অঙ্কন :নাজমুল আলম মাসুম
অফিসে ঢোকার মুখেই লিফট থেকে নেমে ওসমান গণির সঙ্গে দেখা। ওসমান গণির চেহারা অনেকটা গোলগাল চায়নিজদের মতো, ছোট ছোট চোখ, মাথায় সোজা পাতলা চুল, মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, লম্বায় মাঝারি, মোটাসোটা শরীর। একটা আকাশি রঙের শার্টের সঙ্গে গলায় নেভি ব্লু রঙের টাই ঝুলিয়েছে গণি, শবনমকে দেখে হাসিমুখে বলল,
‘গুড মর্নিং শবনম আপা, ইউ আর লুকিং গ্রেট!’
করপোরেট নিয়মমাফিক গণিকে পাল্টা সম্ভাষণ জানাল শবনম। যদিও শবনম খুব ভালো করেই জানে গণি হারামজাদা হয়তো মনে মনে বলছে, ‘বুড়ির ঢং কত! এই বয়সেও কি সাজুগুজু কইরা অফিসে আসছে!’
এই মুহূর্তে অফিসে শবনমের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ওসমান গণি, প্রকিউরমেন্ট ডিপার্টমেন্টের হেড, তবে ম্যানেজমেন্টের ব্যাপক তোষামোদি করে সব কিছুতেই ওর চেয়ে এক ধাপ সামনে এগিয়ে আছে সে।
বিজ্ঞাপন
এই কম্পানির সিইও যিনি, টপ ম্যানেজমেন্টের খুব পছন্দের লোক নির্ঝর চৌধুরী সুন্দর চেহারার, স্মার্ট, পরিপাটি, হাসিখুশি দীর্ঘদেহী ভদ্রলোক। বহুদিন দেশের বাইরে ছিলেন, বড় বড় কম্পানিতে কাজ করেছেন। কিন্তু দিনশেষে তিনিও কি চাটুকারদেরই পছন্দ করেন না? শবনমের স্বাধীনচেতা দৃঢ় মনোভাব যে তাঁর তেমন পছন্দ নয়, সেটা উৎকটভাবে প্রকাশ না করলেও শবনম তাঁর অপছন্দের ব্যাপারটা নিজের সিক্সথ সেন্স দিয়ে ধরতে পারে। ফলে শবনমও তাঁর সঙ্গে একটা প্রয়োজনীয় পেশাদারি দূরত্ব বজায় রেখে নিজের নির্ধারিত কাজকর্মগুলো করে যায়।
নির্ঝর চৌধুরী সারাক্ষণই অফিস মিটিংগুলোতে বলতে থাকেন, কম্পানিতে গণতান্ত্রিক চর্চা চালু করতে হবে। টপ টু বটম সবার মতামতের মূল্য আছে। আমি সব বিষয়ে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নিতে পছন্দ করি। কিন্তু মুখে যা-ই বলুক, শবনমের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে তিনি আসলে চান, সবাই তাঁর সিদ্ধান্তকেই সমর্থন করুক। ওসমান গণিও এটা না বোঝার মতো বোকা নয়; আর সে কারণেই সব সময় সে আগ বাড়িয়ে বলতে শুরু করে, ‘অসাধারণ প্রস্তাব, স্যার। অতি উত্তম প্রস্তাব। আপনার মাথায় কিভাবে এত চমৎকার সব আইডিয়া আসে বুঝি না...’
নির্ঝর চৌধুরী মুচকি হেসে বলেন, ‘অভিজ্ঞতা, বুঝলে গণি, অভিজ্ঞতার মূল্য জ্ঞানের চেয়ে বেশি! কি বলেন শবনম?’
শবনমও মাথা নাড়ে। শুকনো গলায় বলে, ‘সে তো অবশ্যই!’
