<p>ইউরোপে ১৭ শতকে ইসলামী জ্ঞানের বিপ্লব বা বৈজ্ঞানিক জাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, আরবদের সাহায্য ছাড়া আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতার কল্পনাও করা যায় না।</p> <p>মরিস বুকাইলি তাঁর বিখ্যাত বই ‘বাইবেল, কোরআন এবং বিজ্ঞান’-এ উল্লেখ করেছেন, ‘কোরআনের এমন কোনো আয়াত নেই, যেখানে প্রকৃতির বৈচিত্র্য ও জ্ঞানের বর্ণনা নেই, যা বিজ্ঞানের নব আবিষ্কারের সঙ্গে কোনোক্রমেই সাংঘর্ষিক নয়।’</p> <p>জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানদের শক্তিমত্তা : মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকালের প্রায় ১০০ বছরের মধ্যে মুসলমানরা তখনকার প্রচলিত বিজ্ঞানে সেরা অবদান রেখেছিল। তারা ‘বায়তুল হিকমার’ মতো গবেষণাপ্রতিষ্ঠান কায়েম করে বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ উন্নয়ন ও প্রয়োগে অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছিল, যা পরবর্তী সময়ে প্রায় এক হাজার বছর পর্যন্ত প্রভাবশালী ভূমিকায় অবস্থান করছিল। </p> <p>আমরা দেখতে পাই, ইসলামী বিশ্বাস থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অনবদ্য অবদান রেখেছিল, যা পরবর্তী প্রায় ৮০০ বছর মুসলমানদের অনন্য অবদান বিশ্বকে উপকৃত করেছে। </p> <p>ব্রায়ান স্টক তাঁর ‘হিস্ট্রি অব সায়েন্স’ বইয়ে উল্লেখ করেন, ‘বিজ্ঞানের সব ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবদান সম্পর্কে আমরা যদি তাকাই, তাহলে দেখা যাবে, বিজ্ঞানে তাঁরা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। তাঁদের মধ্যে আল-কিন্দি, আল-খাওয়ারিজমি, আল-রাজি, আল-ফারাবি, আল-বিরুনি, এভাইসনা, আল-হাজন এবং অ্যাভারোস ছিলেন অন্যতম, যারা আংশিকভাবে বা সার্বক্ষণিকভাবে বিজ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত ছিলেন।’</p> <p>বিজ্ঞানের আধুনিক ভিত্তি : এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, আধুনিক বিজ্ঞানের মূল ভিত্তি হচ্ছে ইসলাম। তার কারণ প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের জ্ঞান অর্জন ও চর্চার জন্য ইসলামই প্রথম উৎসাহিত করেছে। </p> <p>প্রফেসর ওয়াহিদউদ্দিন বলেছেন, ‘প্রাচীনকালে শিরকের প্রভাবের কারণে প্রকৃতি সম্পর্কে মানুষের গবেষণা ও জ্ঞান আহরণের বিষয়টি চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। ইসলামের আগমনের পরই এ অবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে আর আধুনিক মানবিক চিন্তা-চেতনায় ইসলাম তা প্রতিষ্ঠিত করেছে।’</p> <p>প্রকৃতি শিক্ষার জন্য অবারিত : প্রকৃতি উপাসনার বিষয় থেকে অপসারিত হয়ে একটি গবেষণার বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ কারণে মুসলমানরা প্রকৃতি কিভাবে কাজ করে তার রহস্য উদঘাটনে চেষ্টা করেছে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে তাকে বাস্তবে প্রয়োগ করেছে। </p> <p>এ বিষয়ে জর্জ সালিবা বলেন, ‘এটা সবার জানা যে ইসলামী সভ্যতা প্রতিষ্ঠা হয়েছিল মক্কা ও মদিনা এবং দক্ষিণ আরবের মরু এলাকা ও শহর ঘিরে। তবে সেগুলো নিরেট মরু অঞ্চল ছিল না। এই পরিবেশেই প্রাক-ইসলামিক আরবীয় সভ্যতার বিকাশ ঘটে এবং তাতে কিছু জ্যোর্তিবিদ্যা ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের উদ্ভব হয়, যা ইসলামিক সভ্যতার সময়কালে বিরাজমান ছিল। আমি প্রাক-ইসলামিক আরবের বিজ্ঞানবিষয়ক জ্ঞানের সারাংশ তৈরির চেষ্টা করেছি এবং এর পরিসমাপ্তি টানতে পেরেছি যে তখন বিজ্ঞানের যেসব তথ্য ছিল তা পার্শ্ববর্তী বাইজেন্টাইন, সাসানিয়ান ইরান অথবা ভারতের বিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য থেকে তেমন আলাদা ছিল না।’</p> <p>ডব্লিউ ডুরান্ট তাঁর ‘দ্য স্টোরি অব সিভিলাইজেশন’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘ইতিহাসের এক চরম শিখরে এমন একটি সমাজ ছিল যেখানে সরকার, শিক্ষা, সাহিত্য, দর্শন, ভুগোল, ইতিহাস, গণিত, জ্যোর্তিবিদ্যা, রসায়ন ও মেডিসিন প্রতিটি ক্ষেত্রে এমন সব বিখ্যাত লোকজন ছিল, যারা হারুন-আর রশিদ এবং অ্যাভোরোসের মাঝামাঝি চতুর্থ শতকের ইসলামী আমলে প্রতিষ্ঠিত ছিল।’</p> <p>আসলে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে কোরআনের চরম সত্যের প্রতিফলন। মরিস বুকাইলি তাঁর বই ‘বাইবেল, কোরআন অ্যান্ড সায়েন্স’-এ আলোচনা শেষ করেছেন এভাবে, ‘ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর সময়ে জ্ঞানের পর্যায় এমন এক বিস্ময়কর অবস্থানে পৌঁছেছিল যে কোরআনের বর্ণনা বিজ্ঞানের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল, যা মানুষের কাজ হিসেবে বিবেচিত ছিল।’