<p><strong>চশমা পরা হনুমান</strong></p> <p>ভোর হয়েছে সবে। হাঁটছি কমলগঞ্জের আদমপুরের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। হঠাৎ বেশ দূরের এক গাছে বসে থাকতে দেখলাম দুটি প্রাণীকে। আরে এরা যে চশমা পরে বসে আছে! খুশি আর ধরছে না আমার। বিভিন্ন বনে মুখপোড়া হনুমানদের দেখলেও এই প্রথম আমার চশমা পরা হনুমান দেখা। গায়ে-গতরে খুব বড় হয় না। টেনেটুনে দুই ফুট। তবে লেজটা আড়াই ফুটি। গায়ের রং ধূসর থেকে কালচে বাদামি। পেট আর বুক সাদা। চোখের চারপাশের লোম সাদা বলে দেখে মনে হয় যেন চশমা পরে বসে আছে। এরা বেশ লাজুক। তাই দেখা পাওয়া মুশকিল। একেকটা দলে বাচ্চাসহ সাত-আটটা হনুমান থাকে। একটা পুরুষ হনুমান দলের নেতৃত্ব দেয়। কোনো কারণে ভয় পেলে বা উত্তেজিত হলে কর্কশ কণ্ঠে চিৎকার করে। খাবার মেনুতে আছে অনেক কিছু। কচি পাতা, ফুল, ফল, বীজ, কীট-পতঙ্গ আর পাখির ডিম। বাংলাদেশ ছাড়া পাওয়া যায় ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, লাউস প্রভৃতি দেশে।</p> <p> </p> <p><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/Print- 2018/04 April/27-04-2018/kalerkantho-3-2018-04-27.jpg" /></p> <p>  <p><strong>উল্লুক</strong></p> </p> <p>শ্রীমঙ্গলের লাউয়াছড়া ন্যাশনাল ফরেস্ট। ঢুকতেই তুমুল হট্টগোলের শব্দ শুনতে পেলাম অরণ্যের গভীর থেকে। তবে শোরগোলটা মানুষের নয়, বন্যপ্রাণীর। আগে থেকেই এরা আমার পরিচিত, তাই জানি গোটা বন মাথায় তুললেও দলে বেশি প্রাণী নেই। শব্দ লক্ষ্য করে এগিয়ে চললাম। একসময় হট্টগোলকারীদের দেখা পেয়ে গেলাম। যা ধারণা করেছিলাম, মোটে তিনটা উল্লুক, গাছের ওপরে। কিন্তু চেঁচামেচি শুনে মনে হয় অন্তত ১০-১৫টি হবে। আসলে কয়েকটি উল্লুক ডাকলেই এই ডাকের প্রতিধ্বনি বনময় এভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে মনে হয়, অনেক ডাকছে।</p> <p>উল্লুক লম্বায় দুই থেকে তিন ফুট, ওজন ধরো ছয় থেকে ৯ কেজি। এদের কিন্তু লেজ থাকে না। পুরুষ আর মেয়ে উল্লুক আকারে প্রায় কাছাকাছি। তবে গায়ের রঙে পার্থক্য পাবে। পুরুষদের গায়ের রং কালো, তবে ভ্রু জোড়া সাদা। এদিকে মেয়েদের সারা শরীর সোনালি-বাদামি লোমে ঢাকা। তবে চোখ আর মুখের চারপাশে সাদা লোম থাকে। বাচ্চাদের গায়ের রং বাদামি। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে অবশ্য কালো হয়ে যায়। আরো বড় হলে মেয়েরা সোনালি-বাদামি রং ধারণ করে। সাধারণত বন্য পরিবেশে ২০-২৫ বছর বাঁচে। বিভিন্ন ধরনের ফল, পোকা-মাকড় আর গাছের কচি পাতা এদের পছন্দের খাবার।</p> <p>উল্লুকদের হাত-পা অনেক লম্বা। এই লম্বা হাত-পায়ের সাহায্যে এক গাছ থেকে অন্য গাছে চলে যায় অবলীলায়। গভীর জঙ্গলে একটার পাশে আরেকটা গাছ থাকায় এরা গাছে-গাছে দ্রুতগতিতে অনেক দূর চলে যেতে পারে। এদের এভাবে এক গাছ থেকে আরেক গাছে যাওয়া দেখার মতো এক দৃশ্য। বিপন্ন প্রাণী এই উল্লুক। বাংলাদেশ ছাড়া পাবে মিয়ানমার আর চীনে।