তার নিজের চাকরিজীবনও যে বাইশ বছর পেরোতে চলল সে কথা আর এই মজলিশে বলে কী হবে? এখানে টিকতে হলে নির্ঝর চৌধুরীর স্তাবকতা করতে হবে, মাথা দুলিয়ে বলতে হবে, ‘চমৎকার সে হতেই হবে, হুজুরের মতে অমত কার?’
অমত নেই। অমত হলে বা মতবিরোধ তৈরি হলেই তো সমস্যা। নিজের মত প্রতিষ্ঠা করতে গেলে বসের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটবে। শবনম নিজেকে বুঝিয়েছে, খামাখা বিরোধিতায় যাওয়ার দরকার নাই। এই মত যদি তোমার পছন্দ না হয় তাহলে স্রেফ চুপ করে থাকো, আর যদি দেখো তোমার মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে তখন মত প্রকাশ করো।
এই অফিসগুলো তো অফিস নয়, যেন ইঁদুরদৌড়ের মাঠ। এখানে সবাই দৌড়ায় ওপরে ওঠার জন্য আর কর্তৃপক্ষের সুনজরে পড়ার জন্য। শবনমের পুরনো কলিগ বিল্লাহ ভাইয়ের কথা মনে পড়ে, ‘বুঝলেন শবনম, বসদের সব সময় দেখাবেন আপনি খুবই ব্যস্ত, সারাক্ষণই তাদের সামনে ফাইলপত্র হাতে অযথাই ছোটাছুটি করবেন, উঠতে-বসতে সালাম দেবেন, শুধু মাথা নিচু করে কাজ করলে হবে না, কাজ দেখাতে হবে, নইলে নেপোয় খাবে দই আর আপনি আফসোস করে মরবেন...’
শবনম ইন্টারকমে ফোন করে অ্যাকাউন্টসের নতুন ছেলেটাকে ডেকে পাঠায়। সেদিন খুব কড়া ডোজ দিয়ে ফেলেছে, আজকে একটু মলম লাগিয়ে দিতে হবে, যাতে ক্ষতটা স্থায়ী না হয়। সহকর্মীদের মনের অবস্থাটা খেয়াল রাখাও একজন ভালো বসের দায়িত্ব।
‘এসো মনিরুজ্জামান, বসো। এই অফিসে কত দিন হলো জয়েন করেছ? এটাই প্রথম চাকরি?’
‘নয় মাস ম্যাডাম। জি, এটাই প্রথম ফুলটাইম জব। ’
শবনম তার সামনে বসে থাকা মনিরুজ্জামানকে ভালো করে লক্ষ করে। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যাম, মাথায় ঘন কালো কোঁকড়া চুল, ক্লিন শেভড চেহারায় এখনো গ্রামীণ তারুণ্য ও সারল্যের ছাপ পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি। শবনম ছেলেটির দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসল, তাকে চা অফার করল, তারপর জানতে চাইল, ‘তোমার জীবনে তুমি কত দূর যেতে চাও, মনিরুজ্জামান?’
মনির কিছুক্ষণ ইতস্তত করে তারপর বলে, ‘এইতো, সবাই যেমন শীর্ষে যেতে চায় ম্যাডাম, তেমন...’
‘ভেরি গুড। বড় স্বপ্ন দেখতে হবে, বড় আশা করতে হবে। আর পজিটিভ থিংকিং প্র্যাকটিস করবে। গ্লাস অর্ধেক ভর্তি দেখা শিখবে, অর্ধেক খালি দেখা না, ঠিক আছে? মনোছবি বোঝো? মনে মনে নিজেকে কোথায় দেখতে চাও তার একটা ছবি তৈরি করবে, প্রতিদিন, তারপর সেই অনুযায়ী কাজ করে যাবে। মানুষের মধ্যে ভালোটা খুঁজে বের করে সেটার প্রশংসা করবে, প্রশংসা করতে না পারলে চুপ থাকবে, সেটাও ভালো। এগুলো প্র্যাকটিস। কয়েক দিন চর্চা করো, দেখবে অভ্যাস হয়ে যাবে। বেশির ভাগ সময় নেতিবাচক চিন্তা মানুষকে পিছিয়ে দেয়, এটা মনে রেখো। ’
‘ম্যাডাম, আমি আপনাকে অনেক পছন্দ করি, আসলে সেদিন...’
