<p>মুমিনের বৈশিষ্ট্য হলো কোনো বিশ্বাস ভঙ্গ না করা এবং কারো সঙ্গে গাদ্দারি না করা। মুনাফিকের চরিত্র এর সম্পূর্ণ বিপরীত। মুনাফিক অঙ্গীকার করলে তা ভঙ্গ করে। আমানতের খেয়ানত করে, বিশ্বাস ভঙ্গ করে, গাদ্দারি করে। প্রতিশ্রুতি পূরণের ব্যাপারে ইসলাম জোরালো তাগিদ দিয়েছে। এ ব্যাপারে সামান্যতম শৈথিল্য প্রদর্শন মানবসমাজে মহাবিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা প্রতিশ্রুতি পালন করবে, নিশ্চয়ই প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৩৪)</p> <p>প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা নবী-রাসুলদের বৈশিষ্ট্য। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘এ কিতাবে ইসমাইলের বৃত্তান্তও বিবৃত করো। নিশ্চয়ই সে ছিল প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্রে সত্যবাদী এবং রাসুল ও নবী।’ (সুরা : মারইয়াম, আয়াত : ৫৪)</p> <p>কোনো অমুসলিমের সঙ্গেও বিশ্বাস ভঙ্গ করার অনুমতি নেই। ইসলামে অমুসলিমদের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি লঙ্ঘন করতেও নিষেধ করা হয়েছে। অমুসলিমদের সঙ্গেও বিশ্বাসঘাতকতা যাবে না। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের সাহায্য চাইলে তাদের সাহায্য করা তোমাদের অবশ্য কর্তব্য, অবশ্য সে সাহায্য যদি এমন কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হয়, যাদের সঙ্গে তোমাদের কোনো চুক্তি আছে, তাদের বিরুদ্ধে নয়। তোমরা যা কিছু করো, আল্লাহ তা ভালোভাবে দেখেন।’ (সুরা : আনফাল, আয়াত : ৭২)</p> <p>কারো সঙ্গে যদি কোনো চুক্তি থাকে, তাহলে সেই চুক্তি যেকোনো মূল্যে পূরণ করতে হবে। আবু বাকরাহ (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি অকারণে কোনো চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তিকে হত্যা করবে, তার জন্য আল্লাহ জান্নাত হারাম করে দেবেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ২৭৬০)</p> <p>কারো সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হলে চুক্তি চলাকালীন বিশ্বাস ভঙ্গ করা যাবে না। চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে কারো সঙ্গে যুদ্ধ করার অনুমতি দেয়নি ইসলাম। হিময়ার গোত্রের সুলাইম ইবনু আমির (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মুআবিয়া (রা.) ও রোমকদের মধ্যে (নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত যুদ্ধ বিরতির) চুক্তি হয়। মুআবিয়া (রা.) তাদের জনপদে সফর করছিলেন এবং চুক্তির মেয়াদ শেষ হতেই তিনি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। তখন এক ব্যক্তি আরবি বা তুর্কি ঘোড়ায় চড়ে উপস্থিত হয়ে বলেন, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার; ওয়াদা রক্ষা করতে হবে, ভঙ্গ করা চলবে না। লোকেরা দেখল, লোকটি আমর ইবনু আসবাহ (রা.)। অতঃপর মুআবিয়া (রা.) তাঁকে ডেকে পাঠালেন। তিনি আমর (রা.)