অঙ্কন : সারা টিউন
‘চিন্তা মনে কর! চিন্তা মনে কর আবার কখনো মানুষের নাম হয় নাকি?’
‘মনে না, মণি। মনে কর না, মণি কর। মানুষটার নাম চিন্তামণি কর। ’
‘ওই একই।
বিজ্ঞাপন
‘তা কেন শুনবি। এই নামে খুবই বিখ্যাত একজন ভাস্কর ছিলেন পশ্চিমবঙ্গে। ’
‘বইও লিখছেন। মডেলের সন্ধানে। বিখ্যাত বই। ’
‘হে-হে-হে!’
‘হে-হে-হে!’
‘আমরা কি ভাস্কর চিন্তামণি করের কাছে যাইতেছি? আমরা যাইতেছি এক বাটপাড় চিন্তামণি করের কাছে। সে মনে করে, সে কিছু তুকতাক পারে। তুই এসব বিশ্বাস করিস?’
‘বিশ্বাস করি! আমি সব বিশ্বাস করি। ’
‘তুই একটা পাল্ফ ফিকশন। ’
‘হে-হে-হে। ’
‘হে-হে-হে। ’
দেশে কিছু গ্রাম আছে এখনো, সন্ধ্যা নামে সেই আদিমকালের মতো, জোছনা হয় সেই আদিমকালের মতো। শীতকালের সন্ধ্যা, জোছনা এবং কুয়াশা—তুমুল নেমেছে। রেললাইনের ধারে ফকির উলি শার মাজার। তিতিরমুখির মানুষজন বলে, বড় ফকির উলি শা। এই গ্রামটার নাম তিতিরমুখি। লোকাল ট্রেনে করে দুপুরে তারা এই হরিৎ জনপদে উপস্থিত হয়েছে। শাদাব আর অভি। তারা বন্ধু। পুরান ঢাকার পুরনো এক বোর্ডিং হাউসে থাকে অভি। ফকিরাপুলের এক মেসে থাকে শাদাব। তারা কবি। লিটল ম্যাগ করে এবং বড় কোনো পত্রিকায় লেখে না। অভি কুষ্টিয়ার সন্তান। নেত্রকোনার সাতপাইয়ে তার একমাত্র পিসির বিয়ে হয়েছে। সেই জবা পিসির অত্যাচারমূলক আদরযত্নের মধ্যে তারা সাতপাইয়ে আছে তিন দিন ধরে। সকালে নেত্রকোনা রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে উঠেছে কোথাও যাবে বলে নয়, এমনি। লোকাল ট্রেন। সব স্টেশন ধরে। অভি যখন বলল, ‘এই স্টেশনটা তিতিরমুখি। ’ শাদাব বলল, ‘কী? নেমে পড়ি চল। ’
‘কী?’
‘গ্রামবাংলা একটু দেখেশুনে যাই। ’
সেই তারা নেমে পড়েছে তিতিরমুখিতে। ফকির উলি শার মাজারে সাধুসঙ্গ করেছে এবং বিশিষ্ট কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। মাওলা ভাই, আলী ফরিদ ভাই, জমানত ভাই, সত্যশিব দাদা। তাঁরা ডাইরেক্ট মুরিদ ফকির উলি শার। আড়াই-তিন শ বছর আগের ফকির উলি শা নিজে তাঁদের মুরিদ করে নিয়েছেন খোয়াবে। জমানত ভাই থাকেন মাজারে, মাওলা ভাই, আলী ফরিদ ভাই আর সত্যশিব দাদা তিতিরমুখি নিবাসী। ফকির উলি শার আধ্যাত্মিক পাওয়ার নিয়ে নানা রকম কথা আছে তল্লাটে। পৃথিবীর সব উলি ফকির উলি শার কথায় চলে। উলি মানে উই। উইপোকা। মাওলা ভাই আফসোসসহকারে চিন্তার কথা বললেন, ‘চিন্তা করে দেখা দিছিলেন ফকির। খোয়াবে না, ভর হাইনজায়। কিছু পাওয়ারও দিয়া গেছেন। সেই পাওয়ার দিয়া চিন্তা মাইনসের অনিষ্ট করে দিনরাইত। ফকির একদিন তাঁর উলিদের কিছু বলবেন। ’
অভির নাম অভি। তার বাবার নাম অভি। দাদা ঠাকুরের নামও অভি। যথাক্রমে অভিজিৎ, অভিমন্যু ও অভিরাম। ঠাট্টা করে অভি বলে প্রায়ই, তার একটা মেয়ে হবে; এবং মেয়ের নামও অভি রাখবে সে। অভিমানিনী। এখন বলল, ‘ফকির উলি শা কী বলবেন তাঁর উলিদের? মাওলা ভাই?’