মনিরুজ্জামান হড়বড় করে বলতে শুরু করলে শবনম ডান হাতটা সামান্য উঁচু করে তাকে থামিয়ে দেয়। এর চেয়ে বেশি বাড়তে দেওয়া যাবে না।
‘ঠিক আছে, মনিরুজ্জামান। উইশ ইউ অল দা বেস্ট, মনোযোগ দিয়ে কাজ করো, কেমন!’
মনিরুজ্জামানের চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে নিজের তরুণ বয়সের কথা মনে পড়ে শবনমের, একেবারে সেলফ মেড মানুষ সে, বাবা-চাচা-মামার জোর ছাড়া যেমন হয়, সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার, স্রেফ নিজের সাহস আর আত্মবিশ্বাসে ভর করে এগিয়ে যাওয়া তার, ইমতিয়াজের সঙ্গে জেদ করে নেদারল্যান্ডসে এক বছরের মাস্টার্স কোর্সটা না করলে অবশ্য এ জায়গায় আসা সম্ভব হতো কি না কে জানে, বিদেশি ডিগ্রিটা চাকরিজীবনে তাকে অনেক পয়েন্টে এগিয়ে রেখেছে। সবাই জানত, ইমতিয়াজ আর শবনম একসঙ্গেই বাইরে পড়তে যাবে। ডিপার্টমেন্টে সব সময় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট ইমতিয়াজ, শবনম কখনো সেকেন্ড, কখনো থার্ড। তাতে অবশ্য আফসোস ছিল না শবনমের, ইমতিয়াজ তো তারই। ফলে ইমতিয়াজের সাফল্য মনে হতো শবনমের নিজেরই সাফল্য। কিন্তু ইমতিয়াজ যখন ফুল স্কলারশিপে হার্ভার্ডে পড়ার চান্স পেয়ে গেল, তখন থেকেই কেমন যেন বদলে যেতে শুরু করল। এই বদলানোগুলো মুখে বলে ঠিক বোঝানো যায় না, কিন্তু কাছের মানুষরা ঠিকই তা অনুভব করতে পারে। তারা বোঝে কোথায় তাল কেটে গেছে, ছন্দঃপতন হয়েছে, কী যেন আর মিলছে না। তারা কেউ কাউকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় বলেনি, আবার নিজের একান্ত জীবনে স্বাগতও জানায়নি। কিভাবে যেন দুজনেই বুঝে গেছে, দুজনের দুটি পথ এক হয়ে মিশে যাওয়ার কোনো সুযোগ আর নেই। অভিযোগ, অনুযোগ, অভিমানের চেয়ে শবনমের গায়ে বেশি লেগেছিল অপমানটুকু। পরাজয় আর প্রত্যাখ্যানের অপমান। নেদারল্যান্ডসের ঠাণ্ডা শীতল বরফ জমা সেই নিঃসঙ্গ নির্বান্ধব লেইডেন শহরে দীর্ঘ এগারো মাস অপমানটা বুকের মধ্যে পুষে রেখে শক্ত পাথর বিছানো পথে রক্তাক্ত পায়ে আর মনে হেঁটে, দাঁতে দাঁত চেপে ডিগ্রিটা নিয়ে দেশে ফিরে অল্প কয়েক দিনের পরিচয়ে তারেককে বিয়ে করে ফেলেছিল শবনম।
তারেকের তেমন বিদ্যা নেই, বিদ্যার অহংকারও নেই। অদ্ভুত এক সরল জীবনযাপনের স্বপ্ন দেখে দেখেই সে কাটিয়ে দিয়েছে শবনমের সঙ্গে এতগুলো বছর। যেন সঙ্গে থেকেও নেই, পাশে থেকেও দূরে কোথাও, নিজের মধ্যে নিমগ্ন, নির্লিপ্ত ধ্যানী বুদ্ধ। এতে একদিকে ভালোই হয়েছে, নিজের পেশাগত জীবন নিজের ইচ্ছামতো গুছিয়ে নিতে পেরেছে শবনম। প্রেম ছিল, তবে সেটা শুধু নিজের কাজের সঙ্গে নিজের। কোথাও আর কোনো দিকে তাকায়নি সে, তাকাতে ইচ্ছাও করেনি। ওই দরজা চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছে শবনম। অন্তত প্রেম নিয়ে আর কোনো পুরুষের কাছে গিয়ে কাঁদুনি গাওয়ার ইচ্ছা নাই তার। পুরুষ অনেক সময় নারীর কান্নার অর্থ ঠিকমতো বুঝতেও পারে না। নিজের মনের মতো ভুল অর্থ করে।
দুই.
