<p style="text-align: justify;">বর্তমান সময়ে অনলাইনে ক্রয়-বিক্রয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এতে মানুষের সময় সাশ্রয় হচ্ছে এবং সে একই সময়ে বহু পণ্য পেয়ে যাচ্ছে, যা অফলাইনে কষ্টসাধ্য। ফলে মানুষ ভোজ্য পণ্য থেকে শুরু করে প্রসাধনী, পোশাক-আশাক, এমনকি পশুপাখিও অনলাইনে ক্রয়-বিক্রয় করছে। অনেকের জিজ্ঞাসা—অনলাইনের ক্রয়-বিক্রয় শরিয়া মোতাবেক শুদ্ধ হবে কি না? এ প্রশ্নের জবাব জানতে হলে প্রথমেই আমাদের জানতে হবে শরিয়ায় ক্রয়-বিক্রয়ের মৌলিক শর্ত কী কী?</p> <p style="text-align: justify;"><strong>ক্রয়-বিক্রয় শুদ্ধ হওয়ার মৌলিক শর্ত</strong></p> <p style="text-align: justify;"><strong>এক.</strong> ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয় পক্ষের সন্তুষ্টি ও সম্মতি। তেমনি যদি ক্রয়-বিক্রয়ের পদ্ধতিটি এমন হয়, যাতে সন্তুষ্টি ও সম্মতি বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কাই বেশি, তাহলে ওই পদ্ধতিতে ক্রয়-বিক্রয় ইসলামে নাজায়েজ হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা তোমাদের পরস্পরের সম্পদ অন্যায় ভাবে ভক্ষণ কোরো না। তবে যদি তা হয় কোনো ব্যবসা তোমাদের উভয় পক্ষের সন্তুষ্টিক্রমে।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ২৯)</p> <p style="text-align: justify;"><strong>দুই.</strong> ক্রেতা-বিক্রেতা জ্ঞানসম্পন্ন (আকেল) এবং লেনদেন ও পণ্যের ভালো-মন্দ বোঝে—এমন বয়সের (মুতামাইয়িজ) হওয়া। সুতরাং অবুঝ শিশু ও পাগল হলে ক্রয়-বিক্রয় জায়েজ হবে না।</p> <p style="text-align: justify;">পূর্ববর্তী আয়াত এর দলিল। সেখানে উভয় পক্ষের সন্তুষ্টি পরস্পর লেনদেনের শর্ত হিসেবে উল্লিখিত হয়েছে। পাগল ও ভালো-মন্দ বিবেচনা করার বোধ-বুদ্ধি নেই এমন ছোট মানুষের সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি বিবেচ্য নয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তিনজনের কাছ থেকে কলম তুলে নেওয়া হয়েছে : ‘শিশু থেকে সাবালক হওয়া পর্যন্ত, ঘুমন্ত ব্যক্তি থেকে, জেগে ওঠা পর্যন্ত এবং পাগল থেকে সুস্থ হওয়া পর্যন্ত।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৪০৩; তিরমিজি, হাদিস : ১৪২৩)</p> <p style="text-align: justify;"><strong>তিন. </strong>পণ্য মূল্যবান (মুতাকাভভিম) বস্তু হওয়া। সুতরাং এমন বস্তু বেচাকেনা করা যাবে না, যা শরিয়তে মূল্যবান সম্পদ হিসেবে বিবেচিত নয়। যেমন—মদ, শূকরের গোশত ও মৃত প্রাণীর গোস্ত। এজাতীয় বস্তু ক্রয়-বিক্রয় জায়েজ হবে না। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয় হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২৭৫)</p> <p style="text-align: justify;">আর ক্রয়-বিক্রয় মানে সম্পদের আদান-প্রদান। যে বস্তু ইসলামের দৃষ্টিতে মূল্যবান নয় তা ক্রয়-বিক্রয় করলে সম্পদের বিনিময়ে সম্পদ পাওয়া যায় না, বরং এক পক্ষ থেকে সম্পদ অপর পক্ষ থেকে অসম্পদের বিনিময় হয়। তাই তা কোরআনে বর্ণিত হালাল ক্রয়-বিক্রয়ের আওতায় পড়ে না।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>চার. </strong>ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন হওয়ার সময় পণ্য বিক্রেতার মালিকানাধীন থাকতে হবে কিংবা তার জন্য মালিকের পক্ষ থেকে বিক্রির অনুমতি থাকতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমার কাছে যা বিদ্যমান নেই তা বিক্রি কোরো না।’ (নাসায়ি, হাদিস : ৪৬১৩; আবু দাউদ, হাদিস : ৩৫০৩)</p> <p style="text-align: justify;"><strong>পাঁচ. </strong>চোখে দেখার মাধ্যমে কিংবা বিবরণের মাধ্যমে ক্রয়-বিক্রয়কারীর কাছে পণ্যের বিবরণ, গুণাবলি ও পরিমাণ সুস্পষ্ট থাকা। পণ্যের পরিমাণ ও গুণাবলি অস্পষ্ট থাকলে বেচাকেনায় সন্তুষ্টি ও সম্মতি পাওয়া যাবে না। কারণ সন্তুষ্টি নির্ভর করে পণ্যের পরিমাণ ও গুণাবলির ওপর। তা ছাড়া পরিমাণ ও গুণাবলি নির্ধারণ করা ছাড়া মূল্য নির্ধারণ করাও সম্ভব নয়। অনুমান করে মূল্য নির্ধারণ করলে ধোঁকার আশঙ্কা বেশি থাকে।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>ছয়.</strong> হস্তান্তর করা সম্ভব, এমন বস্তু হতে হবে। সুতরাং সমুদ্রের মাছ বিক্রি কিংবা শূন্যে উড়ন্ত পাখি বিক্রি শরিয়াসম্মত বা জায়েজ নয়। পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, হস্তগত নয় এমন বস্তু বিক্রি করতে রাসুলুল্লাহ (সা.) নিষেধ করেছেন।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>সাত. </strong>পণ্যের মূল্য স্পষ্টভাবে নির্ধারিত হতে হবে। পূর্বের প্রতিটি শর্ত আরোপ করা হয়েছে যেন মুসলিমের ক্রয়-বিক্রয় ধোঁকা, জুলুম ও সুদ থেকে মুক্ত থাকে।</p> <p style="text-align: justify;">পূর্বের আলোচনার আলোকে অনলাইনে ক্রয়-বিক্রয়ে যে কয়টি বিষয় খেয়াল রাখলে ক্রয়-বিক্রয় শুদ্ধ হবে, তা নিম্নে দেওয়া হলো—</p> <p style="text-align: justify;">(ক) পণ্যের সঠিক বিবরণ পণ্যের সঙ্গে উল্লেখ থাকতে হবে। যেমন—কাঁচামাল, গুণাগুণ, পরিমাণ, উৎপাদক প্রতিষ্ঠান, উৎপাদন তারিখ মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখসহ যাবতীয় যা উল্লেখ থাকলে একজন ক্রেতা পণ্য সম্পর্কে পরিপূর্ণ একটি জ্ঞান লাভ করতে পারে। এসব বিবরণে কোনো মিথ্যা তথ্য যদি থাকে তাহলে ক্রয়-বিক্রয় শুদ্ধ হবে না।</p> <p style="text-align: justify;">(খ) অনলাইনে যাঁরা বিক্রি করবেন তাঁদের উচিত পণ্য তাঁদের মালিকানাধীন ও হস্তগত থাকা। পণ্য যদি বিক্রেতার মালিকানাধীন না থাকে, তাহলে সে কোনো বিক্রেতা বা উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের প্রতিনিধি হয়ে বিক্রয়ের যথোপযুক্ত চুক্তি করে নেবে।</p> <p style="text-align: justify;">(গ) ইসলামী শরিয়ায় সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না—এমন পণ্য না হওয়া। যেমন—মদ, শূকরের গোশত, আল্লাহ নামে জবেহ করা হয়নি এমন পশুর গোশত, পুরুষের জন্য তৈরি খাঁটি সিল্কের পোশাক ইত্যাদি।</p> <p style="text-align: justify;">(ঘ) বিক্রেতা ও ক্রেতা উভয়ে অন্তত মুতামাইয়িজ অর্থাৎ পণ্যের গুণাগুণ, ভালো-মন্দ ও বেচাকেনার প্রয়োজন-অপ্রয়োজন বোঝে এমন বয়স্ক হতে হবে—ঠিক তেমনি ক্রেতাও। ক্রেতা-বিক্রেতার কেউ পাগল বা মানসিক রোগী না হওয়া। এর জন্য বিপণন সাইডগুলো যেন বাচ্চারা ব্রাউজ করতে না পারে সে ব্যবস্থা থাকা উচিত।</p> <p style="text-align: justify;">(ঙ) দেখার পর পণ্য বর্জনের এখতিয়ার (খিয়ারুর রুয়া) থাকতে হবে। বর্জন করলে ক্রেতার ওপর কোনো খরচ চাপিয়ে না দেওয়া।</p> <p style="text-align: justify;">মোটকথা, অনলাইনে ক্রয়-বিক্রয়ে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো থেকে মুক্ত থাকা আবশ্যক— প্রতারণা (গারার), ঠকানো (দারার), পণ্যে ভেজাল (গিশ) ও অনৈতিক ফায়দা লোটা (ইসতিগলাল)। (আল হিদায়াহ, বুয়ু অধ্যায় ও দারুল ইফতা মিসর এর ওয়েব সাইট)।</p> <p style="text-align: justify;"> </p>