা এখন কঠিন দলতন্ত্রে আটকে রেখে আমলা ও ব্যবসায়ী নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়া। মুক্তিযুদ্ধ আর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আস্থাশীল অনেক যোগ্য মানুষকে কাছে টেনে কূপমণ্ডূকতা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত দলটির। তা না করে আওয়ামী লীগও যদি পথ হারায়, তাহলে অসীম অন্ধকার ছাড়া এ দেশের ভাগ্যে আর কী অবশিষ্ট থাকবে?</p> <p style="text-align: justify;"><strong>লেখক :</strong> অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়</p> <p style="text-align: justify;">shahnawaz7b@gmail.com.</p> </article>