এক বাড়িতে থেকেও শ্রাবণের সঙ্গে শবনমের দেখা হলো চার দিন পর। বাড়ির ভেতরেই আরশিনগর তৈরি হয়ে গেছে যেন, মেয়ে পড়শির মতোই বলল, ‘হাই মা, তুমি এখনো বাসায়? অফিসে যাও নাই? আজকে তোমার কোনো জরুরি মিটিং নাই বুঝি?’
শবনম মেয়ের প্রশ্নের অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে পারলেও গলায় একটু স্নেহ মিশিয়ে হাসিমুখে বলে,
‘মিটিং বিকেলে, তাই একটু দেরিতে যাচ্ছি, ফিরতে দেরি হবে, তুই?’
‘আমি একটা ফ্রেন্ডের বাসায় যাব, পল্টনে...’
‘চল, তোকে নামিয়ে দিয়ে যাই। ’
‘উহু, দরকার নাই, আমি ঠিকই রিকশা নিয়ে চলে যেতে পারব। ’
শ্রাবণ তার একরাশ লম্বা কালো চুল রাবার ব্যান্ড দিয়ে আটকে নিয়ে বলে।
‘সে তো পারবিই, তোর সঙ্গে একটু গল্প করতে করতে গেলাম না হয়, তুইও যা ব্যস্ত হয়ে গেছিস, আজকাল দেখাই হয় না তোর সঙ্গে...’
অনিচ্ছায়ও নাক কুঁচকে মায়ের সঙ্গে যেতে রাজি হয় শ্রাবণ। ছোটবেলায় পুতুলের মতো তুলতুলে যে মেয়েটা মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে জানতে চাইত, সব বন্ধুর মায়েরা স্কুলের সামনে বসে থাকে, ওর মা কেন থাকে না? যে মিষ্টি নরম মেয়েটা ঠোঁট ফুলিয়ে ছলছল চোখে প্রায় সকালেই মায়ের শাড়ির আঁচল ধরে আবদার করত, ‘আজ অফিসে যেয়ো না, মা। ’ সেই কোমল চঞ্চল শিশুটিকে আজকের শ্রাবণের মধ্যে খুঁজতে থাকে শবনম। ঠোঁটের কাছের সেই আহ্লাদী ভাবটা, চোখের তারার সেই বাদামি ঝিলিক, ছোট্ট লক্ষ্মীমন্ত কপাল—সব একই আছে, শুধু সেই শ্রাবণ বেবি আর শিশু নেই, বড় এক তরুণী হয়ে গেছে। আমার সন্তান আর আমার নেই, তার এখন নিজস্ব ভাবনা আছে, তার আছে ভবিষ্যতের দিকে ছুটে যাওয়ার তাড়া। সে স্বাধীনচেতা, নিজস্ব তার মন ও মনন। তার একান্ত স্বপ্নে নেই অন্যের—এমনকি তার মা-বাবারও প্রবেশের অধিকার।
গাড়িতে চড়েই কানের মধ্যে হেডফোন গুঁজে দেয় শ্রাবণ, চোখ বন্ধ করে মাথা দুলিয়ে কী যেন শোনে। শবনম মেয়ের কাঁধে হাত দিয়ে ডাকে, ‘কী শুনিস?’