মাওলা ভাই উদাস গলায় বললেন, ‘সেইটা ফকিরের বোঝাপড়া। ’
এই সময় ট্রেন গেল অল্প দূরের পাহাড়ের দিকে। হাওয়ায় রেললাইনের ঢালের লম্বা ঘাস দুলল। মাজারে ঢুকে আবার বের হয়ে গেল। মুরিদগণ জপ করলেন, ‘ফকির। ফকির। ’
তারা উঠল। অল্পক্ষণে আপন কজন মানুষ শোকার্ত হলেন দুই কবির জন্য। অভি-শাদাব বলল, তারা আবার আসবে। মাওলা ভাই বললেন, ‘ফকির! ফকির!’
রেললাইনে উঠে শাদাব বলল, ‘মাওলা ভাই কী বললেন কিছু বুঝলাম না। চিন্তা কে?’
অভি শাদাবকে চিন্তা-তথ্য দিল। দম দিতে দিতে জমানত ভাই তাকে বলেছেন, ‘দিকযানের মানুষ চিন্তা। কামরূপ কামাখ্যায় গিয়া এগারো বছর তন্ত্র সাধনা করে ফিরছে। তিতিরমুখির বয়স্কতম ব্যক্তি অনাদি পটুয়া। এক শ দশ বছর বয়স। তারে বিশ্বাস করে চিন্তা বলছিল, এগারো বছরের মধ্যে ছয় বছর তিন মাস সে ছিল এক শাঁকিনির সঙ্গে। ’
‘শাঁকিনি! শাঁকিনি কী?’ শাদাব বলল।
অভি বলল, ‘না মানুষ, না ভূতপ্রেত, না এলিয়েন। মায়াবিনী এরা। ’
‘অ। তার নাম চিন্তা! শুধু চিন্তা?’ শাদাব বলল।
অভি বলল, ‘চিন্তামণি কর। ’
অতঃপর শাদাব বলল, ‘চিন্তা মনে কর—’ ইত্যাদি।
রেললাইন ধরে তারা হাঁটছে। জোছনা ও কুয়াশা পার হয়ে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, তারা দিকযানে যাবে। চিন্তামণি করের সঙ্গে দেখা করবে এবং কথা বলে ফিরবে, যত রাত হোক। দিকযান দুই তালগাছ পরের গ্রাম না। টিলাগড় যেতে হবে আগে ট্রেন ধরে। টিলাগড় শালিক নদীর পারে অবস্থিত গঞ্জ। শালিক পার হয়ে হেঁটে দিকযান। যত রাত হোক, কথার কথা, তাদের আসলে ফেরার তাড়া নাই কিছু। বা কোথাও। জবা পিসির অত্যাচার থেকে বাঁচতে তারা জবা পিসিকে বলেছে বিরিশিরি যাচ্ছে। দুই রাত থাকবে। তিতিরমুখির পরের স্টেশন আরো চার-সাড়ে চার কিলোমিটার। ব্যাপার না, রেললাইন ধরে হেঁটে তারা চলে যেতে পারবে। হাঁটছে।
‘এই বছর শীত তেমন পড়ে নাই। ’ অভি বলল।
ফকির উলি শার মাজারের জিনিস বেজায় ধরেছে। শাদাবের মনে হলো পাঁচ হাজার বছর আগের অভি কথাটা বলল। আরো পাঁচ হাজার বছর পর সে নিজে বলল, ‘কোন বছর পড়ে?’
অভি বলল, ‘তা ঠিক। তোর জন্মের আগে পড়ছিল একবার, তোর বাপের জন্মের আগে পড়ছিল একবার। তোর দাদার জন্মের আগে পড়ছিল একবার। ’
শাদাব হাসল, ‘হে-হে-হে। ’
অভি বলল, ‘শীত কিন্তু শালা মহা হারামি। পড়েও ওঠেও। আকাশ থেকে পড়ে, মাটি থেকে ওঠে। হে-হে-হে!’
শাদাবও আবার হাসতে নিচ্ছিল, এই সময় তার মোবাইল ফোন বাজল। এতক্ষণে এই বিটকেলে যন্ত্রটার অস্তিত্ব সম্পর্কে আবার চেতন হলো তারা দুই কবি। এতক্ষণ মনেই ছিল না। সারা দিনে তারা কাউকে কল দেয়নি, কেউ তাদের কল দেয়নি। তার মোবাইল ফোন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে রেখেছে অভি। সঙ্গে থাকে, কিন্তু বন্ধ। কারণ আছে। ব্যক্তিগত। টাচফোন না, সাবেকি বাটন ফোন, পকেট থেকে বের করে শাদাব ধরল। হ্যালো না বলে গান ধরল, ‘কে বিদেশি। মন উদাসী। বাঁশের বাঁশি। বাজাও বনে... জি?... জি-জি-জি!... জি, আব্বা। জি, স্যরি। ... জি... বুঝতে পারি নাই... আমি মনে করছিলাম আন্না... জি, আন্না কারেনিনা আব্বা। মহান রুশ কথাসাহিত্যিক লেভ তলস্তয়ের মহান উপন্যাস। সিনেমা হইছে। আপনি তো মনে হয় গ্রেনুভিলে থাকতেই দেখেছেন। ... জি, আব্বা... জি, আমি নাখালপাড়ায়। ... জি, ফিরব না। ... না, জিকোদের বাসায় থাকব... কথা বলবেন?... আমি এখনো... হ্যালো?... হ্যালো?... হ্যালো!... হ্যালো-ও! আপনি কি আমার কথা শুনতে পান, আব্বা? আমি কিছুই শুনতে পাই না। হ্যালো! হ্যালো! হ্যালো আব্বা!’
