<p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="color:black">মহাদেব সাহার একটি কাব্যগ্রন্থের নাম </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="color:black">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="color:black">হাতে অমৃতকুম্ভ, পান করি বিষ</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="color:black">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="color:black">  (২০১৬)। প্রশ্ন ওঠে স্বভাবতই, হাতে অমৃতকুম্ভ থাকতেও কবিকে কেন বিষ পান করতে হয়? নিজের নাগালে ও নিয়ন্ত্রণে থাকা সঞ্জীবনী থাকতেও জীবনহন্তারক উপাদান কেন ঠোঁট ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়? যায় হয়তো। কারণ জীবনের মর্ম বহুমাত্রিক। বিচিত্র পথে তার গতি। সেই পথের নিবিষ্ট একজন পরিব্রাজক প্রচলিত জীবনের পথে কিভাবে যাবেন? তিনি তো জীবনের গভীরে গিয়ে জীবন ছেঁচে ছেঁচে, আবিষ্ট হয়ে হয়ে, গরলে ডুবে ডুবে মর্মান্তিক সব বিষয়-আশয় ঘেঁটে ঘেঁটে দেখেছেন</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="color:black">—</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="color:black">আপাত যা অমৃতকুম্ভ, তা আসলে বিষের আধার। তাই তো সেখানে যা আছে তা অমৃত নয়, বিষ।</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="color:black">তিনিই আবার জানাচ্ছেন, </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="color:black">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="color:black">আমি সব বিষ করেছি অমৃত</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="color:black">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="color:black">। কবি বলেই তিনি এই পরিক্রমার একজন পরিব্রাজক হয়ে মেপে মেপে দেখছেন জীবনের সবগুলো পিঠ। নির্মাণে ও বিনির্মাণে এভাবেই তাঁর হাতে থাকা অমৃতকুম্ভের তরল কখনো বিষ হয়ে ওঠে, কখনো তিনি সব বিষকে অমৃতে রূপান্তরিত করেন। নির্মাণ-বিনির্মাণ-রূপান্তরে এইভাবে পার করলেন তিনি আশিটি বসন্ত। ৫ আগস্ট থেকে তিনি হয়ে যাবেন অশীতিপর। অশীতিপর</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="color:black">—</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="color:black">কিন্তু তরুণ। কারণ তিনি আজও সৃষ্টিমগ্ন। আর যিনি সৃষ্টিমগ্ন থাকেন তিনি কখনো বৃদ্ধ হন না, কখনো অশীতিপর হন না, তিনি থাকেন সদাতরুণ। মহাদেব সাহা আমাদের সেই সদাতরুণ কবি।</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="color:black">এই আট দশকের বসন্তে তিনি নানা কিছু দেখেছেন। শৈশবজীবনের যা কিছু সাধারণত হয়ে থাকে তা তো অবশ্যই। পাশাপাশি দেখেছেন অধিকতর কিছু। কিছু ব্যতিক্রমও। পঞ্চাশের দশকের কথা। ওই সময়ে দশ বছর বয়সে যেখানে গ্রামের কোনো শিশুর  জগৎ ভরে থাকে পায়ে চলা পথে কাছের স্কুল আর বিকেলের ফুল-পাখি-ঘাস, সেখানেও মহাদেব সাহা ব্যতিক্রম। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচারণায় ৩৪ বছরের টগবগে এক যুবক নেতা এসেছিলেন। পরবর্তী সময়ে যিনি হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর জন্য অন্য যুবকরা তোরণ বানালে শিশু মহাদেব সাহার মনে গুঞ্জরণ তুলেছিল, </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="color:black">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="color:black">পাতার তোরণ গড়েছি আমরা মুজিব তোমার নামে।