<p>বর্তমানে গান, বাদ্য-বাজনা ও সংগীতচর্চা একটি আকর্ষণীয় পেশা এবং অন্যতম সাংস্কৃতিক চর্চা হিসেবে ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে। শরিয়তে এসবের কোনো অবকাশ নেই। খুবই সীমিত পরিসরে বাদ্য-বাজনাবিহীন, পরিশীলিত বিষয়ের অপেশাদার সংগীতচর্চার অনুমোদন বোঝা গেলেও এর জন্য আছে নির্দিষ্ট নীতিমালা ও শর্তাবলি, যেন তা পাপে পরিণত না হয়।  </p> <p><strong>(১) বিশেষ দিনে শিশুদের সংগীত ও বাদ্যচর্চা </strong></p> <p>ঈদ মুসলিম উম্মার এক বিশেষ দিন। ঈদ উৎসব উদযাপনে থাকবে ভারসাম্যতা, নৈতিকতা, আল্লাহভীতি ও শৃঙ্খলা। বয়স্কদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, ছোটদের প্রতি স্নেহবোধ আর এতিম-অসহায়দের প্রতি সহমর্মিতা ঈদ উৎসবকে সফল ও সমৃদ্ধ করে তোলে। শিশুরা নির্বিঘ্নে ঈদের স্বাদ উপভোগ করে। বয়োজ্যেষ্ঠরা তাদের আনন্দ উপভোগ অনেকটা উদারতার সঙ্গে গ্রহণ করেন।</p> <p>যেমন হাদিসে এসেছে—আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, (এক দিন আমার ঘরে) আবু বকর (রা.) এলেন, তখন আমার কাছে আনসার দুটি মেয়ে বুআস যুদ্ধের দিন আনসারি পরস্পর যা বলেছিলেন সে সম্পর্কে কবিতা আবৃত্তি করছিল। তিনি বলেন, তারা কোনো পেশাগত গায়িকা ছিল না। আবু বকর (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ঘরে শয়তানি বাদ্যযন্ত্র। এটি ছিল ঈদের দিন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, হে আবু বকর! প্রত্যেক জাতির জন্যই আনন্দ উৎসব রয়েছে আর এ হলো আমাদের আনন্দ। (বুখারি, হাদিস : ৯৫২; মুসলিম, হাদিস : ২০৯৮)</p> <p>হাদিসে বিশেষ দিনে শিশুদের অশ্লীলতাবিবর্জিত বীরত্বমাখা কবিতা আবৃত্তি করা ও দফ বাজানোর বিষয়ে বড়দের এড়িতে চলতে বলা হয়েছে। সেটাও কোনো পেশাদার গায়িকার কণ্ঠে নয়। আর প্রকৃত অর্থে দফ কোনো বাদ্যযন্ত্রও নয়। দফ হলো যার এক পাশ খোলা। বাজালে ঢ্যাব-ঢ্যাব শব্দ হয়। এটি কোনো বাদ্যযন্ত্রের পর্যায়ে পড়ে না। ‘আওনুল বারী’ গ্রন্থে  বলা হয়েছে—এর আওয়াজ স্পষ্ট ও চিকন নয় এবং সুরেলা ও আনন্দদায়কও নয়। কোনো দফের আওয়াজ চিকন ও আকর্ষণীয় হলে তা আর দফ থাকবে না; বাদ্যযন্ত্রে পরিণত হবে। (আওনুল বারি : ২/৩৫৭)</p> <p><strong>(২) অভ্যর্থনা সংগীত </strong></p> <p>ইসলামের অন্য কোনো বিধান লঙ্ঘন না করে অতিথিকে মৌখিক অভ্যর্থনা ও অভ্যর্থনা সংগীত পরিবেশন করা যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কা থেকে হিজরত করে যখন মদিনায় প্রবেশ করছিলেন, তখন মদিনার মানুষের মধ্যে আনন্দ-উচ্ছ্বাসের জোয়ার নেমে এসেছিল। তারা প্রিয় নবী (সা.)-কে বরণ করতে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছিল। শিশুরা বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে নবী (সা.)