<p>আধুনিক বিজ্ঞানের এই যুগে মানুষ অনেকটাই প্রযুক্তিনির্ভর। এই নির্ভরতা সৃষ্টি হয়েছে দ্বিন পালনের ক্ষেত্রেও। বিশেষত নামাজের সময় নির্ধারণ, সাহরি ও ইফতারের সময় জানতে বহু মানুষ বিশেষ অ্যাপ (অ্যাপলিকেশন) ব্যবহার করে। ইসলামী শরিয়ত ইতিবাচক ও সহায়ক ক্ষেত্রে যেকোনো প্রযুক্তি ব্যবহারের অনুমোদন দেয়। সে হিসেবে নামাজ ও রোজার সময় জানতে অ্যাপ ব্যবহার করার অনুমতিও শরিয়তে আছে। তবে এ ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক।</p> <p><strong>সতর্কতা কেন প্রয়োজন</strong> : আল্লাহ কিছু কিছু ইবাদতের জন্য সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তা আদায় করতে হয়। যেমন নামাজ, রোজা, হজ, কোরবানি ইত্যাদি। এসব ইবাদত পালনের জন্য নির্ভুল সময় নির্ধারণ করা আবশ্যক। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নির্ধারিত সময়ে নামাজ আদায় করা মুমিনদের জন্য অবশ্য কর্তব্য।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১০৩)</p> <p>উল্লিখিত আয়াতের ব্যাখ্যায় আলেমরা বলেন, যেহেতু নামাজ নির্ধারিত সময়ে আদায় করতে হয়, তাই নামাজের সময় সম্পর্কে যথাযথ অনুসন্ধান করাও মুমিনের কর্তব্য। যেন সে নির্ভুল সময়ে নামাজ আদায় করতে পারে। সময়নির্ভর অন্যান্য ইবাদতের বিধানও নামাজের অনুরূপ।</p> <p><strong>অ্যাপ কতটা নির্ভরযোগ্য</strong> : অ্যাপের গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে অ্যাপ প্রস্তুতকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর। তারা যদি অ্যাপ তৈরির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা ও তাকওয়াসংগত পদ্ধতি অবলম্বন করে, তাহলে অ্যাপের ওপর নির্ভর করা যায়। আধুনিক যুগের মুফতিরা বলেন, শরিয়তের বিধান পালনের ক্ষেত্রে অ্যাপের মর্যাদা অনুমান (জন্ন) বা প্রবল অনুমান (গালিবুজ-জন্ন) থেকে বেশি নয়, যা আমলের ক্ষেত্রে পুরোপুরি নিশ্চয়তা (ইয়াকিন) দেয় না; বরং তার জন্য চিন্তাভাবনা ও অনুসন্ধানের প্রয়োজন হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তাদের বেশির ভাগ অনুমানেরই অনুসরণ করে, সত্যের পরিবর্তে অনুমান কোনো কাজে আসে না। তারা যা করে নিশ্চয়ই আল্লাহ সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত।’ (সুরা : ইউনুস, আয়াত : ৩৬)</p> <p><strong>অ্যাপ কারা ব্যবহার করবে</strong> : প্রাজ্ঞ আলেমরা বলেন, মুসলিম দেশের নাগরিক—যারা খুব সহজে নামাজ, রোজাসহ অন্যান্য ইবাদতের সময় সম্পর্কে জানতে পারেন, তারা অ্যাপের ওপর নির্ভর না করে স্থানীয় আল্লাহভীরু ও অভিজ্ঞ আলেম এবং দ্বিনি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নির্ভর করবে। কেননা এটাই দ্বিনের পক্ষে বেশি নিরাপদ। আর যারা অমুসলিম দেশে বসবাস করে, যেখানে দ্বিনি প্রতিষ্ঠান, শরিয়তের বিধি-বিধান সম্পর্কে পারদর্শী আলেম ও দ্বিনি শিক্ষার উপকরণ সহজলভ্য নয়, তারা অ্যাপের ওপর নির্ভর করতে পারে। একইভাবে মুসলিম দেশের যেসব নাগরিক মরুভূমি, নদী, সমুদ্র বা লোকালয় থেকে দূরের কোনো স্থানে থাকে, যাদের পক্ষে সহজেই ইবাদতের সময় জানা সম্ভব নয়, তারাও অ্যাপ ব্যবহার করতে পারে। এ ক্ষেত্রে শর্ত হলো অ্যাপ ব্যবহারকারী প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান করে নেবে। (ইসলাম ওয়েব ডটনেট)</p> <p><strong>অ্যাপনির্ভর হওয়ার সমস্যা</strong></p> <p>নামাজ-রোজার ক্ষেত্রে অ্যাপের ওপর নির্ভর করার ফলে কিছু দ্বিনি ও সামাজিক সমস্যা তৈরি হয়ে থাকে। যেমন—</p> <p><strong>১. ভুল সময়ে ইবাদত</strong> : অ্যাপ তৈরির ক্ষেত্রে স্থানীয় সময়ের অনুসরণ না করা, ব্যবহারকারীর অদক্ষতা, অ্যাপের মানদণ্ড ঠিক না থাকা ইত্যাদি কারণে অনেক সময় অ্যাপ ব্যবহারকারী ভুল সময়ে নামাজ আদায় ও সাহরি-ইফতার করে।