‘কী আবার? গান। শুনবা? দাঁড়াও...’ শ্রাবণ হেডফোনের একটা প্রান্ত শবনমের কানে গুঁজে দেয়। পিংক ফ্লয়েডের ‘সো ইউ থিংক ইউ ক্যান টেল, হেভেন ফ্রম হেল’ বাজতে থাকে।
শবনমের অনভ্যস্ত কানে মেয়ের পছন্দের হাইবিটের ইংরেজি সংগীত পীড়নের মতোই শোনায়। তবু মেয়ের মন রাখতে ঘাড় কাত করে কানের মধ্যে হেডফোনের বাটন লাগিয়ে শ্রাবণের পছন্দের কয়েকটা গান চোখ বুজে শোনে সে। শেষমেশ আর না পেরে বলে,
‘পরে আবার শুনব, নে রে মা, আমার কানে তোদের এসব গানের চেয়ে এখনো রবীন্দ্রসংগীত বা হারানো দিনের গান ভালো লাগে। ’
‘জেনারেশন গ্যাপ, মা। ’
শ্রাবণ একটু হেসে বলে, ‘তবে ওদের গানের লিরিকসগুলো খুব সুন্দর, ফিলোসফিক্যাল, একটু মনোযোগ দিয়ে শুনলে বুঝবা...’
শ্রাবণ আবার নিজের কানে হেডফোন গুঁজে নেয়। শবনম মেয়ের সঙ্গে গল্প করার জন্য বিষয় হাতড়ায়। কোন প্রসঙ্গে কথা বললে শ্রাবণ ঝরনার মতো কলকল করে কথা বলবে ভেবে পায় না সে। কিছুদিন আগেও তাদের প্রসঙ্গের অভাব ছিল না। স্কুলের কোন টিচার কিভাবে কথা বলে, কোন সাবজেক্ট পড়তে অসহ্য লাগে, কোনটা পানির মতো সোজা, কোন বান্ধবীর বয়ফ্রেন্ড হুমকি দিয়েছে তাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার, কোন বান্ধবী বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছে—এমন হাজার বিষয়ে অবিরাম কথা বলত শ্রাবণ। বরং শবনমই সেসব কথার অর্ধেক শুনত, অর্ধেক শুনত না। এখন হয়েছে উল্টোটা, শবনমের মনে হয় তার কোনো কথাই হয়তো ঠিকমতো শোনে না শ্রাবণ। বেশি কিছু বললে বিরক্ত হয় বা চুপ করে থাকে।
কী নিয়ে কথা শুরু করা যায়, ফেমিনিজম? ক্যারিয়ার? ওয়ার্ল্ড পলিটিকস? মার্ক্সবাদ? কোনটা এই মুহূর্তে ওর পছন্দের বিষয়? আমার মা কি আমার সঙ্গে কথা বলার সময় এই সমস্যায় পড়ত, ভাবতে চেষ্টা করে শবনম। মায়ের সঙ্গে অনেক বিষয়েই মতের অমিল ছিল। মায়ের বিচারবুদ্ধি আর অভিজ্ঞতার সঙ্গে শবনমের চিন্তা-ভাবনার বিরোধ লেগেই থাকত, কিন্তু সেই কারণে স্বাভাবিক কথাবার্তা চালাতে কখনো অসুবিধায় পড়তে হয়নি। শ্রাবণ হয়েছে কিছুটা গভীর আর চাপা স্বভাবের, ওর মনের তল খুঁজে পেতে তাই প্রায়ই হাবুডুবু খায় শবনম।
‘আচ্ছা মা, আজকে সারা দিন তুমি অফিসে কী কাজ করবা?’
