<p>মানুষ অনন্ত সম্ভাবনার অপূর্ব সৃষ্টি। মানবতাই ধর্ম, এমন বিশ্বাস ও মানববোধে পাশবিকতার চির অবসান মানবজীবনের অন্তর্নিহিত আবেদন। মানুষের মধ্যে বাস করা মরমিবোধে মানুষ তার প্রত্যয়, প্রত্যাশা, প্রার্থনায় খোঁজে এক অসীমত্বকে। মুসলিম আবহে বাংলা-বাঙালির মূল্যবোধে এই অসীমত্ব খোঁজার আকাঙ্ক্ষাই ‘সুফিবাদ’। তাসাউফেরই সমার্থক সুফিবাদ।</p> <p>মধ্যপ্রাচ্য, পারস্য উপকূলীয় দেশ, মধ্য এশিয়া ও উত্তর ভারত থেকে আসা মুসলিম মনীষীরা বাংলাদেশে সুফিবাদের বিস্তরণ ঘটান। যেমন : শাহ সুলতান রুমি,  বাবা আদম শহিদ, শাহ সুলতান বলখি, শাহ মখদুম রূপোস, শেখ ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকর, মখদুম শাহদৌলা প্রমুখ। তাঁরা ইসলামের নিগূঢ় রহস্য ও বুৎপত্তি জ্ঞানে সমৃদ্ধ ছিলেন। তাঁদের মধ্যে অলৌকিক শক্তির প্রকাশও লক্ষণীয় ছিল। সহজিয়া মানবপ্রেম ও বাগ্মিতায় তাঁরা সর্বসাধারণের খুব কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন।</p> <p>বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয়ের পর এ দেশে সুফিবাদ পায় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। ধর্ম প্রচারক, ব্যবসায়ী, শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গী হয়ে সুফি বা পীর-দরবেশদের আগমন ঘটে বাংলাদেশে। এ ধারার সুফি-দরবেশের মধ্যে শেখ জালালুদ্দিন তাবরিজ, শাহজালাল, খানজাহান আলি, শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা, শাহ ফরিদ উদ্দিন উল্লেখযোগ্য। এই পীর-দরবেশরা গ্রাম ও বিজন প্রান্তরে বসবাস করে এ দেশীয় ভাষা শিখে ইসলাম প্রচার-প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখে হয়ে যান বাংলা-বাঙালির প্রিয় স্বজন। ফিরে যাননি নিজের দেশে, বরং ঘুমিয়ে আছেন এ দেশেরই পবিত্র মাটিতে।</p> <p>আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন সুফিবাদের মর্মকথা। সুফ অর্থ পশম আর তাসাউফের অর্থ পশমি বস্ত্র পরিধানের অভ্যাস। অতঃপর মরমিতত্ত্বের সাধনায় কারো জীবন নিয়োজিত করার কাজকে বলা হয় তাসাউফ। যিনি নিজেকে এইরূপ সাধনায় সমর্পিত করেন ইসলামের পরিভাষায় তিনি সুফি নামে অভিহিত হন। (সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ)</p> <p>তাসাউফ বা সুফিবাদ বলতে অবিনশ্বর আত্মার পরিশুদ্ধ সাধনাকে বোঝায়। আত্মার পবিত্রতার মাধ্যমে ফানাফিল্লাহ (আল্লাহর সঙ্গে অবস্থান) এবং ফানাফিল্লাহর মাধ্যমে বাকাবিল্লাহ (আল্লাহর সঙ্গে স্থায়ীভাবে বিলীন হওয়া) লাভ করা যায়। মহান আল্লাহ অদৃশ্য ও নিরাকার। তাঁর মধ্যে ফানা হওয়ার জন্য নিরাকার শক্তির প্রতি প্রেমই একমাত্র মাধ্যম। সুফিগণের উপলব্ধিতে এ সাধনাকে ‘তরিকত’ বা আল্লাহ-প্রাপ্তির পথ বলা হয়। এ সাধনায় একজন পথপ্রদর্শক মুর্শিদ দরকার হয়। তখনই ঘটে:</p> <p>ক. ফানাফিশ-শাইখ</p> <p>খ. ফানফির-রাসুল</p> <p>গ. ফানাফিল্লাহ</p> <p>এরপরই অর্জিত হয় বাকাবিল্লাহর উচ্চমর্যাদা।</p> <p>সুফির অন্তরে তখন সার্বক্ষণিক শান্তি ও আনন্দ বিরাজ করে। এ পর্যায়ের সুফিরা লাভ করেন বিশেষ আধ্যাত্মিক ক্ষমতা, হয়ে যান আল্লাহর বন্ধু। প্রিয়নবী (সা.) বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার কোনো বন্ধুর সঙ্গে শত্রুতা করবে, তার বিরুদ্ধে আমার যুদ্ধের ঘোষণা...তখন আমি তার ওই কান হয়ে যাই, যার দ্বারা সে শোনে, তার ওই চোখ হয়ে যাই, যার দ্বারা সে দেখে, তার ওই হাত হয়ে যাই, যার দ্বারা সে ধরে এবং তার ওই পা হয়ে যাই, যার দ্বারা সে চলে...।’ (হাদিসে কুদসি, বুখারি)</p> <p>সুফিবাদীধারায় বিকশিত হয় এমন প্রধান চারটি তরিকা :</p> <p>১. আবদুল কাদির জিলানি (রহ.) প্রতিষ্ঠিত কাদেরিয়া তরিকা,</p> <p>২. সুলতানুল হিন্দ খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি প্রতিষ্ঠিত চিশতিয়া তরিকা,</p> <p>৩. খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দি প্রতিষ্ঠিত নক্শবন্দিয়া তরিকা,</p> <p>৪. শেখ আহমদ মুজাদ্দিদ-ই-আলফি সানি সারহিন্দি প্রতিষ্ঠিত মুজাদ্দিদিয়া তরিকা।</p> <p> </p> <p><em>লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, </em></p> <p><em>ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ কাপাসিয়া, গাজীপুর।</em></p>