ইরানে সম্প্রতি রাস্তায় বিপ্লবের ক্ষুদ্রকার যে প্রতিরূপ নজরে এলো তা একই সঙ্গে অদ্ভুত আবার খুব পরিচিত। পুরো ঘটনার দিকে যদি চোখ বোলাই দেখা যাবে, বঞ্চিত, দরিদ্র বা বেকার তরুণদের একটা বড় অংশ মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটির রাস্তায় নেমে আসে তাদের দারিদ্র্য, প্রশাসনের দুর্নীতি আর স্বাধীনতাহীনতার অভিযোগ জানাতে। দ্রুতই এই অভিযোগ নেতাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে রূপ নেয়। ন্যায্য আন্দোলন। তবে কয়েক দিনের মধ্যেই সরকারবিরোধীদের ওপর বন্দুকের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। যদিও সরকার নিজেই স্বীকার করেছে, মানুষের বাক্স্বাধীনতা আছে। তবে একই সঙ্গে সতর্ক করে এ-ও বলেছে যে যারা সহিংসতার আশ্রয় নিচ্ছে তাদের অবশ্যই এর জন্য মূল্য দিতে হবে। নিরাপত্তা বাহিনীর দুই সদস্যসহ অন্তত ২১ জন নিহত হয় ওই ঘটনায়।
ইরানের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী নেতা এই অশান্তির জন্য বিদেশি, বিশ্বাসঘাতক আর গোয়েন্দাদের দায়ী করেন। সর্বজ্যেষ্ঠ নেতা জানান, এর জন্য ‘অর্থ, অস্ত্র, রাজনীতি ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো’ দায়ী। আর বিদেশি রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সৌদি আরবের নাম উল্লেখ করা হয়। এরপর শুরু হয় সরকারপন্থীদের সমাবেশ। সংখ্যায় বিক্ষোভকারীদের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। ঘোষণা আসে, বিক্ষোভের ‘ইতি’ ঘটেছে।
এই ঘটনার সঙ্গে কি সিরিয়ার ২০১১ সালের ঘটনার মিল পাওয়া যাচ্ছে না? সেই একই দৃশ্য, একই কাহিনি! সরকারের নতুন কৃষিনীতির বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ, দরিদ্র একদল গ্রামের মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে এ বিক্ষোভ দ্রুতই সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। ঠিক ইরানের মতোই।
আসাদ সরকার তাত্ক্ষণিকভাবে দাবি করে, এর পেছনে ‘বিদেশি শক্তির হাত’ রয়েছে। ইরান সরকার অবশ্য তাদের বিরোধীদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়ার জন্য বিদেশিদের দায়ী করেনি। বরং ষড়যন্ত্রের কথাই বলেছে তারা। ইরানের মতো সিরিয়াও একসময় রাজধানী দামেস্কে সরকারপন্থীদের সমাবেশের পর বিক্ষোভ ‘শেষ হয়েছে’ বলে ঘোষণা করে।
তবে তাদের সেই ঘোষণা ভুল ছিল। যদিও যুক্তরাষ্ট্র বা সৌদি আরব (ব্রিটেনসহ সরকার পতনের চেষ্টায়) সফল হতে পারেনি। ২০০৯ সালে ইরান যে আদলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন-পরবর্তী বিক্ষোভ দমন করে মাহমুদ আহমাদিনেজাদের (তাঁর সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বেশ সাদৃশ্য রয়েছে) জয় নিশ্চিত করে, অনেকটা সেই কায়দায়ই টিকে গেলেন আসাদ।
পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্রের চর্চা ইরানে হয় না। সর্বোচ্চ নেতারা নির্ধারণ করে দেন কে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়াবেন এবং কে দাঁড়াবেন না। তবে দেশটির সক্রিয় পার্লামেন্ট আছে। জর্জ ডাব্লিউ বুশের দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভরা বিজয়ের বিষয়টি যদি বাদও দিই ট্রাম্পের জয়ের পর ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ভোটারদের স্বাধীনতার বিষয়টি তুলনা না করাই হয়তো ভালো।
তবে যে নিষ্ঠুর পদ্ধতিতে ইরানে ফাঁসি কার্যকর হয়, তা নিয়ে আমার নিজস্ব উদ্বেগ এখনো রয়ে গেছে। আমি আগেও বলেছি, সেন্ট্রিফিউজের চেয়েও এই ফাঁসির ব্যবস্থা ইরানকে অনেক বেশি কলঙ্কিত করেছে। পরমাণুকেন্দ্র নিয়ে দর-কষাকষি চলতে পারে, কিন্তু কার্যকর হয়ে যাওয়া মৃত্যুদণ্ড নিয়ে কিছু করার থাকে না। ২০১৫ সালে ৭০০ জনের ফাঁসি কার্যকর হয়। পরের বছর হয় ৫৬৭ জনের।