শ্রাবণ হঠাৎ কান থেকে হেডফোন খুলে একটু ঘুরে বসে মায়ের মুখোমুখি হয়ে জিজ্ঞেস করে।
‘প্রতিদিন যা করি, মিটিং, ফাইল দেখা, সিদ্ধান্ত দেওয়া, জুনিয়রদের কাজের তদারকি করা—এসব... তুই কী করবি?’ পাল্টা জানতে চায় শবনম।
‘এইতো মিরাকে নিয়ে একটু ঘুরতে বের হব, ও খুব আপসেট। জানো, আংকেল-আন্টি ওকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে, কিন্তু ও এখন বিয়ে করতে চায় না। ’
‘কেন রে, ওর পছন্দের কেউ আছে?’
‘মা, সেই জন্য না। মিরা আসলে এখনই বিয়ে করার জন্য রেডি না। অন্তত পড়াশোনাটা তো কমপ্লিট করবে। থ্যাংকস গড, তোমরা এখনো আমার বিয়েটিয়ে নিয়ে ভাবো না। শুধু দাদিই মাঝে মাঝে বিয়ের কথা বলে। ’
দাদির গলা নকল করে শ্রাবণ বলে, ‘নাতিনজামাই দেখতাম চাই, কয়দিন বাঁচি জানি না। তুই তাড়াতাড়ি ভালো দেইখ্যা একটা বিয়া বস। ’
‘তোর পছন্দের কেউ আছে নাকি? ছেলেবন্ধু?’ শবনম মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করেই ফেলে।
‘ছেলেবন্ধু আছে, কিন্তু স্পেশাল কেউ নাই, মা। কাউকে পছন্দ হয় না, মনে হয় হবেও না, চিন্তা-ভাবনা, রুচি-বিশ্বাস-আদর্শ কিচ্ছুতে মেলে না। কেমন সব বলদ বলদ লাগে সবগুলিকে। আর ওরা এমন সব বিষয় নিয়ে তর্ক করে, যা নিয়ে আমার কথা বলতেও ইচ্ছা করে না। উফ, খুব ইমম্যাচিওর মনে হয়! আমি বাপু বিয়েটিয়ে করব না। ঠিক করে ফেলেছি, নিজের মতো স্বাধীন জীবন যাপন করব, দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াব, বুড়ো হলে একটা ওল্ডহোমে চলে যাব। কেমন হবে বলো!’
শ্রাবণ তার স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্য ভেঙে একটানা নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা বলে। শবনম মেয়ের কথায় সায় দিয়ে বলে, ‘ভালোই তো! বেশ রোমান্টিক, প্রথাবিরোধী জীবন। মনমানসিকতায় মিল না হলে কোনো সম্পর্কে না জড়ানোই ভালো। বিয়ে করতেই হবে, কে বলেছে...’
শ্রাবণ হেসে বলে, ‘অরুন্ধতী রায়ের মা নাকি তাঁর মেয়েকে বলেছিলেন, আর যা-ই করো না কেন, কখনো বিয়ে কোরো না। হা হা হা, তুমিও সেই পথ ধরলা নাকি?’
শবনমও মেয়ের সঙ্গে হাসে, বলে, ‘আমি অতটা শক্ত করে কিছু বলছি না যে বিয়ে কোরোই না, আমি বলতে চাচ্ছি মন-পছন্দ মানুষ না পেলে খামাখা বিয়ের দরকার কি? একটা অসুস্থ সম্পর্ক বয়ে বেড়ানোর মানে নেই। তবে পরে যদি এমন কাউকে খুঁজে পাস, যাকে খুব ভালো লেগে গেল, তাহলে বিয়ে করতেও তো পারিস। আমি সেটাই বলছি। ’
‘ও। ’
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। শ্রাবণ একটু ভেবে বলে, ‘আচ্ছা মা, বিয়ে না করলে তো বাংলাদেশে আবার বাচ্চা নেওয়া যায় না, কিন্তু আমার আবার বাচ্চা খুব ভালো লাগে। আচ্ছা, দত্তক নিয়ে বাচ্চা পালা যাবে না? বাংলাদেশে তো অনেক বাচ্চারই মা-বাবা থাকে না, সে রকম কাউকে দত্তক নিয়ে নেব...’
