<p>১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর যুদ্ধাপরাধের জন্য পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে বলেছে বাংলাদেশ। সরকারের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে বাংলাদেশের প্রখ্যাত কয়েকজন লেখকও এ কথা বলতে শুরু করেছেন।</p> <p>ইসলামাবাদ কেন ঢাকার কাছে ক্ষমা চাইতে আগ্রহী নয়, তা ঠিকমতো বুঝতে হলে বাঙালিদের আমার অঞ্চল বেলুচিস্তানের ইতিহাস, পরিপ্রেক্ষিত ও বর্তমান পরিস্থিতি বুঝতে হবে। ১৯৭১ সালে বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালানোর আগে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বেলুচিস্তানে তিনটি বড় সামরিক অভিযান চালিয়েছিল। তারাই পরে বাঙালি নিধন শুরু করে।</p> <p>১৯৪৭ সালে ধর্মনিরপেক্ষ বেলুচিস্তান অঞ্চল (সাবেক কালাত রাজ্য) ইসলামপন্থী পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত হতে চায়নি। পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কালাতে সামরিক অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেন। কী পরিহাস! কালাত রাজ্যের আইন-উপদেষ্টাও ছিলেন তিনি। এরপর বেলুচরা সার্বভৌমত্ব হারায়, পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হতে বাধ্য হয়।</p> <p>বেলুচদের প্রতি পাকিস্তানের নির্মম আচরণ রাজনৈতিক ভিন্নমত ও জাতীয়তাবাদী প্রবণতা দমনে একটি মুসলিম রাষ্ট্র কী করতে পারে সে ব্যাপারে বাঙালিদের ভাবার সুযোগ দিয়ে থাকতে পারে। বেলুচরা করাচি (পাকিস্তানের সাবেক রাজধানী) কর্তৃক তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ আত্মসাতের প্রতিবাদ করেছে। এ জন্য পাকিস্তানের নির্মম সামরিক অভিযানের শিকার হতে হয়েছে তাদের। কিন্তু তখন বাঙালিরা বেলুচদের সমর্থনে কথা বলেনি। তারা হয়তো ভেবেছিল, এ ধরনের নৃশংসতা ছোটখাটো জাতিগোষ্ঠীর ওপর চললেও অবিভক্ত পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠী বাঙালির ওপর কখনোই চালানো হবে না।</p> <p>ভারতের সামরিক ও কূটনৈতিক সহায়তা ও ৩০ লাখ মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু ভারতীয় বা বাঙালি—কেউই আর বেলুচদের ওপর পাকিস্তানের নির্মমতার দিকে নজর দেয়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার দুই বছর পর পাকিস্তান বেলুচিস্তানে আরেক দফা সামরিক অভিযান চালিয়ে হাজার হাজার বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী, বিভিন্ন গোত্রের সদস্য ও পেশাজীবীকে হত্যা করে।</p> <p>১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বেলুচরা বাঙালিদের মতোই মধ্য-বামপন্থী পাকিস্তান পিপলস পার্টিকে ভোট দেয়নি। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী জোট বেলুচিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। কিন্তু পাকিস্তানিরা বেলুচ জনগণের রায় প্রত্যাখ্যান করে পার্লামেন্টের সব নির্বাচিত সদস্যকে কারাগারে নিক্ষেপ করে। রাজনৈতিক ভিন্ন মতাবলম্বীদের দমনের জন্য বড় ধরনের সামরিক অভিযান চালায়। হাজার হাজার বেলুচকে বাস্তুচ্যুত করা হয়। তারা পার্শ্ববর্তী আফগানিস্তানে গিয়ে আশ্রয় নেয়।