<p style="text-align:justify">ওমর (রা.) মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে যখন শয্যাশায়ী হন এবং বুঝতে পারলেন যে জীবনপ্রদীপ নির্বাপিত হতে আর বেশি দেরি নেই, তখন তিনি পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের জন্য ছয় সদস্যের একটি নির্বাচনী পরিষদ গঠন করেন। এ পরিষদের সদস্যরা হলেন ওসমান (রা.), আলী (রা.), আবদুর রহমান (রা.), জুবাইর (রা.), তালহা (রা.) ও সাদ-বিন-আবি ওয়াক্কাস (রা.)।</p> <p style="text-align:justify">আবদুর রহমান (রা.) প্রথমেই জানালেন যে তিনি খলিফা হতে মোটেই চান না। এ অবস্থায় এ পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব আবদুর রহমান (রা.)-কে দেওয়া হয়। এ নির্বাচনী পরিষদের ছয় সদস্যের সবাই রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রিয়পাত্র ও অনুগামী ছিলেন এবং প্রত্যেকেই ইসলামের একনিষ্ঠ খিদমতে তাঁদের অবদানের জন্য সুপরিচিত ছিলেন। আবদুর রহমান (রা.) তৎকালীন আরবে একজন শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি ছিলেন। বিচক্ষণতা ও দানশীলতার জন্য তিনি প্রচুর সুনাম অর্জন করেন।</p> <p style="text-align:justify">এই পরিষদের সদস্য ওসমান (রা.) ইসলামের খিদমতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। মদিনার মুসলমানদের পানি সমস্যা নিরসনের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করে ‘বির রুমা’ নামক কূপের ব্যবস্থা করা, মদিনার মসজিদ সম্প্রসারণ করার জন্য মসজিদসংলগ্ন এক খণ্ড জমি ক্রয় করে দেওয়া এবং তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য বিশাল অর্থসম্পদ খরচ করা ওসমান (রা.)-এর অতুলনীয় কীর্তির স্বাক্ষর ইসলামের ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে। মুহাম্মদ (সা.) তাঁকে এত পছন্দ করতেন যে পর পর দুই কন্যাকে, অর্থাৎ এক কন্যার মৃত্যুর পর আরেক কন্যাকেও তাঁর সঙ্গে বিবাহ দিয়ে দেন। আলী (রা.) হচ্ছেন মুহাম্মদ (সা.)-এর চাচাতো ভাই ও জামাতা এবং ফাতিমা (রা.)-এর স্বামী। শৌর্যে-বীর্যে, জ্ঞান-গরিমায় তাঁর খুবই সুখ্যাতি ছিল।</p> <p style="text-align:justify">জুবাইর (রা.) ছিলেন আবু বকর (রা.)-এর জামাতা এবং কন্যা আসমা (রা.)-এর স্বামী। তিনি ধনী ব্যক্তি ছিলেন এবং ইসলামের জন্য তাঁর যথেষ্ট দান ছিল। তালহা (রা.) একজন ধনী ব্যক্তি ছিলেন এবং ইসলামের জন্যও তাঁর যথেষ্ট অবদান ছিল। সাদ (রা.) পারস্য বিজয়ী বীর হিসেবে মদিনায় খুবই সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মাতা আমেনার ভাইয়ের পুত্র। তালহা (রা.) ও সাদ (রা.)ও ইসলামের প্রাথমিক যুগে ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী ছিলেন। ওমর (রা.) অন্তিম শয়নে এ ছয় সদস্যের পরিষদকে তাঁর মৃত্যুর তিন দিনের মধ্যে খলিফা নির্বাচনের কাজ সমাধা করার জন্য নির্দেশ দিলেন।</p> <p style="text-align:justify">এখানে উল্লেখ্য যে এ পরিষদের সদস্য সাদ (রা.), জুুবায়ের (রা.), তালহা (রা.) ও আলী (রা.)—এঁদের প্রত্যেকের বয়স ছিল পঞ্চাশের নিচে। আর ওসমান (রা.)-এর বয়স ছিল পঞ্চাশের ওপরে ৬৭ বছর মতান্তরে ৭০ বছর। সবার মধ্যে আলী (রা.) ছিলেন সর্বাপেক্ষা বয়ঃকনিষ্ঠ। তখন তাঁর বয়স ছিল ৪৪ বছর।