সামনের গাড়িটা হঠাৎ ব্রেক কষলে শবনমের গাড়িটাও একটা ঝাঁকুনি খায়, শ্রাবণের কথা শুনে মনে মনে সে রকম একটা ঝাঁকুনি অনুভব করে শবনম। বাংলাদেশের বাস্তবতায় অবিবাহিত একজন নারীর দত্তক সন্তান পালন সমাজ কিভাবে দেখবে, তা ভাবার চেষ্টা করে সে। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘তুই সিরিয়াসলি এ রকম ভাবছিস নাকি?’
‘হ্যাঁ, ইন্ডিয়ান অ্যাক্ট্রেস সুস্মিতা সেনের মতো সিঙ্গল মাদার হব। ’
শ্রাবণ মিষ্টি করে হাসে। ‘বায়োলজিক্যাল মা হওয়া অনেক ঝক্কি। কিভাবে যে তুমি আমাকে জন্ম দিছ কে জানে? আমি তো আমার ইউটেরাসটাই ফেলে দিতে চাই, খামাখা শরীরে একটা বাড়তি অঙ্গ রাখার কী দরকার? মাসে মাসে ঝামেলা, ব্যথা, অস্বস্তি আর কষ্ট সহ্য করা। আর আমি যখন বাচ্চা জন্ম দেব না বলেই ঠিক করেছি...আর এই বাজে নষ্ট পৃথিবীতে একটা বাচ্চাকে কেন আনব আমি? কী দরকার?’
শবনম বুঝতে পারে না, শ্রাবণ কি ওকে ঘাবড়ে দিতে চাইছে? মাকে অদ্ভুত সব কথা শুনিয়ে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়ে মজা পাচ্ছে? ও তো আর এখন বাচ্চা মেয়ে নয়, একুশ বছরের একটা তরুণীর মুখে এসব কী ধরনের কথা? শবনম যেন নিজের একমাত্র সন্তানকে পুরোপুরি চিনতে পারছে না। কেমন একটা অস্বস্তি হয়।
‘মা, ভয় পাচ্ছ নাকি?’ শ্রাবণের মুখে দুষ্ট হাসি। রাস্তায় এখন আর জ্যাম নেই। গাড়ি পৌঁছে গেছে পল্টনের কাছাকাছি। শবনম মুখে হাসি ধরে রেখে বলে, ‘নাহ, তুই ভয় দেখাতে চাইলেই আমি ভয় পাব নাকি?’
শ্রাবণ বলে, ‘তাইলে সার্জারির পারমিশন দিয়ে দিয়েছ? যেকোনো দিন করিয়ে ফেলব...’
‘কিন্তু শ্রাবণ, আরো পরে, কখনো তো তোর বায়োলজিক্যালি মা হওয়ার ইচ্ছাও জাগতে পারে। মনে হতে পারে, পৃথিবীর কোটি কোটি নারী যে অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেছে সেই অভিজ্ঞতাটা নিজেও নেই। ইউটেরাস ফেলে দিলে তো সেই অপশনটা থাকে না। ’
গাড়ি মিরাদের বাড়ির গলির সামনে পৌঁছে গেছে। গাড়ি থেকে নামতে নামতে শ্রাবণ বলে,
‘ইচ্ছা হবে না। ’
‘যদি তোর বরের ইচ্ছা হয়?’
‘বিয়েই তো করব না...আগেই বলেছি। আর আমার শরীর, সিদ্ধান্ত আমার...’ শ্রাবণ চিৎকার করে বলে। তারপর শবনমের উদ্দেশে ডান হাত নাড়িয়ে গলির ভেতর হনহন করে হাঁটতে থাকে, একবারও পেছনে ফিরে তাকায় না।