-কে (কিসের ওয়াদা ভঙ্গ হচ্ছে তা) জিজ্ঞেস করায় তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, যদি কারো সঙ্গে কোনো জাতির চুক্তি থাকে, তাহলে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে তা নবায়ন করে শক্তিশালী করা যাবে না এবং ভঙ্গ করাও যাবে না। যখন চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে তখন ঘোষণা দিয়ে চুক্তি ভঙ্গ করবে। অতঃপর মুআবিয়া (রা.) (যুদ্ধ না করে) ফিরে আসেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ২৭৫৯)</p> <p>গাদ্দারি হলো মুনাফিকি বা কপটতার একটি রূপ। ঈমান ও মুনাফিকি এক ব্যক্তির মধ্যে একত্র হতে পারে না। আল্লাহ বলেন, ‘তাদের মধ্যে এমন কিছু মানুষ আছে, যারা আল্লাহর সঙ্গে অঙ্গীকার করেছিল, আল্লাহ যদি আমাদের নিজ অনুগ্রহ থেকে দান করেন, তাহলে অবশ্যই আমরা দান-খয়রাত করব এবং সৎ লোকদের অন্তর্ভুক্ত হবো। তঃপর যখন তিনি তাদের তাঁর অনুগ্রহ দান করলেন, তারা তাতে কার্পণ্য করল এবং বিমুখ হয়ে ফিরে গেল। সুতরাং পরিণামে তিনি তাদের অন্তরে মুনাফিকি রেখে দিলেন সেদিন পর্যন্ত, যেদিন তারা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। তারা আল্লাহকে যে ওয়াদা দিয়েছে তা ভঙ্গ করার কারণে এবং তারা যে মিথ্যা বলেছিল তার কারণে।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৭৫-৭৭)</p> <p>গাদ্দার মূলত নিজের ক্ষতি করে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘...অতঃপর যে কেউ ওয়াদা ভঙ্গ করলে তার ওয়াদা ভঙ্গের পরিণাম বর্তাবে তারই ওপর। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে দেওয়া ওয়াদা পূরণ করবে অচিরেই আল্লাহ তাকে মহা পুরস্কার দেবেন।’ (সুরা : ফাতহ, আয়াত : ১০)</p> <p>দুনিয়ায়ও গাদ্দারির ফল ভালো হয় না। ইতিহাস সাক্ষী, যুগে যুগে যারা বেঈমান ও গাদ্দার, তাদের করুণ পরিণতি বরণ করতে হয়েছিল। গাদ্দারির কারণে মহান আল্লাহ ইহুদি জাতিকে অভিশপ্ত করেছেন এবং তাদের অন্তর শক্ত করে দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘...সুতরাং তারা (ইহুদিরা) অঙ্গীকার ভঙ্গের কারণে আমি তাদের লানত দিয়েছি এবং তাদের অন্তর করেছি কঠোর।’ (সুরা : মায়েদা, আয়াত : ১৩)</p> <p>গাদ্দার বা বিশ্বাসঘাতক কিয়ামতের দিবসে বিশেষ চিহ্ন নিয়ে উঠবে। ইবনে মাসউদ, ইবনে উমর ও আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তাঁরা বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, কিয়ামতের দিন প্রত্যেক গাদ্দারের জন্য একটি করে (বিশেষ) পতাকা নির্দিষ্ট হবে। বলা হবে—এটা অমুক ব্যক্তির (গাদ্দারির) প্রতীক। (বুখারি, হাদিস : ৬১৭৮)</p> <p>অন্য হাদিসে এসেছে, আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, কিয়ামতের দিন প্রত্যেক গাদ্দারের পাছায় একটা পতাকা থাকবে, যাকে তার গাদ্দারি অনুপাতে উঁচু করা হবে। জেনে রেখো! রাষ্ট্রনায়কের চেয়ে বড় গাদ্দার আর অন্য কেউ হতে পারে না (যদি রাষ্ট্রনায়ক গাদ্দার হয়)। (মুসলিম, হাদিস : ১৭৩৮)</p> <p>আল্লাহ নিজেই কিয়ামতের দিন গাদ্দারের বিরুদ্ধে বাদী হবেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন যে কিয়ামতের দিবসে আমি নিজে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হবো। এক ব্যক্তি, যে আমার নামে ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করল। আরেক ব্যক্তি, যে কোনো স্বাধীন মানুষকে বিক্রি করে তার মূল্য ভোগ করল। আরেক ব্যক্তি, যে কোনো মজুর নিয়োগ করে তার হতে পুরো কাজ আদায় করে এবং তার পারিশ্রমিক দেয় না। (বুখারি, হাদিস : ২২২৭)</p> <p>মহান আল্লাহ আমাদের গাদ্দারি থেকে রক্ষা করুন।</p>