</p> <p><strong>২. উত্তম সময়ে ইবাদত না করা</strong> : অ্যাপগুলোতে সাধারণত সময়ের শুরু ও শেষ সময় চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু ইবাদতের উত্তম সময় চিহ্নিত করা হয় না। ফলে অ্যাপের ওপর নির্ভরকারী উত্তম সময়ে ইবাদত করতে পারে না। কখনো কখনো অ্যাপ ব্যবহারকারী এমন প্রান্তিক সময়ে ইদাবত করে যে তার ইবাদতই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়।</p> <p><strong>৩. সামাজিক বিশৃঙ্খলা</strong> : একাধিক অ্যাপ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সেগুলোর নির্দেশিত সময়ে অমিল রয়েছে। ফলে একই সমাজের দুই ব্যক্তিকে দুই সময়ে নামাজ আদায় ও সাহরি-ইফতার করতে দেখা যায়। এমনিভাবে অ্যাপের ওপর নির্ভর করায় গণমাধ্যমের আজান সম্প্রচারেও সময়ের ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। যা ইবাদত পালনে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে।</p> <p><strong>৪. মসজিদের সঙ্গে মানসিক দূরত্ব</strong> : যখন অ্যাপের ব্যবহার ছিল না বা কম ছিল, তখন মানুষ সাধারণত মসজিদের আজানের অপেক্ষা করত। কিন্তু অ্যাপ ব্যবহারের কারণে মসজিদনির্ভরতা কমছে। যা মসজিদের সঙ্গে মুসল্লিদের মানসিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে।</p> <p><strong>অ্যাপ কিভাবে নির্বাচন করব</strong></p> <p>যৌক্তিক কারণে যাদের অ্যাপ ব্যবহার করতে হয়, তাদের নিম্নোক্ত বিষয়গুলো যাচাই করা উচিত—</p> <p><strong>১. নির্মাতা কারা</strong> : ইবাদত বিষয়ক অ্যাপ ব্যবহারের আগে এর নির্মাণকারী কারা তা যাচাই করা আবশ্যক। কেননা অ্যাপ নির্মাণকারী প্রকারান্তে ইবাদতের সময় সম্পর্কে সংবাদদাতা। শরিয়তের বিধান হলো, ইবাদতের সময় বিষয়ক সংবাদ গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য সংবাদদাতার ভেতর এমন বৈশিষ্ট্য থাকা আবশ্যক, যাতে তার প্রতি আস্থা রাখা যায়। (ফাতাওয়ায়ে তাতারখানিয়া : ২/২৫২)</p> <p><strong>২. আলেমরা সম্পৃক্ত আছেন কি না </strong>: ইবাদতের সময়ের সঙ্গে শরিয়তের বহু সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বিষয় জড়িত, যা একজন বিশেষজ্ঞ আলেমের পক্ষেই জানা সম্ভব। তাই এমন অ্যাপই ব্যবহার করা উচিত যার সঙ্গে আলেমরা সরাসরি সম্পৃক্ত অথবা যা নির্মাণে বিশেষজ্ঞ আলেম দলের প্রস্তুতকৃত সময়সূচি অনুসরণ করা হয়েছে।</p> <p><strong>৩. কোন মাজহাবের অনুসারী</strong> : ইবাদতের সময়সীমা নিয়ে মাজহাবের ইমামদের ভেতর মতভিন্নতা আছে। তাই ব্যক্তি যে মাজহাবের অনুসরণ করে থাকেন, সে মাজহাবের নিয়মানুসারে প্রস্তুতকৃত অ্যাপ ব্যবহার করবেন।</p> <p><strong>৪. লোকেশন পরিবর্তন করা যায় কি না</strong> : নামাজ ও রোজার ক্ষেত্রে ব্যক্তির অবস্থানস্থলের সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের সময় অনুসরণ করা আবশ্যক। ব্যক্তির অবস্থান পরিবর্তনের ফলে তাতে পরিবর্তন হয়ে যায়। যেমন ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম, খুলনা ও রংপুরের সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের সময়ে পার্থক্য আছে। সুতরাং এমন অ্যাপই নির্বাচন করা প্রয়োজন, যাতে লোকেশন (ব্যক্তির অবস্থান) পরিবর্তনের সুযোগ আছে।</p> <p><strong>যেসব বিষয়ে সতর্কতা কাম্য</strong></p> <p>ইবাদত বিষয়ক অ্যাপ ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোতে সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক।</p> <p><strong>১. সময় যাচাই করা </strong>: অ্যাপে স্থানীয় সময় অনুসরণ করছে, নাকি অন্য কোনো সময় অনুসরণ করছে তা যাচাই করা।</p> <p><strong>২. লোকেশন পরিবর্তন করা</strong> : ব্যক্তির অবস্থান পরিবর্তন হলে অ্যাপের লোকেশনও পরিবর্তন করে নেওয়া।</p> <p><strong>৩. মাজহাব ঠিক করে নেওয়া </strong>: উন্নত অ্যাপগুলোতে ফিকহশাস্ত্রের প্রধান চার মাজহাবের সময় ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দেওয়া থাকে। যা ‘প্রেয়ার টাইম ক্যালকুশেন মেথড’ (Prayer Time Calculation Method)  অপসনে পাওয়া যায়। এটা পরিবর্তন করে নিলে সব কিছুর সময় নির্ধারিত মাজহাব অনুসারে প্রদর্শন করে।</p> <p><strong>৪. মোবাইল ফোনের সময় ঠিক করে নেওয়া</strong> : যদি মোবাইল ফোনের সময় অটোমেটিক ঠিক না হয়, তবে তা ঠিক করে নেওয়া। কেননা মোবাইল অ্যাপগুলো সাধারণ ফোন সেটের সময় অনুসরণ করে থাকে।</p> <p><strong>৫. সময়সূচির সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া </strong>: ইবাদতসংক্রান্ত অ্যাপ ব্যবহারের আগে নির্ভরযোগ্য দ্বিনি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক তৈরি সময়সূচির সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া আবশ্যক। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ও ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বাংলাদেশ, বসুন্ধরার প্রকাশিত স্থায়ী সময়সূচি অনুসরণ করা যেতে পারে।</p> <p><strong>৬. আজানের শব্দ নিয়ন্ত্রণ</strong> : মোবাইল ফোনে ব্যবহৃত অ্যাপের আজানের শব্দ নিয়ন্ত্রণ করা আবশ্যক। কেননা কখনো এমন সময় ও স্থানে আজান বেজে ওঠে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। যেমন টয়লেটে অবস্থানের সময়। এমনিভাবে ইফতারের সময় মোবাইল ফোনে আজান হলে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে।</p> <p><strong>৭. কেবল প্রয়োজনে ব্যবহার</strong> : মোবাইল অ্যাপ কেবল প্রয়োজনের সময় ব্যবহার করবে। যেখানে মসজিদের আজান শোনা যায়, সেখানে মসজিদের আজান শোনার চেষ্টা করবে। এটাই নিরাপদ ও উত্তম। কেননা আজান শোনা ও তার উত্তর দেওয়া ইবাদত।</p> <p><strong>৮. সাহরির সময় সতর্কতা</strong> : মোবাইল ফোনের অ্যাপগুলোতে সাধারণত ফজরের আজানের সময় চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু বিজ্ঞ আলেমরা বলেন, সতর্কতাস্বরূপ অন্তত পাঁচ মিনিট আগে পানাহার শেষ করা উত্তম। তাই সাহরির ক্ষেত্রে বিশেষ সতকর্তা কাম্য। (ফাতাওয়ায়ে ফকীহুল মিল্লাত : ৩/১৪৩)</p> <p><strong>৯. আরবি মাসের তারিখ পরিবর্তন </strong>: মোবাইল ফোনের অ্যাপগুলোর আরবি সনের তারিখের সঙ্গে বাস্তব তারিখের অমিল থাকে। তাই প্রত্যেক আরবি মাসের শুরুতে আরবি মাসের তারিখ ঠিক করে নেওয়া আবশ্যক।</p> <p><strong>১০. কেবলা নির্ণয়ে সতর্কতা</strong> : একাধিক অ্যাপ যাচাই করে দেখা গেছে কেবলা নির্ণয়ে মোবাইল ফোনের অ্যাপগুলো বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে থাকে। তাই কেবলা নির্ণয়ে অ্যাপের ওপর নির্ভর না করাই উত্তম। বিকল্প হিসেবে এনালগ কম্পাস ব্যবহার, স্থানীয়দের কাছে জিজ্ঞাসা করা, সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত অনুসরণ করা অথবা আল্লাহ প্রদত্ত মেধা ও জ্ঞানের মাধ্যমে চিন্তা-ভাবনা ও অনুসন্ধান করা যেতে পারে।</p> <p>আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন</p> <p><br />  </p>