</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="color:black">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="color:black"> শিশু মহাদেবের  নিষ্পাপ শিশুচোখ কী যে দেখেছিল শেখ মুজিবের ভেতরে কে জানে! শেখ মুজিবও যে কী দেখেছিলেন শিশু মহাদেবের ভেতরে! কিশোর কবিকে কোলে তুলে নিয়ে বলেছিলেন তিনি, </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="color:black">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="color:black">এই ছেলে একদিন বড় কবি হবে।</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="color:black">’</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="color:black">পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের ইতিহাস দেখেছে দুজনের অন্ত চোখে দেখা দুজনের অবদানকে। একজন হয়ে উঠলেন বঙ্গবন্ধু, হয়ে উঠলেন বাংলার স্বাধীনতার স্থপতি। আরেকজন হলেন কবি, যাঁর কাব্যজীবনজুড়ে স্বদেশের ছবি। যে কবি তাঁর সর্বসাম্প্রতিক কবিতায় নিজেকে দেখতে চেয়েছেন মাটির প্রদীপ রূপে</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="color:black">—‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="color:black">বড় ইচ্ছা হয়, এইবার জীবনে/পৃষ্ঠাগুলি ফুল করে তুলি/গন্ধময়, সুরভিত;/ভালোবেসে ফোটাই সহস্র ফুল,/গন্ধরাজ, শিউলি বকুল/ভালোবাসা দিয়ে ভরে রাখি জীবনের দিনরাত্রিগুলি/আর কিছু নয়, এইটুকু সামান্য সঞ্চয়/এইটুকু সুখ/ভালোবাসা দিয়ে ভরে দিই মানুষের বুক,/হই তার একফোঁটা তৃষ্ণার জল,/শিশিরের টিপ;/ ভালোবেসে মানুষের ঘরে হই/মাটির প্রদীপ। (ইচ্ছে হয়) </span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="color:black">আশি বসন্তের পর </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="color:black">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="color:black">মাটির প্রদীপ</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="color:black">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="color:black"> হতে চাওয়া এই কবি এই জীবনে দেখেছেন অনেক কিছু। দেখেছেন বাংলাদেশের সৃষ্টি প্রক্রিয়া, দেখেছেন এই সৃষ্টি প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সবচেয়ে আলোকিত যে মানুষ তাঁর বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠা, দেখেছেন বাষট্টি, ছেষট্টি, উনসত্তর, একাত্তর, পঁচাত্তর, আশি-নব্বই। দেখেছেন মানুষের ফুঁসে ওঠা, দেখেছেন জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এ দেশের মাটিকে মুক্ত করার দৃপ্ত প্রয়াস, দেখেছেন স্বাধীন দেশে স্থপতির রক্তে রঞ্জিত হওয়া মানচিত্র, দেখেছেন জলপাই রঙের ভালোবাসা, দেখেছেন বুটের নিচে পিষ্ট হওয়া গণতান্ত্রিক অধিকার। মহাদেব সাহার কবি-হৃদয় কিংবা মানবতার চোখ এসবের কোনো কিছুই এড়ায়নি। প্রতিটি পর্ব উঠে এসেছে তাঁর কলমের কালিতে</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="color:black">—</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="color:black">কত দিন কোথাও ফোটে না ফুল, দেখি শুধু/অস্ত্রের উল্লাস/দেখি মার্চপাস্ট, লেফট রাইট, কুচকাওয়াজ/স্বর্ণচাঁপার বদলে দেখি মাথা উঁচু করে আছে হেলমেট/এখানে কারফিউ ঘেরা নিষিদ্ধ পূর্ণিমা (ফুল কই, শুধুই অস্ত্রের উল্লাস) </span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="color:black">কিংবা </span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="color:black">‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="color:black">আমি যখন মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি তখন পর্ণকুটিরে/জ্বলে ওঠে আলোকশিখা/শহীদ জননীর প্রাণ গর্বে ভরে ওঠে/তখন বাংলার সবুজ প্রান্তর শস্যে ভরে যায়, পদ্মায় চলে/ইলিশের ঝাঁক (আমি যখন মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি)</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="color:black">সময়কে তিনি এভাবে ধরেন চিরায়ত বাংলার আয়নায়। আমাদের ভৌগোলিক স্বাধীনতার কথা তিনি যেমন তুলে আনেন, তেমনি ভৌগোলিক স্বাধীনতার ভেতরে বিরাজমান পরাধীনতার কথাও তুলে আনেন। সেখানেও থাকে আমার বাংলার সঘন উপস্থিতি।