</p> <p style="text-align:justify">আবদুর রহমান (রা.) খলিফা পদে প্রার্থী মনোনীত করার ব্যাপারে জনমত যাচাই করার জন্য মদিনার বিভিন্ন বাড়িতেও যান। এমনকি নারীদের সঙ্গেও আলাপ-আলোচনা করেন এবং তাঁদের মতামত জেনে নেন। কোনো কোনো গোত্রের নেতাদের সঙ্গেও তিনি আলাপ-আলোচনা করেন। খলিফা ওমর (রা.)-এর মৃত্যুর পর যখন খলিফা নির্বাচনের উদ্দেশ্যে প্রার্থী মনোনয়নের সভা হয় তখন তালহা (রা.) মদিনায় ছিলেন না। এ সভায় জুবাইর (রা.) ওসমান (রা.) ও আলী (রা.) উভয়ের নামই খলিফা পদের জন্য প্রস্তাব করেন। সাদ (রা.) ওসমান (রা.)-কে সমর্থন করলেন। ওসমান (রা.) আলী (রা.)-কে এবং আলী (রা.) ওসমান (রা.)-কে সমর্থন করলেন। এ পরিষদের সভাপতি আবদুর রহমান (রা.) ভোট দানে বিরত রইলেন।</p> <p style="text-align:justify">ভোটের ফলাফলে দেখা যায়, ওসমান (রা.) তিনটি ভোট পেয়েছেন, আর আলী (রা.) দুটি ভোট পেয়েছেন। এই ভোটে এ পরিষদের অন্য কোনো সদস্যের নাম খলিফা পদের জন্য প্রস্তাব আসেনি। প্রতীয়মান হয় সভাপতি আবদুর রহমান (রা.)-এর জনমত যাচাইতে জনসাধারণ থেকে নির্বাচনী পরিষদ সদস্যের বাইরে অন্য কারো নাম খলিফা পদের জন্য প্রস্তাব আসেনি।</p> <p style="text-align:justify">পরিষদের সদস্যরাও পরিষদ সদস্যের বাইরের কারো নাম খলিফা পদের জন্য প্রস্তাব করেননি। এ থেকে বোঝা যায়, ওমর (রা.) মদিনার সবচেয়ে সেরা ছয়জন ব্যক্তিকে নিয়ে এই নির্বাচনী পরিষদ গঠন করেন। পরিষদের সভা শেষে আবদুর রহমান (রা.) ঘোষণা করলেন—‘অদ্যকার পরামর্শ সভায় এটা স্থির হলো ওসমান (রা.) ও আলী (রা.) মধ্যে থেকে একজন খলিফা হবেন। আগামীকাল সাধারণসভায় এ দুজন থেকে একজনকে নির্বাচিত করা হবে।’</p> <p style="text-align:justify">আবদুর রহমান (রা.) মসজিদে নববীতে সাধারণসভা আহ্বান করেন। আগ্রহী জনগণ তাঁর আহ্বানে সময়মতো মসজিদে নববীতে এসে সমবেত হলো। এরপর তিনি উপস্থিত জনতাকে বললেন, ‘বন্ধুরা! আমাদের খলিফা ওমরের স্থলে বসানোর জন্য আমরা গতকাল বিশেষ সভায় আলী (রা.) ও ওসমান (রা.)-কে প্রার্থী মনোনীত করেছি। তাঁরা উভয়েই ইসলামের একনিষ্ঠ সেবক এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জামাতা ও প্রিয় সাহাবী। এখন এই দুজনের মধ্যে কে মুসলিম জাহানের খলিফা হবেন, তা আজকের এ সাধারণসভায় স্থির করতে হবে।’</p> <p style="text-align:justify">এরপর শুরু হলো আলাপ-আলোচনা। এর ফলে জনমতের ভিত্তিতে আবদুর রহমান (রা.) ছয় সদস্যের এই নির্বাচনী পরিষদে সবচেয়ে বেশি সমর্থন পাওয়া ওসমান (রা.)-কে মদিনাভিত্তিক এই রাষ্ট্রের খলিফা নির্বাচিত বলে ঘোষণা দেন। আলী (রা.)-সহ উপস্থিত জনতা এ ঘোষাণার প্রতি সমর্থনসূচক ওসমান (রা.)-এর হাতে বাইআত অর্থাৎ আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করলেন। মূলত বয়োজ্যেষ্ঠতায় ও ইসলামের সেবায় অকাতরে প্রচুর অর্থদান এবং রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর দুই কন্যাকে তাঁর কাছে বিবাহ দেওয়ার ফলে জনগণের পছন্দে ওসমান (রা.) ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে মদিনাভিত্তিক রাষ্ট্রের তৃতীয় খলিফা নির্বাচিত হন।</p> <p style="text-align:justify">ওসমান (রা.) নিজ থেকে খলিফা পদের জন্য প্রার্থী হননি, নির্বাচনী পরিষদ তাঁকে প্রার্থী মনোনীত করলেও তিনি জনসাধারণের কাছে তাঁকে খলিফা করতে সমর্থন দেওয়ার জন্য কোনো অনুরোধ করেননি। তিনি যেভাবে খলিফা অর্থাৎ রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হয়েছেন তা-ই হচ্ছে ইসলামী গণতন্ত্রসম্মত নির্বাচন অর্থাৎ ইসলামী গণতান্ত্রিক নির্বাচন।</p>