</p> <p> </p> <p><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/Print- 2018/04 April/27-04-2018/kalerkantho-4-2018-04-27.jpg" /></p> <p><strong>উড়ন্ত কাঠবিড়ালি</strong></p> <p>নামটা শুনেই নিশ্চয় একটু চমকে গেলে! ভাবছ কাঠবিড়ালি আবার উড়তে পারে নাকি? এই জাতের কাঠবিড়ালিরা উড়তে না পারলেও হঠাৎ শূন্যে ভেসে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে দেখলে যে কেউ ভাববে এরা উড়তে পারে। নামও তাই উড়ন্ত কাঠবিড়ালি। এখন নিশ্চয় আরো ধন্দে পড়ে গেছ! উড়তে পারে না, আবার মনে হচ্ছে ওড়ে, বিষয়টা কী? আসলে এরা গ্লাইড করে। এক গাছ থেকে এক-দেড় শ হাত দূরের আরেক গাছে চলে যেতে পারে গ্লাইড করে। এই কাঠবিড়ালিদের হাত-পা একটা চামড়া বা পর্দা দিয়ে যুক্ত থাকে। এক গাছ থেকে আরেক গাছে যখন যায় তখন এই পর্দার সাহায্যে বাতাসে এরা গ্লাইড করে চলে। কিন্তু এভাবে শুধু ওপর থেকে নিচের গাছে যেতে পারে। নিচের থেকে ওপরে যাওয়া সম্ভব হয় না। উড়ন্ত কাঠবিড়ালিদের শরীরটা বেশি বড় না হলেও লেজটা অনেক লম্বা। গায়ের রং বাদামি। সিলেট আর পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম কিছু বনে পাবে। যেমন কালেঙ্গা। কালেঙ্গাতে একবার ঘুরতে গিয়েছিলাম বিখ্যাত গাইড রুহুল আমিন ভাইয়ের সঙ্গে। তিনি বললেন, একবার বনের একটা গাছ কাটা হচ্ছিল, হঠাৎ গাছটা ধসে পড়ার আগ মুহূর্তে একটা উড়ন্ত কাঠবিড়ালি ওই গাছের একটা খোড়ল বা গর্ত থেকে শূন্যে লাফ দেয়। তারপর গ্লাইড করে চলে যায় ১০০ হাত দূরের আরেকটা গাছে।</p> <p> </p> <p><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/Print- 2018/04 April/27-04-2018/kalerkantho-5-2018-04-27.jpg" style="height:483px; width:800px" /></p> <p><strong>মুখপোড়া হনুমান</strong></p> <p>হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাটের সুন্দর এক বন সাতছড়ি। নানার বাড়ির কাছে হওয়ায় ওখানে গেছি বারবারই। প্রায় প্রতিবারই দেখা হয়ে গেছে মুখপোড়া হনুমানদের সঙ্গে। ওদের মুখটা এমন কালো যে হঠাৎ দেখলে ভাববে কালি মেখে বসে আছে, কিংবা বুঝি বা পুড়ে গেছে মুখটা। তাই এদের নামও রাখা হয়েছে মুখপোড়া হনুমান। মুখ ছাড়া কান, হাত আর পায়ের পাতাও মিশমিশে কালো। তবে মুখের চারপাশ আর পিঠ ঢাকা ধূসর-বাদামি লোমে। বুক-পেট আর শরীরের নিচেরটা আবার লাল কিংবা লালচে বাদামি। এদের শরীরটা দুই ফুটের একটু বেশি। কিন্তু লেজটা আরো লম্বা। প্রায় ৪০ ইঞ্চি। গাছপালার মধ্যে গোটা শরীর ঢাকা পড়লেও লেজটা ঝুলে থাকতে দেখা যায়। ওজন ৯ থেকে ১৪ কেজি। দল বেঁধে গাছেই থাকে সব সময়। এক গাছ থেকে আরেক গাছে লাফিয়ে যাতায়াত করে। প্রিয় খাবার গাছের কচি পাতা, ফুল ও কিছু জাতের ফল। বাচ্চা বুকে নিয়ে এই হনুমানদের এক গাছ থেকে আরেক গাছে লাফিয়ে চলার দৃশ্যটা দারুণ!</p> <p>মুখপোড়া হনুমান খুব সতর্ক প্রাণী। কোনো মাংসাশী প্রাণীর উপস্থিতি টের পেলে দলের প্রহরী কর্কশ কণ্ঠে ডাকতে থাকে। তখন বনের অন্য প্রাণীরাও সতর্ক হওয়ার সুযোগ পায়।