<p>সালফে সালেহিন বলা হয়, পূর্ববর্তী এমন মুসলিম ব্যক্তিত্বদের, যারা নবী করিম (সা.)-এর নির্দেশিত পন্থা আমৃত্যু অটল ও অবিচলতার সঙ্গে অনুসরণ করেছেন। কোরআনের ভাষায় তাদের পরিচয়, ‘যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রাসুলুল্লাহর মধ্যে উত্তম নমুনা আছে।’ (সুরা আহজাব, আয়াত : ২১)</p> <p>মূলত সালফে সালেহিনের যুগ বলতে সাহাবা, তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈনদের যুগকে বলা হয়। তাঁরা সর্বক্ষেত্রে পূর্ণ নিষ্ঠার সঙ্গে নবীজি (সা.)-এর অনুসরণ করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, নবী (সা.)-কে একবার জিজ্ঞেস করা হলো, কোন মানুষ সর্বোত্তম? তিনি বলেন, আমার সময়ের মানুষ। এরপর তাদের পরবর্তী লোকেরা, এরপর তাদের পরবর্তী লোকেরা। এরপর এমন লোক আসবে যে তাদের সাক্ষ্য কসমের ওপর অগ্রগামী হবে, আর কসম সাক্ষ্যের ওপর অগ্রগামী হবে। (বুখারি, হাদিস : ৬৬৫৮)</p> <p>সালফে সালেহিন তথা আমাদের পূর্বসূরিগণ আমল করার ক্ষেত্রে সব সময় কোরআন ও সুন্নাহকে সামনে রাখতেন। তাঁদের সততা-সত্যবাদিতা সম্পর্কে স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং আমাদের তাঁদের অনুসরণ করার আদেশ দিয়েছেন। হাদিস শরিফে ইরবাজ ইবনে সারিয়াহ (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,  তোমরা (ইবাদতের ক্ষেত্রে) নতুন নতুন বিষয় আবিষ্কার করা থেকে দূরে থাকবে। কেননা তা গুমরাহী। তোমাদের মধ্যে কেউ সে যুগ পেলে সে যেন আমার সুন্নতে ও সৎপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নতে দৃঢ়ভাবে অবিচল থাকে। তোমরা এসব সুন্নতকে চোয়ালের দাঁতের সাহায্যে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরো। (তিরমিজি, হাদিস : ২৬৭৬)</p> <p>সালফে সালেহিন বা পূর্ববর্তী মনীষীরা অনেক অনুকরণীয় বৈশিষ্ট্য ও গুণের অধিকারী ছিলেন। নিম্নে তাঁদের কিছু গুণাবলি উল্লেখ করা হলো—</p> <p><strong>সদাচারের শ্রেষ্ঠ নমুনা : </strong>উত্তম আখলাক ও সচ্চরিত্রে সালফে সলেহিন ছিলেন সর্বাগ্রে। দয়া-অনুগ্রহ, নম্রতা-বিনয় এবং ভদ্রতা ইত্যাদি গুণে ছিলেন অনন্য। অসৎ আচার-আচরণ থেকে বিরত থাকা ছিল তাদের সৌন্দর্য। তা ছাড়া সদাচার অবলম্বন করা কোরআন ও হাদিসেরই নির্দেশনা। সদাচারের প্রতি উৎসাহিত করে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমাদের কেউ সালাম করে, তখন তোমরা তাকে তদপেক্ষাও সালাম দিও কিংবা (অন্ততপক্ষে) সেই শব্দেই তাকে জবাব দিয়ো।  নিশ্চয়ই আল্লাহ সব কিছুর হিসাব রাখেন। (সুরা নিসা, আয়াত : ৮৬)</p> <p><strong>মোনাফেকি থেকে সতর্কতা অবলম্বন : </strong>আমাদের পূর্বসূরিরা নিফাক থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতেন। কারণ নিফাক এমন একটি চরিত্র, যা মুমিনের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনে খারাপ প্রভাব ফেলে। যার অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে নবী করিম (সা.) বলেন, মুনাফিকের দৃষ্টান্ত ওই বকরির মতো, যা দুই পালের মধ্যে উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরপাক করে। একবার এদিকে আবার অন্যদিকে। (মুসলিম, হাদিস : ৬৯৩৬)</p> <p>ইমাম ইবনে কায়্যিম (রহ.) বলেন, আল্লাহর শপথ, যাদের অন্তরে পরিপূর্ণ ঈমান রয়েছে তারা নিফাকে পতিত হওয়ার ব্যাপারে আশঙ্কায় অত্যধিক ভীত থাকে। আর অন্য যাদের ঈমান কণ্ঠনালিও অতিক্রম করে না তারাই দাবি করে যে তাদের ঈমান জিবরাইল ও মিকাঈল  (আ.)