</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="color:black">এরপর তো স্বাধীন দেশের স্থপতির রক্তে রঞ্জিত হওয়া মানচিত্র দেখতে হয় বাঙালি জাতিকে। তিনি তুলে আনেন সে চিত্রও। আর তা এমনভাবে আনেন, যা দৃশ্যায়িত কিন্তু দৃশ্যাতীত, যা বর্ণনাময় কিন্তু বর্ণনাতীত, যা অনুভূত কিন্তু অনুভবাতীত, যা কথিত কিন্তু অকথ্য, যা চাক্ষুষ কিন্তু দুঃস্বপ্নীয়</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="color:black">—‘</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="color:black">চারজন দেবদূত এসে ঘিরে আছে একটি কফিন/একজন বলল, দেখো ভেতরে রঙিন/রক্তমাখা জামা ছিল, হয়ে গেছে ফুল/চোখ দুটি মেঘে মেঘে ব্যথিত বকুল.../চারজন দেবদূত এসে ঘিরে আছে একটি কফিন/একজন বলল, দেখো ভেতরে নবীন/হাতের আঙুলগুলো আরক্ত করবী/রক্তমাখা বুকজুড়ে স্বদেশের ছবি</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="color:black">’</span></span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="color:black">। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশকে যে এভাবে তুলে আনা যায় কবিতায় কবি মহাদেব সাহা তা দেখিয়েছেন। এখানে প্রতিটি শব্দ সাধারণ; কিন্তু অসাধারণ এবং প্রতীকী। প্রতীকের ভেতরে আসল ছবি।</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="color:black">শুধু কি তাই? কয়েক প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের হৃদয়ের আকুলতাও উঠে আসে তাঁর কবিতায়। প্রেমকে তিনি কতভাবেই না চিত্রিত করেছেন। এখনো চিঠির কথা উঠলে তাঁর কবিতা ছাড়া আর কার কথা মানসচক্ষে ভেসে ওঠে তরুণ-তরুণীর? বিস্ময় বোঝাতে প্রেয়সীর চুলের উদাহরণের কথা কোন কালের কোন প্রেমিক ভুলতে পারবে? কবি মহাদেব সাহা এভাবে বাংলা কবিতায় রেখেছেন বহুমাত্রিক স্বতন্ত্র স্বাক্ষর।</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="color:black">তিনি কখনোই মস্তিষ্কের কবিতা লেখেননি। হৃদয়বৃত্ত ছিল তাঁর মূলমন্ত্র। এর ভেতরে ধৃত হয়ে আছে অনেক কিছু। এই অনেক কিছুর মধ্যে রয়েছে আমার স্বদেশ, আমার স্বাধীনতা, আমার মুক্তিযুদ্ধ, আমার মুক্তি, আমার বঙ্গবন্ধু, আমার অধিকার, আমার প্রেম, আমার আবেগ, আমার সাম্য, আমার স্বাধীনতা। একটু হৃদয় মেললেই বন্ধুত্ব  হয়ে যায় মহাদেব সাহার কবিতার সঙ্গে। তাঁর কবিতার শিল্পসুষমা এমনই।</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="color:black">এই সুষমায় সিক্ত হচ্ছি আমরা কয়েক দশক ধরে। সিক্ত চোখ নিয়ে জন্মে তিনি বোধ হয় জন্ম-মুহূর্তেই অঙ্গীকার করেছিলেন এই জনপদ ও হৃদয়পদের সূক্ষ তন্ত্রীতে তিনি দোলা দিতে থাকবেন। জন্মের পর একুশ দিন নবজাতকের কান্না থাকলেও জল থাকে না। কিন্তু তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। তাঁর জন্মদাত্রী লক্ষ করেছিলেন জন্মের পর তার চোখ জলসিক্ত। তাই বুঝি তিনি কবিতায় সিক্ত করে চলেছেন দশকের পর দশক।</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><span style="color:black">তিনি মাটির প্রদীপ হতে চান। তা তো হয়েছেনই। জন্ম-সিক্ত চোখের এই কবি একসময় ভেবেছিলেন এই জনপদের হৃদয়পদ্ম তিনি হরণ করবেন। কবি কি জানেন? অনেক আগেই তা করে ফেলেছেন তিনি!</span></span></span></span></span></p>