<p>পবিত্র নগরী মদিনা মুসলিম উম্মাহর কাছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ শহর। মুসলিম হৃদয়ে এই নগরীর প্রতি রয়েছে অপরিসীম শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও মর্যাদা। কেননা এখানেই শুয়ে আছেন প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)। পবিত্র এই ভূমিতেই ইসলামের উত্থান হয়েছিল এবং এখান থেকেই সারা পৃথিবীতে ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছিল।</p> <p>মাতৃভূমি মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন মহানবী (সা.)। তিনি তাঁর জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ শেষ ১০ বছর এই নগরীতেই কাটিয়েছেন। মূলত আল্লাহ এই নগরীকে ইসলামের জন্য কবুল করেছিলেন। আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসুল (সা.) পবিত্র এই নগরের বহুবিধ মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যের কথাও উল্লেখ করেছেন।</p> <p><strong>মদিনার যত নাম</strong></p> <p>ইসলামের ইতিহাসের প্রামাণ্য গ্রন্থে মদিনার অনেক নাম পাওয়া যায়, যা তার সম্মান ও মর্যাদার প্রমাণ বহন করে। আল্লামা সামহুদি মদিনার ৯৪টি নাম উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে ‘মদিনা’ নামটি সর্বাধিক প্রসিদ্ধ, যা কোরআনে চারবার এসেছে—সুরা : তাওবা, আয়াত : ১০১ ও ১২০; সুরা : আহজাব, আয়াত : ৬০ এবং সুরা : মুনাফিকুন, আয়াত : ৮। আর হাদিসেও এই নামটির ব্যবহার সর্বাধিক।</p> <p>মদিনার আরেকটি প্রসিদ্ধ নাম ‘তাবাহ’। জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা এই মদিনাকে ‘তাবাহ’ নামে নামকরণ করেছেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৩৪২৩)</p> <p>মুসলিম শরিফে বর্ণিত আরেক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনাকে ‘তাইবাহ’ নামেও অভিহিত করেছেন। তাবাহ ও তাইবাহর অর্থ উত্তম। মদিনার উল্লেখযোগ্য আরো কয়েকটি নাম হলো আদ-দার, আল-হাবিবা, দারুল হিজরা, দারুল ফাতহ ইত্যাদি। জাহেলি যুগে মদিনার নাম ছিল ‘ইয়াসরিব’। কিন্তু নবী করিম (সা.) এই নাম অপছন্দ করতেন।</p> <p><strong>মদিনার সম্মান ও মর্যাদার যত দিক</strong></p> <p><strong>১. রাসুল (সা.)-এর প্রিয় নগরী : </strong>রাসুল (সা.) মদিনা নগরীকে ভালোবাসতেন এবং তা যেন অন্যদের প্রিয় হয় সেই দোয়া করতেন। তিনি বলতেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি মদিনাকে আমাদের কাছে প্রিয় করে দাও, যেমনিভাবে প্রিয় করেছ মক্কাকে, বরং তার চেয়েও বেশি প্রিয় করো।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৮৮৯)</p> <p><strong>২. রাসুল (সা.)-এর শেষ নিবাস : </strong>মদিনায়ই তিনি তাঁর জীবনের শেষ গুরুত্বপূর্ণ সময় কাটিয়েছেন। এখান থেকেই তিনি ইসলামের বাণী পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে দেন। জীবনের শেষ নিবাস হিসেবেও তিনি এই নগরীকে বেছে নেন।</p> <p><strong>৩. বরকতময় শহর : </strong>নবী করিম (সা.) আল্লাহর কাছে মদিনার সব কিছুতে বরকত দানের দোয়া করেন। তিনি আল্লাহর কাছে বলতেন, ‘হে আল্লাহ! মক্কায় যতটুকু বরকত রয়েছে, মদিনায় তার দ্বিগুণ বরকত দাও।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৩৩৯২)</p> <p><strong>৪. মদিনার সম্মান সংরক্ষিত : </strong>মদিনাকে শরিয়ত ‘হারাম’ বলে ঘোষণা করেছে। হারাম শব্দের একটি অর্থ নিষিদ্ধ এবং আরেকটি পবিত্র। দুটি অর্থই এই নগরীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। রাসুল (সা.) বলেন, “মদিনার ‘আইর ও সওর’ পর্বতের মাঝখানের স্থানটুকু হারাম।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৩৩৯৩)</p> <p><strong>৫. নিরাপদ নগরী মদিনা :</strong> আল্লাহ তাআলা মদিনার প্রবেশদ্বারগুলোতে ফেরেশতাদের মধ্য থেকে প্রহরী নিযুক্ত করেছেন, যাঁরা এতে মহামারি ও দাজ্জালের প্রবেশ প্রতিহত করবেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মদিনার পথে-প্রান্তরে রয়েছে (প্রহরী) ফেরেশতারা, (তাই) এখানে মহামারি ও দাজ্জাল প্রবেশ করতে পারবে না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৮৮০)</p> <p><strong>৬. মদিনাবাসীর বিশেষ মর্যাদা : </strong>মদিনায় বসবাসের প্রতি রাসুল (সা.) উৎসাহ দিয়েছেন। এমনকি এখানে বসবাসের ফলে দুঃখ-কষ্টে নিপতিত হলেও ধৈর্য ধারণ করতে বলেছেন এবং মদিনা ছেড়ে যেতে নিরুৎসাহ করেছেন। তিনি বলেন, ‘মানুষের কাছে এমন এক সময় আসবে, মদিনায় বসবাসরত ব্যক্তি তার চাচাতো ভাই ও আত্মীয়কে বলবে—চলো সচ্ছলতার দিকে, চলো সচ্ছলতার দিকে; অথচ মদিনাই তাদের জন্য উত্তম, যদি তারা জানত। যে সত্তার হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ করে বলছি, মদিনার প্রতি বিরাগভাজন হয়ে যে ব্যক্তিই এখান থেকে বের হয়ে যায়, আল্লাহ সেখানে তার চেয়ে উত্তম ব্যক্তি স্থলাভিষিক্ত করে দেন। সাবধান, মদিনা (কামারের) হাপরের ন্যায় নিকৃষ্ট ব্যক্তিকে বের করে দেবে। হাপর যেভাবে লোহার ময়লা বের করে দেয়, তেমনি মদিনাও তার মন্দ ব্যক্তিদের বের না করা পর্যন্ত কিয়ামত হবে না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৩৪১৮)</p> <p><strong>৭. মদিনায় মৃত্যু হওয়ার মর্যাদা : </strong>হাদিসে মদিনায় মৃত্যুবরণকারীর মর্যাদার কথা এসেছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মদিনায় মৃত্যুবরণ করতে সক্ষম, সে যেন তা করে। কেননা যে তথায় মৃত্যুবরণ করবে, আমি তার জন্য শাফায়াত করব।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৫৮১৮)</p> <p><strong>৮. মদিনা ঈমানের স্থান : </strong>রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনাকে দারুল ঈমান বা ঈমানের স্থান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘ঈমান মদিনার দিকে ফিরে আসবে, যেভাবে সাপ তার গর্তের দিকে ফিরে আসে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৮৭৬)</p> <p><strong>৯. মদিনায় জ্ঞানচর্চার মর্যাদা : </strong>মদিনা ছিল প্রথম বিদ্যালয়, যেখানে মহানবী (সা.) এমন একটি প্রজন্মকে প্রস্তুত করেছিলেন, যাঁদের হাতে তিনি ইসলামের আমানত তুলে দেন। ইসলামী জ্ঞানের সূতিকাগার হিসেবে মদিনার রয়েছে বিশেষ মর্যাদা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘মানুষ হন্যে হয়ে ইলম অনুসন্ধান করবে, তবে মদিনার আলেমের চেয়ে বেশি বিজ্ঞ কোনো আলেম তারা খুঁজে পাবে না।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৪২৭৭)</p> <p><strong>১০. মসজিদে নববী ও নবীজির রওজা :</strong> রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সব কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু ছিল মসজিদে নববী এবং এই মসজিদের আঙিনায়ই তিনি ঘুমিয়ে আছেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমার এই মসজিদে নামাজ আদায় (মক্কার) মাসজিদুল হারাম ছাড়া অন্য যেকোনো মসজিদে নামাজ আদায় অপেক্ষা এক হাজার গুণ উত্তম।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১১৯০)</p> <p>আর এই মসজিদেই রয়েছে রওজাতুম মিন রিয়াজিল জান্নাহ, যার সম্পর্কে স্বয়ং নবী (সা.) বলেন, ‘আমার মিম্বার ও ঘরের মাঝখানের অংশটুকু জান্নাতের বাগিচাগুলোর একটি।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১১৯৫)</p> <p><strong>মদিনায় যা করব এবং যা করব না</strong></p> <p><strong>১. রাসুল (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করা : </strong>মদিনায় আগমনের পর প্রথম কাজ হলো, হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে আদর্শ হিসেবে সর্বান্তঃকরণে মেনে নেওয়া।  কেননা তিনি মদিনাবাসীর মধ্যে হিদায়াতের আলো বিতরণ করেছিলেন এবং তারা তাঁর হিদায়াতলাভে ধন্য হয়েছিল।</p> <p><strong>২. পাপ পরিহার করা :</strong> নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মদিনায় কোনো পাপ করে, অথবা পাপাচারীকে আশ্রয় দান করে, তার ওপর আল্লাহ, ফেরেশতা ও সব মানুষের লা’নত পড়বে। কিয়ামতের দিন তার কাছ থেকে আল্লাহ কোনো ইবাদত ও দান গ্রহণ করবেন না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৮৭০)</p> <p><strong>৩. মানুষকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা : </strong>মদিনায় অবস্থানরত অপরাপর কোনো ব্যক্তির ওপর চড়াও না হওয়া, কারো জানমাল ও ইজ্জতের ওপর হামলা করা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা এবং কারো প্রতি মন্দ ইচ্ছা পোষণ না করা। নবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি এই নগরীর অধিবাসীদের কোনো ক্ষতি সাধন করতে চায়, আল্লাহ তাকে মিশিয়ে দেবেন (নিশ্চিহ্ন করে দেবেন), যেভাবে লবণ পানির মধ্যে মিশে যায়।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৩৪২৪)</p> <p>৪. বিপদ-আপদে ধৈর্য ধারণ।</p> <p>৫. ইবাদত, দোয়া, ইস্তিগফার ইত্যাদি বেশি বেশি করা।</p> <p>৬. বিশেষত মসজিদে নববীতে নামাজ জামাতসহকারে আদায় করা।</p> <p>৭. মাঝে মাঝে মসজিদে কুবায় নামাজ পড়া।</p> <p>৮. জান্নাতুল বাকিতে কবরস্থান ও উহুদের শহীদ সাহাবাদের কবরস্থান জিয়ারত করা উত্তম।</p> <p>আল্লাহ আমাদের পবিত্র মদিনার ফজিলত হৃদয়ঙ্গম করে সে অনুযায়ী আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।</p> <p> </p>