-এর ঈমানের মতো।</p> <p><strong>ইবাদতের প্রতি দৃঢ় প্রত্যয় : </strong>আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় ইবাদতের প্রতি অত্যধিক আগ্রহ, বিভিন্ন নফল আমলের জন্য আলাদা সময় নির্ধারণ এবং যেসব জিনিস ইবাদতে অমনোযোগিতা সৃষ্টি করে তা থেকে নিজেকে দূরে রাখা ছিল সালাফদের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তাআলা বলেন, এ বিষয়ে (জান্নাতে নেয়ামতরাজি লাভের জন্য) প্রতিযোগীদের প্রতিযোগিতা করা উচিত। (সুরা মুতাফফিফিন, আয়াত : ২৬)</p> <p>আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) অত্যধিক গুরুত্বের সঙ্গে জামাতে নামাজ পড়তেন। কোনো দিন জামাত ছুটে গেলে সারা দিন রোজা রাখতেন, সারা রাত ইবাদত করতেন এবং একজন গোলাম আজাদ করতেন। রাত জেগে ইবাদতের প্রতি তাঁদের অন্য রকম উৎসাহ ছিল। আমের ইবনে আবদুল্লাহ (রহ.)-কে তাঁর রাতজাগার পরিমাণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, আমি শুধু দিনে রাত পর্যন্ত রোজা রাখি আর রাতে দিন পর্যন্ত সজাগ থাকি। এটা তেমন বিরাট কিছু তো নয়। (সিলসিলাতু উলুউল হিম্মাহ : ১৬/১০)</p> <p><strong>বিলাসী জীবনের প্রতি অনাগ্রহ : </strong>এ তুচ্ছ দুনিয়ার ভোগ-বিলাসিতাকে দূরে ঠেলে দেওয়ার অনন্য উদাহরণ হলেন আমাদের পূর্ববর্তী সালাফগণ। জান্নাতি নারীদের নেত্রী ফাতিমা (রা.)-এর ঘটনা। আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, ফাতিমা (রা.) একটি খাদিম (সেবক) চাইতে নবী (সা.)-এর কাছে এলেন। তিনি বলেন, আমি কি তোমাকে এর চেয়ে অধিক কল্যাণদায়ক বিষয়ে খবর দেব না? তুমি শয়নকালে তেত্রিশবার ‘সুবহানাল্লাহ’, তেত্রিশবার ‘আল হামদুলিল্লাহ’ এবং চৌত্রিশবার ‘আল্লাহু আকবার’ বলবে। পরে সুফিয়ান বলেন, এর মধ্যে যেকোনো একটি চৌত্রিশবার। আলী (রা.) বলেন, অতঃপর কখনো আমি এগুলো ছাড়িনি। জিজ্ঞেস করা হলো সিফফিনের রাতেও না? তিনি বলেন, সিফফিনের রাতেও না। (বুখারি, হাদিস : ৫৩৬২)</p> <p><strong>আমল কবুল না হওয়ার ভয়ে থাকা : </strong>সালফে সালেহিনদের অন্যতম গুণ ছিল, তাঁরা ফরজ-ওয়াজিব আদায় করার পাশাপাশি নফল ইবাদতেও বেশ গুরুত্ব দিতেন। অন্যদিকে নিজেদের আমল কবুল হওয়া নিয়েও সর্বদা ভীতসন্ত্রস্ত থাকতেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে সুরা মুমিনুনের নিচের আয়াত, অর্থ: ‘এবং যারা যা কিছু দান করে, তা ভীত ও কম্পিত হৃদয়ে দান করে। কেননা তাদের আপন রবের কাছেই ফিরে যেতে হবে।’ এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম যে তারা কি মদপায়ী বা চোর হবে? তিনি উত্তর দিলেন, না, হে সিদ্দিক তনয়া! তারা নিয়মিত নামাজ আদায় করবে, রোজা রাখবে, দান-সদকাও করবে আবার এই ভেবে ভীত থাকত যে (কোনো ভুলের কারণে) তাদের  আমল কবুল করা হবে না। তারাই কল্যাণ দ্রুত অর্জন করে এবং তারা তাতে অগ্রগামী। (তিরমিজি, হাদিস : ৩২৭৫)</p> <p>সুতরাং প্রতিটি মুসলমানের উচিত নিজেদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে সালফে সালেহিনের পদাঙ্ক অনুসরণ করা।</p>