</p> <p>এটি সঠিক নিয়মসম্মত যে কোরআন শুধু নবুয়তের অভিব্যক্তি ছিল না, এটি সঠিকতার গ্যারান্টিও ছিল, যা আমাদের বৈজ্ঞানিক বর্ণনা প্রদান করে, যা পাঠ করলে আজও আমরা সেটিই অনুধাবন করি। কোরআনের শিক্ষা অনুযায়ী মুহাম্মদ (সা.) জ্ঞানার্জনের ওপর অধ্যাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন।</p> <p>প্রথম শতকের মুসলমানরা মহানবী (সা)-এর শিক্ষাকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছিলেন এবং সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে তারা তা অর্জন করে দুনিয়ার নেতৃত্বের আসনে আরোহণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু তাঁর বিখ্যাত বই ‘গ্লিমপেজেস অব ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি’তে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মুসলমানদের বিস্ময়কর অবদানের কথা অকপটে স্বীকার করেছেন।</p> <p>প্রাচীন ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা বৈজ্ঞানিক কৌশলের কোনো বিষয় মিসর, চীন অথবা ভারতে দেখতে পাই না; বরং গ্রিসে তার ছিটেফোঁটা অবলোকন করি। এমনকি রোমেও বিজ্ঞানের জ্ঞান ও কলাকৌশল অনুপস্থিত ছিল। তবে আরব ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের তীর্থ ভূমি। তাই আরবদের আধুনিক ‘বিজ্ঞানের জনক’ বলা হয়। কিছু বিষয়ে যেমন মেডিসিন ও গণিতে আরবরা ভারতের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছিল। </p> <p>ভারতের পণ্ডিত ও গণিতকরা তখন দল বেঁধে বাগদাদে গিয়েছিল। অনেক আরব বিজ্ঞানী আবার উত্তর ভারতের ‘তাকাশিলা’ এসেছিল, যেটি এখনো একটি বড় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত এবং এটি বিশেষ করে মেডিসিন বিষয়ে ছিল অগ্রসর। সংস্কৃতিতে লেখা চিকিৎসাবিষয়ক এবং অন্যান্য বিষয়ের বই বিশেষভাবে আরবিতে অনুবাদ করা হয়েছিল। </p> <p>অন্য আরো অনেক বিষয়, যেমন—কাগজ তৈরির কলাকৌশল আরবরা চীনের কাছ থেকে শিখেছিল। তবে অন্যদের কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করে আরবরা আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আবিষ্কার করেছিল। তারা প্রথমবারের মতো টেলিস্কোপ ও নাবিক কম্পাস তৈরি করেছিল। </p> <p>ওষুধ আবিষ্কারে আরবরা গোটা ইউরোপের মধ্যে ছিল বিখ্যাত। এ পেনিকক তাঁর বই ‘আ হিস্ট্রি অব অ্যাস্ট্রোনমি’তে আরবের বিজ্ঞানের প্রশংসা করে বলেছেন, ‘এটি সর্বজনবিদিত যে আরবের মুসলমানরা ভারত থেকে অনেক বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেছিল এবং সেই জ্ঞান তারা ইউরোপে ছড়িয়ে দিয়েছিল। তারা অ্যালজাবরা ও ত্রিকোণমিতির উন্নয়ন ঘটিয়েছিল। তারা প্রচণ্ডভাবে জ্যোর্তিবিদ্যার বিকাশ সাধন করেছিল। আরবরা জ্যোর্তিবিদ্যার ক্ষেত্রে মধ্যযুগের ইউরোপকে প্রভাবিত করেছিল।’</p> <p>এতক্ষণ জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের যে বর্ণনা আলোচনা করা হলো, তার সঙ্গে বর্তমান সময়ের তুলনা করা হলে দেখা যাবে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সেই স্বর্ণ যুগ থেকে মুসলমানরা অন্যদের চেয়ে বহুদূর পিছিয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় কোরআন শিক্ষা এবং নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর শিক্ষা মুসলমানদের চেতনাকে আবারও জাগ্রত করতে পারে, যাতে তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানে আবার বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে পারে।</p> <p>আমরা স্মরণ করতে পারি ওই বাণী—যেখানে কোরআন সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছে, যারা তাঁর (আল্লাহর) পথে চেষ্টা করে আল্লাহ তাঁকে পথনির্দেশনা দান করেন। এ কথাই পবিত্র কোরআনের ভাষায় বলা হয়েছে, ‘(অন্যদিকে) যারা আমারই পথে চেষ্টা করে, আমি অবশ্যই তাদের আমার পথে পরিচালিত করি, নিঃসন্দেহে আল্লাহ নেককার বান্দাদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা : আনকাবুত, আয়াত : ৭০)</p> <p>অতএব, এই প্রেক্ষাপটে যদি মুসলমানরা এ বিষয়ে অবহেলা ও দায়িত্বহীনতা প্রদর্শন করে, তারা অবশ্যই আল্লাহর দরবারে দায়ী হবে। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে আমাদের সত্যিকার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হওয়ার তৌফিক দান করুন।  </p> <p><em>সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর করেছেন ইকবাল কবীর মোহন</em></p>