-কে বিভিন্ন রকমের কবিতা আবৃত্তি করে হৃদয়োৎসারিত উষ্ণতা দিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। (ইবনে কাসির, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৮৮)</p> <p>তারা আবৃত্তি করেছিল—</p> <p><em>‘ত্বলা‘আল বাদরু ‘আলাইনা—মিন ছানিয়্যাতিল ওদা‘আ</em></p> <p><em>ওজাবাশ শুকরু ‘আলাইনা—মাদা‘আ লিল্লাহি দা‘আ</em></p> <p><em>আইয়্যুহাল মাব‘উছু ফি-না—জি’তা বিল আমরিল মুতা‘আ</em></p> <p><em>জি’তা শারফতাল মাদিনা—মারহাবা ইয়া খয়রা দা‘আ।</em></p> <p>(অনুবাদ) ‘উদিত হলো নতুন চাঁদ, ওদা পাহাড়ের ঘাঁটি থেকে/ দায়িত্ব মোদের শোকর করা, ডাকবেন যতদিন আল্লাহর দিকে।/ ওহে নবাগত! মোদের মাঝে, অনুগত আমরা সবে তোমার সকল কথায়-কাজে।’ আপনি শহরকে সম্মানিত করেছেন, স্বাগত, হে সেরা বন্ধু!</p> <p>এ বিষয়ে বর্ণিত হাদিস হলো—উবায়দুল্লাহ ইবনে আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, যখন নবী (সা.) মদিনায় প্রবেশ করেন, তখন শিশুরা আবৃত্তি করেছিল— ত্বলা‘আল বাদরু ‘আলাইনা—মিন ছানিয়্যাতিল ওদা‘আ। (ইবনে হাজর আসকালানি, ফাতহুল বারী, হাদিস : ৭/৩০৭)</p> <p><strong>(৩) প্রচলিত বাদ্য-বাজনা ও সংগীতচর্চা</strong></p> <p>প্রচলিত গান, বাদ্য-বাজনা ও সংগীতচর্চা বিভিন্ন কারণে ইসলামী সংস্কৃতির অংশ নয়, বরং তার পরিপন্থী। শরিয়তে এসবের কোনো অবকাশ নেই। উপরোক্ত হাদিসের মধ্যে এর সমর্থন খোঁজা নিষ্ফল। মহানবী (সা.) যখন কোরআন পড়ে শোনাতেন তখন মক্কার কাফিররা তাতে হট্টগোল সৃষ্টি করত। নজর ইবনে হারিস নামের মক্কার এক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি পার্শ্ববর্তী দেশ বিশেষত তৎকালীন পারস্য থেকে গল্প-গুজব সংগ্রহ করে এনে নর্তকী, বাদ্যযন্ত্রসহ আসর জমিয়ে মানুষকে কোরআন শোনা থেকে বিরত রাখত। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ আয়াত নাজিল করেন। ‘মানুষের মধ্যে কেউ কেউ অজ্ঞতাবশত আল্লাহর পথ থেকে বিপথগামী করার জন্য অসার বাক্য (লাহওয়াল হাদিস) ক্রয় করে আনে এবং আল্লাহর পথ নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। এদের জন্য আছে অবমাননাকর শাস্তি।’ (সুরা : লুকমান, আয়াত : ৬)</p> <p>আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-কে উক্ত আয়াতের ‘লাহওয়াল হাদিস’-এর ব্যাখ্যা জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, তাহলো গান। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.), আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) একই কথা বলেন। বিখ্যাত তাবেঈ হাসান বসরি (রহ.) বলেন, উক্ত আয়াত গান ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যাপারে নাজিল হয়েছে, যা বান্দাকে কোরআন থেকে উদাসীন করে দেয়। (তাফসিরে ইবনে কাসির ৩/৪৪১)</p> <p>হাদিসে বলা হয়েছে, আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, গান-বাজনা অন্তরে কপটতা উদগত করে। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯২৯)</p> <p>কাজেই যেসব গান, বাদ্য-বাজনা কপটতার উৎস হিসেবে কাজ করে, ব্যভিচারের প্রেরণা জাগ্রত করে, কোরআনের প্রতি অনীহা সৃষ্ট করে, আখিরাতের চিন্তা নির্মূল করে, সর্বোপরি গুনাহের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করে—এসব কোনো অবস্থায়ই বৈধ হওয়ার সুযোগ নেই।</p> <p><strong>(৪) বাদ্যযন্ত্র, বীণা ও পিয়ানো </strong></p> <p>হাদিসে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের নাম উল্লেখ করে তা বর্জনের কথা বলা হয়েছে। আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, মহামহিম আল্লাহ আমাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত ও পথপ্রদর্শক হিসেবে পাঠিয়েছেন এবং তিনি আমাকে বাদ্যযন্ত্র, বীণা, পিয়ানো এবং জাহিলি যুগে যেসব মূর্তির পূজা করা হতো সেগুলো ধ্বংস করার নির্দেশ দিয়েছেন। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২২২৭২)</p> <p>আরেক হাদিসে বলা হয়েছে, আবু আমির অথবা আবু মালিক আল-আশয়ারি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছেন, আমার উম্মতের কতক দল স্বাধীন ব্যক্তির ক্রয়-বিক্রয়, রেশমি পোশাক, মাদকদ্রব্য এবং বাদ্যযন্ত্র বৈধ করে নেবে। (বুখারি, হাদিস : ৫২৬৮)</p> <p><strong>(৫) বাদ্যযন্ত্র ও সংগীতে বিনিয়োগ </strong></p> <p>বর্তমানে গান ও বাদ্যযন্ত্রের বিশাল বাজার তৈরি হয়েছে। এটিকে পেশা বানিয়ে নানাভাবে আয়-উপার্জন করা হচ্ছে। গান, গায়িকা এবং এর ব্যবসা ও চর্চা সম্পর্কে নবীজি বলেন, আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা গায়িকা-দাসী ক্রয়-বিক্রয় কোরো না এবং তাদেরকে গান শিক্ষা দিয়ো না। আর এসবের ব্যবসায় কোনো কল্যাণ নেই। এর প্রাপ্ত মূল্য হারাম।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১২৮৫)</p> <p><strong>(৬) নারীর কণ্ঠে পরপুরুষের গান শোনা </strong></p> <p>কোনো পরপুরুষের সঙ্গে নারীর মোহনীয় কণ্ঠে সংলাপ ও কথোপকথন করা ব্যভিচারের সূচনাপথ হিসেবে পরিগণিত। সে ক্ষেত্রে নারীর মোহনীয় কণ্ঠে গাওয়া গান পরপুরুষের জন্য শোনা বৈধ হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। আল্লাহ বলেন, ‘হে নবীর স্ত্রীরা! তোমরা অন্য নারীদের মতো নয়, যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, তবে পরপুরুষদের সঙ্গে কোমল কণ্ঠে এমনভাবে কথা বোলো না, যাতে ব্যাধিগ্রস্ত অন্তরের মানুষ প্রলুব্ধ হয়।’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ৩২)</p> <p>পরিশেষে বলা যায়, সমাজে বিস্তৃত গান, বাদ্য-বাজনা ও সংগীতচর্চার মধ্যে অনেক সময় দ্বিন প্রচারের নামেও এগুলো করতে দেখা যায়, যা স্পষ্টত শরিয়তের লঙ্ঘন। এসব থেকে নিজেকে যত সংযত রাখা যাবে, আখিরাতের দিকে তত অগ্রসর হওয়া সহজ হবে।</p> <p><em>লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়</em></p>