</p> <p> </p> <p><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/Print- 2018/04 April/27-04-2018/kalerkantho-6-2018-04-27.jpg" style="height:483px; width:800px" /></p> <p><strong>লজ্জাবতী বানর</strong></p> <p>বাংলাদেশে বাস করা সবচেয়ে ছোট প্রাইমেট হলো লজ্জাবতী বানর। এরা রাতে চলাফেরা করে। মানুষদেরও এড়িয়ে চলে। তাই নাম হয়ে গেছে লজ্জাবতী বা লাজুক বানর। আকারে পোষা বিড়ালের চেয়েও ছোট। বড় চোখ জোড়া রাতে কম আলোয় চলফেরা করার জন্য খুব উপযোগী। দিনের বেলা গাছের গর্তে কিংবা গাছের পাতার আড়ালে যেখানে সূর্যের আলো পৌঁছায় না সেখানে লুকিয়ে থাকে। এরা শুয়ে থাকে কুণ্ডলী পাকিয়ে। চোখ, ঠোঁট, নাক এসবও বুকের মধ্যে গুঁজে রাখে। ছোট্ট লেজটাও গুটিয়ে রাখে। এমনকি লেজ দিয়ে গাছের ডাল শক্তভাবে ধরে, উল্টোভাবেও ঝুলতে পারে। চলাফেরা করে খুব ধীরে-সুস্থে। খাদ্য তালিকায় আছে ফল, পাতা ও পোকা-মাকড়।</p> <p> </p> <p><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/Print- 2018/04 April/27-04-2018/kalerkantho-7-2018-04-27.jpg" /></p> <p><strong>বনরুই</strong></p> <p>বনরুই ডাঙায় থাকা এক স্তন্যপায়ী প্রাণী। কিন্তু শরীরে রুই মাছের আঁশের মতো দেখতে একরকম লোম থাকে। তাই এদের নাম বনরুই। শরীরের বেশির ভাগ অংশ গাঢ় হলদে-বাদামি। তবে গলার চামড়া গোলাপি-সাদা। লম্বা নাক, সামনের পায়ের নখগুলো লম্বা আর ধারালো। চলাফেরা করে রাতে। পছন্দ করে পিঁপড়া খেতে। তাই পিঁপড়াভুক নামেও পরিচিত। পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশে নানা ধরনের পিঁপড়াভুক থাকলেও বাংলাদেশে এই জাতের শুধু বনরুই-ই আছে। এ দেশের বনে বনরুইদের তিনটি প্রজাতি আছে। বনরুইরা বিপদে পড়লে সারা শরীর গুটিয়ে অনেকটা বলের মতো করে ফেলে। তখন এদের মাথা-মুখ এই বলের মধ্যে থাকে বলে শত্রুর পক্ষে শিকার করা মুশকিল হয়। বাংলাদেশে পত্রপত্রিকায় মাঝেমধ্যেই বনরুই ধরা পড়ার খবর পাবে। কিছু লোক বনরুইদের শরীরের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জন্য এদের ধরে বিক্রি করে দেয়। তাই কমছে এদের সংখ্যা।</p> <p> </p> <p><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/Print- 2018/04 April/27-04-2018/kalerkantho-2-2018-04-27.jpg" /></p> <p><strong>ফ্যাক্টস</strong></p> <p>♦    এই ফিচারে যে ছয় জাতের প্রাণীর কথা বলা হয়েছে এরা সবাই স্তন্যপায়ী প্রাণী।</p> <p>♦    মুখপোড়া হনুমান, চশমা পরা হনুমান, উল্লুক আর লজ্জাবতী বানর হলো প্রাইমেট। আমরা মানুষরাও প্রাইমেট। স্তুন্যপায়ীদের মধ্যে যাদের মগজটা বড়, তাদেরই প্রাইমেট বলে।</p> <p>♦    আচ্ছা, এই ছয় জাতের প্রাণীকেই পেতে পারো এমন বন কী আছে? হ্যাঁ আছে! রাঙামাটির কাপ্তাই আর পাবলাখালী, হবিগঞ্জের সাতছড়ি, রেমা-কালেঙ্গা ও মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়ায় এদের সবাইকে পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে বনে ঢুকলেই যে দেখবে তা নয়। মুখপোড়া হনুমান, চশমা পরা হনুমান আর উল্লুকদের দেখতে হলে বনগুলোতে গিয়ে বেশ কিছুটা সময় কাটাতে হবে। বাকিদের দেখা মোটেই সহজ কাজ নয়। সিলেট বিভাগ আর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের আরো কিছু বনেও এরা আছে।</p> <p> </p> <p>বান্দরবানের সাঙ্গু রিজার্ভে ম্রো শিশুর কোলে একটি উল্লুকের বাচ্চা।</p> <p>ছবি : মনিরুল খান</p>