</p> <p>বেলুচিস্তানের প্রাকৃতিক গ্যাসের কারণে পাকিস্তান লাভবান হয়েছে। কিন্তু বেলুচদের জন্য কাজের কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। সরকারি প্রতিষ্ঠানে তাদের পর্যাপ্ত সংখ্যায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। দক্ষিণ এশিয়ার সামাজিক উন্নয়নের বেশ কিছু সূচকে বেলুচিস্তান একেবারে নিচের দিকে।</p> <p>পাকিস্তান কর্তৃক নিরস্ত্র বেলুচ রাজনৈতিক কর্মীদের হত্যার প্রতিবাদ যখন কেউ করেনি তখন বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালানোর জন্য পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে বলার নৈতিক অধিকার বিশ্ববাসীর নেই। বেলুচদের ওপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বাঙালিরা প্রতিবাদ জানায়নি বলেই পাকিস্তান নিজেকে দায়মুক্ত মনে করে নির্মমতা চালিয়ে গেছে। বেলুচদের ওপরই পাকিস্তান প্রথম সামরিক অভিযান চালায়। এরপর বাঙালিদের ওপর। পাকিস্তান বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চায়নি, কারণ তারা মনে করে, মানবাধিকারকে পায়ে দলেও শাস্তি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।</p> <p>২০০৪ সাল থেকে বেলুচিস্তানে সামরিক অভিযান চালাচ্ছে পাকিস্তান; পাঞ্জাবি-অধ্যুষিত সেনাবাহিনীর এটি পঞ্চম অভিযান। বিগত বছরগুলোতে হাজার হাজার বেলুচ রাজনৈতিক কর্মী, শিক্ষার্থী, লেখক ও চিকিৎসক ‘নিখোঁজ’ হয়েছে; অনেকটা আর্জেন্টিনার ‘ডার্টি ওয়ার’-এর মতো। এত বড় ঘটনার অভিজ্ঞতা বাঙালিদেরও নেই। ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী শত শত ব্যক্তিকে অবৈধভাবে কারাগারে রেখে নিয়মিত নির্যাতন করা হয়েছে। তাদের মৃতদেহ নির্জন এলাকায় নিয়ে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে।</p> <p>পাকিস্তান তার কৃতকর্মের জন্য কখনোই ক্ষমা চায়নি, জবাবদিহির প্রয়োজনও বোধ করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে শতকোটি ডলার পেয়ে তাদের মধ্যে একধরনের আত্মবিশ্বাস জন্মেছে। দক্ষিণ এশিয়ার এই রাষ্ট্রটি যখন জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে—ওয়াশিংটন তখন চোখ বন্ধ করে রেখেছে। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের অবহেলার কারণে বাঙালিরা দুর্ভোগ সয়েছে। আর ওবামার অবহেলার শিকার বেলুচরা।</p> <p>কী পরিহাস! প্রায় সব পাকিস্তানি শাসকই বেলুচদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন! যিনি ক্ষমা চেয়েছেন তিনিই আবার নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়েছেন। পাকিস্তানের কাছ থেকে ক্ষমা চাওয়ার মধ্যেই বাঙালিদের সন্তুষ্ট থাকলে চলবে না, বেলুচদের মতো আন্তর্জাতিক আদালতে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা ও গোয়েন্দাদের বিচারের দাবি জানাতে হবে। ছাড় দিলে বা ভুলে গেলে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের হাতই শক্তিশালী হয়। জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর লেখক, বুদ্ধিজীবী ও মানবাধিকারকর্মীদের উচিত নির্যাতন-নিপীড়নের স্বল্প-উল্লিখিত ঘটনাবলিকে বিশ্ববাসীর নজরে আনার জন্য জোটবদ্ধ হয়ে কাজ করা।</p> <p><strong>লেখক :</strong> যুক্তরাষ্ট্রে বাসরত বেলুচ সাংবাদিক হাফিংটন পোস্টের প্রদায়ক</p> <p><strong>সূত্র : </strong>হাফিংটন পোস্ট</p> <p>ভাষান্তর : <strong>তামান্না মিনহাজ</strong></p>