<p style="text-align:justify">প্রাচীনকাল থেকে মাছ মানুষের প্রিয় খাদ্য। বিশেষভাবে এটি বাঙালি জাতির অন্যতম প্রিয় খাবার। আল্লাহর রাসুল (সা.) মাছ খেতেন। মাছ সুস্বাদু ও উপকারী খাবার। সারা বিশ্বে অনেক ধরনের মাছ পাওয়া যায়। এখানে সামুদ্রিক মাছের বিধান সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হলো।</p> <p style="text-align:justify">ইসলামী আইনজ্ঞরা বলেছেন, সমুদ্র বিশেষজ্ঞদের মতে সমুদ্র ও নদীতে যেসব প্রাণীকে মাছ বলা হয়, তাই মাছ এবং তা খাওয়া হালাল। মুফতি আমিমুল ইহসান (রহ.) বলেন, মানুষের মধ্যে যে জলজ প্রাণীকে মাছ বলে গণ্য করা হয় তা-ই মাছ। এটি এমন এক জলজ প্রাণী, যার অসংখ্য প্রকারভেদ ও আকৃতি রয়েছে। (আত-তারিফাতুল ফিকহিয়্যাহ, পৃষ্ঠা-৩২৭)</p> <p style="text-align:justify">আল্লামা রামলি (রহ.) বলেন, অভিধানবিদ ও সমুদ্র বিশেষজ্ঞদের মতে, যে ধরনের সামুদ্রিক প্রাণীকে মাছের প্রকার বলে গণ্য করা হয়, তা হালাল হবে এবং যেসব প্রাণীকে মাছের প্রকার নয় বলে গণ্য করা হয়, তা হালাল নয়। অতএব, যেসব প্রাণীকে মাছের প্রকারের মধ্যে গণ্য করা হয়, চাই তা যত বড়ই হোক না কেন এবং যত ছোটই হোক না কেন, সেগুলো মাছ হিসেবেই গণ্য হবে এবং তা খাওয়া হালাল। (নিহায়াতুল মুহতাজ : ৮/১৫১)</p> <p style="text-align:justify">সম্প্রতি বিভিন্ন দেশে বহু নামি-দামি রেস্টুরেন্টে সামুদ্রিক প্রাণীর বহু প্রজাতি মানুষ মাছ হিসেবে খেয়ে থাকে। নিম্নে সেগুলোর ইসলামী বিধান তুলে ধরা হলো—</p> <p style="text-align:justify"><strong>১. তিমি মাছ</strong></p> <p style="text-align:justify">তিমিও এক প্রকার মাছ। অভিধানবিদ এর নাম ‘আম্বার’ লিখেছেন এবং ফিকহবিদরা বলেছেন, সর্বপ্রকার মাছ হালাল, তাই তিমি মাছও হালাল। (রদ্দুল মুহতার, খণ্ড-৬, পৃষ্ঠা-৩০৬)</p> <p style="text-align:justify"><strong>২. শার্ক বা হাঙর</strong></p> <p style="text-align:justify">হাঙর যাকে ইংরেজি ভাষায় শার্ক (Shark) বলা হয় এবং আরবি ভাষায় কির্শ ও কাওসাজ বলা হয় আর সমুদ্র বিশেষজ্ঞরা এটাকে (হাঙর বা শার্ক) মাছ হিসেবে গণ্য করেন না। তাই তা খাওয়া হারাম। (বাদায়েউস সানায়ে, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা- ৩৫, মাজমুআয়ে ফাতওয়া,<br /> খণ্ড-২২, পৃষ্ঠা-২২৯)</p> <p style="text-align:justify"><strong>৩. ডলফিন</strong></p> <p style="text-align:justify">ডলফিন সম্পর্কে ইসলামী আইনজ্ঞদের অভিমত এই যে ডলফিনের মধ্যে মাছের সব শর্ত পাওয়া যায় না আর যদিও ডলফিন পরিভাষায় মাছ হিসেবে পরিচিত (যাঁরা মাছ এবং এর প্রকারের সঙ্গে পরিচিত তাঁরাও এটিকে মাছ বলেছেন)। এ ছাড়া অভিধানে এটিকে মাছ হিসেবেই গণ্য করা হয়েছে। তবু তা খাওয়া জায়েজ নয়।  (বাদায়েউস সানায়ে, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-৩৫, মাজমুআয়ে ফাতওয়া, খণ্ড-২২, পৃষ্ঠা-২২৯)</p> <p style="text-align:justify"><strong>৪. অক্টোপাস</strong></p> <p style="text-align:justify">অক্টোপাস  (Octopus) একটি সামুদ্রিক প্রাণী, যার মধ্যে মাছের কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। তাই এটি খাওয়া মোটেও হালাল নয়। (আদ-দুররুল মুখতার, খণ্ড-৬, পৃষ্ঠা-৩০৬)</p> <p style="text-align:justify"><strong>৫. স্কুইড</strong></p> <p style="text-align:justify">স্কুইড (Squid) মাছের কোনো প্রকারের মধ্যে পড়ে না, বরং এটি একটি সামুদ্রিক কীট। তাই এটি খাওয়া জায়েজ নয়। (তাকসিমুল হায়াওয়ান, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-২৭)</p> <p style="text-align:justify"><strong>৬. কাঁকড়া</strong></p> <p style="text-align:justify">হানাফি মাজহাব মতে, সামুদ্রিক প্রাণীদের মধ্যে শুধু মাছ খাওয়া হালাল। কাঁকড়া (Crab) কোনো প্রকার মাছের অন্তর্ভুক্ত নয়, বরং কাঁকড়াকে সমুদ্র ও নদীর কীটপতঙ্গের মধ্যে গণ্য করা হয়। তাই কাঁকড়া খাওয়া মাকরুহে তাহরিমি। (বাদায়েউস সানায়ে, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-৩৫, ফাতওয়ায়ে কাসেমিয়া, খণ্ড-২৪, পৃষ্ঠা-১২২)</p> <p style="text-align:justify"><strong>৭. লবস্টার (চিংড়ি) </strong></p> <p style="text-align:justify">Lobster এটি Malacostraca-এর পরিবারের অন্তর্ভুক্ত, যা মাছের প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত নয়। তাই  লবস্টার (চিংড়ি) খাওয়া জায়েজ নয়। উল্লেখ্য যে লবস্টার (চিংড়ি) এটি কাঁকড়ার প্রকারের মধ্যে পড়ে, যদিও বাংলায় এটাকে বড় চিংড়ি বলা হয়। (তাকসিমুল হায়াওয়ান, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-২৭; মিন আজায়িবিল খালকি ফি আলামিল আমসাক, পৃষ্ঠা-১৩)</p> <p style="text-align:justify"><strong>পবিত্র কোরআনে মাছসংক্রান্ত বর্ণনা</strong></p> <p style="text-align:justify">কোরআনের ছয়টি স্থানে মাছের কথা বলা হয়েছে।</p> <p style="text-align:justify">এক. একটি হলো যেখানে আল্লাহ তাআলা বনি ইসরাঈলকে শনিবার শিকার করা থেকে নিষেধ করেছেন, সেখানে মাছের কথা উল্লেখ আছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন : ‘এবং তাদের কাছে সাগরতীরে অবস্থিত জনপদবাসীদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো যখন তারা শনিবারের ব্যাপারে সীমা লঙ্ঘন করত, যখন তাদের (সাগরের) মাছ শনিবার দিন তো পানিতে ভেসে ভেসে তাদের সামনে আসত; আর যখন তারা শনিবার উদযাপন করত না, (অর্থাৎ অন্যান্য দিনে) তা আসত না। এভাবে আমি তাদেরকে তাদের উপর্যুপরি অবাধ্যতার কারণে পরীক্ষা করেছিলাম।’ (সুরা : আল আরাফ, আয়াত : ১৬৩)</p> <p style="text-align:justify">দুই. আর যেখানে মুসা ও খিজির (আ.)-এর সাক্ষাতের ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে মাছের কথাও দুই স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন : ‘সুতরাং তারা যখন দুই সাগরের মিলনস্থলে পৌঁছল, তখন উভয়েই তাদের মাছের কথা ভুলে গেল। সেটি সাগরের ভেতর সুড়ঙ্গের মতো পথ তৈরি করে নিল।’ (সুরা : আল কাহফ, আয়াত : ৬১)</p> <p style="text-align:justify">তিন. অন্যত্র মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন : ‘সে বলল, আপনি কি জানেন (কী আজব কাণ্ড ঘটেছে?) আমরা যখন শিলাখণ্ডের ওপর বিশ্রাম করছিলাম, তখন মাছটির কথা (আপনাকে বলতে) ভুলে গিয়েছিলাম। সেটির কথা বলতে শয়তানই আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল। আর সেটি (অর্থাৎ মাছটি) অত্যন্ত আশ্চর্যজনকভাবে সাগরে নিজের পথ করে নিয়েছিল।’ (সুরা : আল কাহফ, আয়াত : ৬৩)</p> <p style="text-align:justify">চার. মাছ হলো সেই সৌভাগ্যবান প্রাণী, যার পেটে আল্লাহর নবী ইউনুস (আ.) বিশ্রাম নিয়েছিলেন। কোরআনে এ ঘটনায় দুই স্থানে মাছের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন : ‘তারপর একটি বৃহদাকার মাছ তাকে [ইউনুস (আ.)] গিলে ফেলল, যখন সে নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছিল।’ (সুরা : আস সাফফাত, আয়াত : ১৪২)</p> <p style="text-align:justify">পাঁচ. অন্যত্র ইরশাদ করেছেন : ‘তবে তাঁকে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত মাছের পেটেই থাকতে হতো।’ (সুরা : আস-সাফফাত, আয়াত : ১৪৪)</p> <p style="text-align:justify">ছয়. সমুদ্র ও নদীতে থাকা প্রাণীর তাজা গোশত খাওয়ার কথা কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন : ‘দুটি দরিয়া সমান নয়। একটি মিঠা, তৃষ্ণা নিবারক, সুপেয় আর অন্যটি অতি নোনা। প্রত্যেকটি থেকেই তোমরা খাও (মাছের) তাজা গোশত এবং আহরণ করো।’ (সুরা : আল ফাতির, আয়াত : ১২)</p> <p style="text-align:justify">উক্ত আয়াতে ‘তাজা গোশত’ শব্দের ব্যাখ্যায় তাফসিরবিদ ইবনে জারির তাবারি (রহ.) লিখেছেন, তাজা গোশত হলো সমুদ্র থেকে শিকারকৃত মাছ। (তাফসিরে তাবারি, খণ্ড-২০, পৃষ্ঠা-৪৪৯)</p> <p style="text-align:justify">আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন : ‘তাজা গোশত’ দ্বারা মাছকে বুঝানো হয়েছে। (তাফসিরে ইবনে কাসির, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ৫৪০)</p> <p style="text-align:justify"><strong>হাদিস শরিফে মাছসংক্রান্ত বর্ণনা</strong></p> <p style="text-align:justify">হাদিসেও মাছের কথা উল্লেখ আছে এবং একটি হাদিসে বলা হয়েছে যে রাসুলুল্লাহ (সা.)-ও এর গোশত খেতেন। জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, আমরা জাইশুল খাবাতের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম, আবু উবাইদা (রা.)-কে আমাদের সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়েছিল। পথে আমরা ভীষণ ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ি। তখন সমুদ্র আমাদের জন্য একটি মরা মাছ তীরে নিক্ষেপ করে দিল। এত বড় মাছ আমরা আর কখনো দেখিনি, একে আম্বার বলা হয়। এরপর মাছটি থেকে আমরা অর্ধমাস আহার করলাম। </p> <p style="text-align:justify">একবার আবু উবাইদা (রা.) মাছটির হাড়গুলোর একটি হাড় তুলে ধরলেন আর সওয়ারির পিঠে চড়ে একজন হাড়টির নিচ দিয়ে অতিক্রম করল। (ইবনু জুরায়েজ বলেন) আবু জুবায়ের (রহ.) আমাকে জানিয়েছেন যে তিনি জাবির (রা.) থেকে শুনেছেন, জাবির (রা.) বলেন : ওই সময় আবু উবাইদা (রা.) বলেন, তোমরা মাছটি আহার করো। এরপর আমরা মদিনায় ফিরে এলে নবী (সা.)-কে বিষয়টি অবগত করলাম। তিনি বলেন, খাও। এটি তোমাদের জন্য রিজিক, আল্লাহ তাআলা পাঠিয়ে দিয়েছেন। আর তোমাদের কাছে কিছু অবশিষ্ট থাকলে আমাদেরও খাওয়াও। মাছটির কিছু অংশ নবী (সা.)-কে এনে দেওয়া হলো। তিনি তা খেলেন। (বুখারি, হাদিস : ৪৩৬২)</p> <p style="text-align:justify">আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমাদের জন্য দুটি মৃত জীব হালাল করা হয়েছে—মাছ ও টিড্ডি (এক প্রকারের বড় জাতের ফড়িং)। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩২১৮)</p> <p style="text-align:justify">উল্লেখ্য যে রাসুলুল্লাহ (সা.) মাছ খেয়ে তার হালাল হওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করেছেন। উল্লিখিত হাদিসে মাছের জন্য আম্বার শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, এর দুটি কারণ হতে পারে। এক. তা থেকে আম্বার (গন্ধদ্রব্য) নির্গত হয়। দুই. এক ধরনের মাছের নাম আম্বার। আরবিতে আম্বার বলা হয় বড় মাথাবিশিষ্ট দাঁতওয়ালা এক প্রকার দীর্ঘকায় তিমি মাছকে। (ফাতহুল বারি, খণ্ড-৮, পৃষ্ঠা-৮০)</p>