<p>ভাষা আল্লাহর শ্রেষ্ঠ দান। আল্লাহ বলেন, ‘করুণাময় আল্লাহ! শিক্ষা দিয়েছেন কোরআন, সৃষ্টি করেছেন মানবপ্রাণ। তাকে শিখিয়েছেন ভাষা-বয়ান।’ (সুরা : আর-রাহমান, আয়াত : ১-৪)</p> <p>সাধারণ মানুষকে তিনি ভাষা শিখিয়েছেন পরোক্ষভাবে, অন্যের সাহায্যে। কিন্তু মানবজাতির আদি পিতা আদম (আ.)-কে তিনি এ ভাষা শিখিয়েছেন প্রত্যক্ষভাবে, অকৃত্রিম উপায়ে। আল্লাহ বলেন, ‘আর আল্লাহ আদমকে শেখালেন সব বস্তুসামগ্রীর নাম।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ৩১)</p> <p>ভাব প্রকাশের মৌখিক পদ্ধতি ছাড়াও আছে লিখিত পদ্ধতি। সে পদ্ধতিটিও আল্লাহর শেখানো। আল্লাহ বলেন, ‘পড়ো, তোমার রব মহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন।’ (সুরা : আলাক, আয়াত : ৩-৪)</p> <p>মাতৃভাষা মানে মায়ের ভাষা। দুনিয়ার সব দেশের নিজ নিজ ভাষা রয়েছে। এ ভাষা তাদের মুখের ভাষা, মায়ের ভাষা, স্বপ্নের ভাষা এবং জীবনযাপনের ভাষা। মায়ের কাছ থেকে এ ভাষা শেখা হয় বিধায় এর নাম হয়েছে মাতৃভাষা। আল্লাহ তাআলা মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসার জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসুল দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁদের ওপর নাজিলকৃত আসমানি কিতাব তাঁরা স্বজাতির মাতৃভাষায় প্রচার করতেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি সব রাসুলকে তাদের নিজ জাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি, যাতে তারা পরিষ্কার করে বোঝাতে পারে।’ (সুরা : ইবরাহিম, আয়াত : ৪)</p> <p>মুসা (আ.)-এর সম্প্রদায়ের ভাষা ছিল ইবরানি। তাই তাওরাত নাজিল হয়েছে ইবরানি ভাষায়। হজরত দাউদ (আ.)-এর কওমের ভাষা ছিল ইউনানি। তাই জাবুর কিতাব নাজিল হয়েছে ইউনানি ভাষায়। ঈসা (আ.)-এর গোত্রের ভাষা ছিল সুরিয়ানি। তাই এ ভাষায় ইনজিল কিতাব নাজিল হয়। প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মতের ভাষা ছিল আরবি। তাই আরবি ভাষায় কোরআন নাজিল হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এটা রুহুল আমিনের (জিবরাইল) মাধ্যমে তোমার অন্তঃকরণে সুস্পষ্ট আরবি ভাষায় অবতীর্ণ করা হয়েছে। যাতে তুমি ভয় প্রদর্শনকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারো।’ (সুরা : শুয়ারা, আয়াত : ১১৩-১১৫)</p> <p>মাতৃভাষা গর্ব করার বিষয়। নিজ মাতৃভাষা সম্পর্কে গর্ব করে মহানবী (সা.) বলতেন, ‘আরবদের মধ্যে আমার ভাষা সর্বাধিক সুললিত। তোমাদের চেয়েও আমার ভাষা অধিকতর মার্জিত ও সুললিত।’ (আল-মুজামুল কাবির : ৬/৩৫)</p> <p>এর কারণ তিনি নিজেই ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে—‘আরবের সবচেয়ে মার্জিত ভাষার অধিকারী সাদিয়া গোত্রে আমি মানুষ হয়েছি। তাদের কোলে আমার মুখ ফুটেছে। তাই আমি সর্বাধিক সুললিত ভাষা আত্মস্থ করেছি।’ (আল-বদরুল মুনির ফি তাখরীজিল আহাদিস : ৮/২৮১)</p> <p>আল-কোরআন কুরাইশদের ভাষা ও উচ্চারণ রীতি অনুসারে অবতীর্ণ হয়, কিন্তু ইসলাম ভাষাগত আঞ্চলিকতা তথা মাতৃভাষার প্রতি এতই গুরুত্ব দিয়েছে যে আরবের বিভিন্ন পঠনরীতিতে কোরআন পাঠ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এ জন্য কোরআন পাঠে ‘সাত কিরআত’ (পঠনরীতি) প্রচলিত আছে।</p> <p>এ প্রসঙ্গে হাদিসের এক বর্ণনায় এসেছে, ‘রাসুল (সা.) বলেছেন, নিশ্চয়ই কোরআন সাত হরফে বা উপভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। অতএব, এসব ভাষার মধ্যে যে ভাষাটি (তোমাদের কাছে) সহজ হয়, সে ভাষায়ই তোমরা তা পাঠ করো।’ (বুখারি, হাদিস : ৪৭৫৪)</p> <p>লক্ষণীয় যে উল্লিখিত আয়াতগুলোতে কোথাও কোনো বিশেষ ভাষার কথা বলা হয়নি। তাই সব ভাষাই আল্লাহর নিয়ামত। আদি পিতা আদমের সন্তান হয়েও মানুষের যেমন গোত্র-গাত্রবর্ণ, স্বর ও সুরের রুক্ষতা-কোমলতা এবং দেহের উচ্চতা ও খর্বতা রয়েছে, তেমনি আছে ভাষার ভিন্নতাও; একটি ভিনদেশি ভাষা পর্যটকের জন্য একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো কাজে আসতে পারে। তা ছাড়া জ্ঞান-বিজ্ঞানের বহু মুক্তা-মানিক্য, রত্নভাণ্ডার ভিনদেশি ভাষায়ও পাওয়া যায়। আর এ বিষয়টিকেও ইসলাম নিরুৎসাহ করেনি।</p> <p>রাসুল (সা.) জায়েদ ইবনে সাবেত (রা.)-কে ইহুদিদের ইবরানি ভাষা শিখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ইসলামের দাওয়াত ও ধর্ম প্রচারে মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। বক্তৃতা ও বাগ্মিতার আছে সম্মোহনী শক্তি। আছে কারো হৃদয় জয় করার, কাউকে মুগ্ধ-আবিষ্ট করার আশ্চর্য ক্ষমতা।</p> <p>একটি কালজয়ী বক্তৃতা, একটি সফল বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম। তাই ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে মুসা (আ.) ভাষিক জড়তা দূর হওয়ার জন্য দোয়া করেছেন। বলেছেন—‘হে আমার রব, আমার বক্ষ প্রশস্ত করে দিন এবং আমার কাজ সহজ করে দিন। আর আমার জিহ্বা থেকে জড়তা দূর করে দিন, যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে।’ (সুরা : ত্বা-হা, আয়াত : ২৫-২৮)</p> <p>ইসলামেও বিশুদ্ধ ভাষা ব্যবহারের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বিশুদ্ধ ভাষা শেখানোর তাগিদে রাসুল (সা.)-কে বিশুদ্ধ ভাষাভাষী সাদ বংশে হালিমা সাদিয়া (রা.)-এর দুগ্ধপান করানো হয়েছিল। প্রসিদ্ধ হাদিসগ্রন্থ ‘মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা’য় শিষ্টাচার অধ্যায়ের একটি শিরোনাম হলো—‘সন্তানকে ভাষা শিক্ষা দেওয়া এবং ভুল হলে শাসন করা প্রসঙ্গ’।</p> <p>এখানে আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণিত আছে—তিনি ভাষাগত ভুল হলে সন্তানদের শাসন করতেন। একদিন একজন সাহাবি রাসুল (সা.)-এর দরজার বাইরে থেকে সালাম দিয়ে বলল, ‘আ-আলিজু?’ প্রবেশ করার অর্থে এ শব্দটির ব্যবহার আরবিতে আছে। কিন্তু প্রমিত ও সাহিত্যপূর্ণ শব্দ হলো ‘আ-আদখুলু?’ রাসুল (সা.) তাঁকে শেষোক্ত শব্দটি প্রয়োগ করতে বলেছেন।</p>