ফেরা যাক ইরান-সিরিয়া প্রসঙ্গে। ২০০৬ সালে লেবাননের হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে ইসরায়েল লড়াই শুরু করে ইরান ও সিরিয়ার এই ঘনিষ্ঠ সংগঠনটিকে ধরাশায়ী করার লক্ষ্য নিয়ে। তারা ব্যর্থ হয়। হিজবুল্লাহ দাবি করে, তাদের জয় হয়েছে। তা হয়নি বটে, তবে ইসরায়েল পরাজিত হয়েছে। এরপরের লক্ষ্য ছিল ২০১১ সালে সিরিয়া। এর নির্মমতা ও নৃশংসতার কাহিনি আমরা জানি। এ ক্ষেত্রেও পশ্চিমা শক্তি ও ইসরায়েল ব্যর্থ হয়েছে। রাশিয়া, হিজবুল্লাহ আর ইরানকে পাশে নিয়ে জিতে গেছেন আসাদ।
প্রায় একই ধরনের খেলা চলছে ইরানেও। একই নাটক। একই শত্রু—সৌদি আরব, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প বলেছেন, ‘বিশ্ব দেখছে’। অবশ্যই। তবে আমি বিস্মিত হচ্ছি যে যুক্তরাষ্ট্র ছয় মাস আগে ইরানের দায়িত্ব দিয়ে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) যে খ্যাতনামা কর্মকর্তাকে নিয়োগ দিল তাঁর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র বা ব্রিটেনের কোনো মিডিয়াই কিছু বলছে না। গত জুনে নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছিল, ‘ডার্ক প্রিন্স’ নামে খ্যাত ‘আয়াতুল্লাহ মাইক’কে (মাইক পম্পেয়) ইরানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি এসংক্রান্ত নানা গোপন তৎপরতার নেতৃত্ব দেবেন। পত্রিকাটি সেই সময় জানায়, ‘ইরান সিআইএর অন্যতম কঠিন লক্ষ্য।’ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ইরানসংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়ে ডি অ্যান্ড্রির ওপর। আল-কায়েদাকে দুর্বল করতে তাঁর মতো দক্ষতা এককভাবে আর কোনো সিআইএ কর্মকর্তার নেই। ইরানে ক্ষমতাসীনদের পরিবর্তন চাইছিলেন ট্রাম্প, যার প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন করা হবে সিআইএর গোপন তৎপরতায়।
যুক্তরাষ্ট্রের ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার কয়েক বছর পর নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছিল, ওই ঘটনার পর ডি অ্যান্ড্রি গভীরভাবে আটক ও জিজ্ঞাসাবাদ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ডি অ্যান্ড্রি সিআইএর সন্ত্রাসবিরোধী কেন্দ্রে যোগ দেন ২০০৬ সালে। তাঁর নেতৃত্বাধীন একটি দল ২০০৮ সালে হিজবুল্লাহর সর্বজ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ইমাদ মৌগনিয়ের হত্যায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে। আফগান-পাকিস্তান সীমান্তবর্তী এলাকায় যে চালকহীন বিমান (ড্রোন) হামলা চালানো হয়, তাতেও প্রধান ভূমিকা পালন করেন ডি অ্যান্ড্রি।
ইরান ও সিরিয়ার জন্য একটি সতর্কবার্তা দেওয়া যায়, কয়েক মাস ধরেই এই লোকের অবস্থান সম্পর্কে আমরা কিছু জানি না। তিনি কি সম্প্রতি ইরান সম্পর্কে খুব আগ্রহী? হওয়ারই কথা, তাঁর কাজই এটা। তবে তিনি নীরব কেন? এখানে কি একটি সুতা ছেড়ে দিচ্ছি আমরা? বৃদ্ধ খামেনি যে গোয়েন্দা তৎপরতার কথা বলছেন, তা কি মাইকেল ডি অ্যান্ড্রিকে লক্ষ্য করেই? তিনিই কি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চাওয়া পূরণ করছেন? আমি নিশ্চিত নই যে ‘বিশ্ব দেখছে’। তবে এখন দেখাটাই উচিত।
লেখক : মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক ব্রিটিশ সাংবাদিক
সূত্র : দি ইনডিপেনডেন্ট
ভাষান্তর : তামান্না মিনহাজ
মন্তব্য
আলোচিত সংবাদ
ব্যাখ্যা ছাড়া সর্বসাধারণের পক্ষে কোরআন বোঝা সম্ভব নয়
আমাদের জাহিদ গুগলের ম্যানেজার
সারাদিন বিছানায় শুয়ে অন্যের রক্ত যোগাড় করেই দিন কাটে মিমের
সিগারেট তৈরির একটি মূল উপাদান ইঁদুরের বিষ্ঠা!
পরকীয়া প্রেমিকের স্ত্রী-কন্যার মারধরের শিকার চিত্রনায়িকা রাকা
বিশ্বের যেসব দেশ ভ্রমণে ভিসা লাগে না...