ফোনের লাইন কেটে দিল শাদাব, ফোন অফ করে দিল এবং হাসল, ‘হে-হে-হে। ’
সমর্থন করে হাসল অভিও, ‘হে-হে-হে। ’
এত কেন তারা হাসছে? সাধুসঙ্গের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
এত কুয়াশা, তবু তেমন শীত নাই। তারা অবশ্য যথেষ্ট পরিমাণ শীতের কাপড়চোপড় পরে আছে। অভি চাদর মুড়িয়ে মাথা ঢেকেছে, শাদাব হুডির হুড উঠিয়ে দিয়েছে। কিছুদূর থাকতে তারা দেখল, রেললাইনে আরেকজন মানুষ। উল্টো দিক থেকে আসছে। লুঙ্গি চাদর মাফলার পরে আছে ছোটখাটো সাইজের মানুষটা। বিড়ি ফুঁকছে। নিকটবর্তী হয়ে দাঁড়াল, ‘কারা গো কুটুম? কোন গিরামের?’
অভি বলল, ‘আমরা দাদা নেত্রকোনা থেকে আসছি। ’
‘নেত্রকোনা টাউনে থাকেন? কোন পাড়া গো?’
অভি সংক্ষেপে বলল, ‘সাতপাই। ’
‘সাতপাই। অ। আমি একবার আটপাই গেছি। ’
অভি বলল, ‘আটপাই! আমাদের পাড়ার নাম নয়পাই দাদা। ’
‘দশপাই? অ, ছয়পাই...। ’
গোত্রের জিনিস, না উন্মাদ?
শাদাব বলল, ‘দাদা কি কল্কি মার্কা?’
আকলমান্দ দাদা বুঝল। তুরীয় হাসি দিল। তার বিড়ি শেষ হয়ে গেছে। ফিল্টারঅলা বিড়ি। কুয়াশায় ফিল্টার ওড়াল, রেললাইনে পড়ল।
শাদাবের ব্র্যান্ড মার্লবোরো রেড। আমেরিকান। কেনে, উপহার পায়। তার এক সোহানী খালা আছেন, কিছুদিন আগে ফকিরাপুল মেসে তিন কার্টন মার্লবোরো রেড পাঠিয়ে দিয়েছেন। সেই একটা প্যাকেট তার পকেটে এখন। বের করে সে অফার করল দাদাকে। দাদা অফার গ্রহণ করল এবং দুই টান দিয়ে বলল, ‘ফাসক্লাস টেস্। বিদেশি সিকারেট?’
শাদাব বলল, ‘জি। ’
‘ফাসক্লাস! ফাসক্লাস! আপনেরা কই দিক দিছেন কুটুম?’
শাদাব কথাটা ধরতে পারল না। অভি বলল, ‘দিকযান দাদা। দিকযান যাব। ’
‘দিকযানে! কার ঘরে গো?’
‘চিন্তারাম কর...ইয়ে চিন্তামণি কর। ’
‘চিন্তামণি কর? ক্যান গো কুটুম? তার কাছে কী দরকার আপনেরার? তুকতাক করাইবেন? বশীকরণ?’
‘আপনি তারে চিনেন?’
‘নাড়িসুদ্ধা চিনি গো, কুটুম। তার কাছে কী দরকার বলেন?’
‘কোনো দরকার নাই, দাদা। আমরা এমনি তারে দেখতে যাইতেছি। ’
‘দেখা হয় নাই?’
‘জি!’
‘তারে কী করে দেখবেন কুটুম! সে কি আর আছে? ফকির উলি শার উলি তারে কোনদিন খাইছে!’
‘উলি খাইছে?’
‘ক্যান কুটুম, এই খবর তো পেপারে উঠছিল। দৈনিক ভাটির ডাক পেপারে। মিত্যুর পর হাজারে-বিজারে উলি বডি খেয়ে ফেলছে চিন্তামণি করের। তার ভাই, ভাইয়ের বউ আর তারার পোলাপাইনে দেখছে। ভাইয়ের ছেলে পরে চিন্তামণি করের হাড়-হাড্ডির মুখাগ্নি করছে। ’
‘অ। চিন্তামণি করের ছেলে-মেয়ে নাই?’
‘না, সংসার করে নাই সে। ’
অভি বলল, ‘চিন্তামণি কর সম্পর্কে দেখি বহু কিছু জানেন আপনি, দাদা। আপনি কি দিকযানের মানুষ?’
‘হ কুটুম। আমি দিকযানের চিন্তামণি কর। ’
‘কী!?!?!’
মানুষটাকে আর দেখল না তারা।
মিলিয়ে গেছে সে। ঠাণ্ডায়, জোছনায়, কনকনে হাওয়ায়।
তাদের শুধু অনেক শীত করে উঠল।