<p>বিনিয়োগ কথাটার অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক। কৃষি, শিল্প সর্বত্রই বিনিয়োগের প্রয়োজন। এর ফলে উৎপাদন বাড়বে, দেশের সম্পদ বাড়বে। কেননা বিনিয়োগ মানে পুঁজি জোগান দেওয়া। অর্থবিজ্ঞানে বলাই হয়েছে, উৎপাদনের অন্যতম অর্থাৎ অবিচ্ছেদ্য উপাদান পুঁজি। বর্তমানে বিশ্ব বিনিয়োগ সপ্তাহ পালন করা হচ্ছে (২-৮ অক্টোবর ২০১৭)। বিশ্বের ৮১টি দেশে এই সপ্তাহ উদ্‌যাপিত হচ্ছে। প্রথমে ভেবেছিলাম যে বিনিয়োগের সার্বিক অর্থে সপ্তাহটি পালন করা হচ্ছে। কিন্তু যখন জানা গেল যে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) তত্ত্বাবধানে এবং মূল আয়োজক তখন বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না যে বিনিয়োগের Truncated concept নিয়ে আলোচনা। অর্থাৎ পুঁজিবাজার নিয়ে, সেখানে মূল গুরুত্ব পোর্টফোলিও বিনিয়োগ। যা হোক, এসব আলোচনা করতে গিয়ে কিছু বক্তব্য এসেছে, যার ব্যাখ্যা প্রয়োজন। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব রয়েছে। তবে সেটা জাতীয় বিপর্যয়ের মূল কারণ নয়। বাংলাদেশে ’৯৬ এবং ২০০৯-১০ সালে যে শেয়ার বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটল তার জন্য যারা দায়ী তাদের জ্ঞানের অভাব ছিল না। তাদের অনেকে ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত সফল ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারী। দুবারই তদন্ত হয়েছে। প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে এবং কারা দায়ী তাও চিহ্নিত হয়েছে। যেটি হয়নি তা হলো, এদের বিচার হয়নি। বিএসইসি, যার এসবের মূল দায়িত্ব, তারা নির্লিপ্ত। এখানে একটি কথা বলতে হয়। চলতি সপ্তাহের এক আলোচনাসভায় বলা হয়েছে যে Financial literacy-র অভাব। এ ব্যাপারে শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। হ্যাঁ, তবে সেটি দিতে হবে উচ্চপর্যায়ে। এ কথাটির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন অর্থসচিব (ব্যাংকিং)। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে তাদের Knowledge on financial literacy পর্যাপ্ত ছিল না। অতএব এই শিক্ষা প্রদান ওপর থেকে শুরু হওয়া বাঞ্ছনীয়।</p> <p>এখানে উল্লেখ্য যে শেয়ার ব্যবসায় Speculation অপরিহার্য। একটি শেয়ার সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য পাওয়ার পরও একজন বিনিয়োগকারীকে Speculate করতে হবে। বিকল্প কোনো রাস্তা নেই। অভিধানে বাংলায় বলা হয়েছে যে Speculation মানে ফটকাবাজি। আমি একটি ভালো কম্পানির শেয়ার কিনেছি। যার পিইরেসিওসহ আনুষঙ্গিক সবই ভালো। কিন্তু কি করে বুঝব যে কী পরিমাণ বিনিয়োগকারী এই শেয়ারটি কিনতে আসবে। অতএব অনেকটা অনুমাননির্ভর হতে হবে। শুধু যে আমাদের মতো কম লেখাপড়া জানা দেশে শেয়ার ধস নামে, তা তো নয়, এক যুগের বেশি সময় আগে সিঙ্গাপুর স্টক এক্সচেঞ্জে পৃথিবীর পুরনো মার্চেন্ট ব্যাংক ব্যারিং ব্যাংক ডুবল, সেখানকার বিনিয়োগকারীরা কম লেখাপড়া জানেন সে রকম মনে করার কোনো কারণ নেই। সম্ভবত দুই-তিন বছর আগে নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্য মি. ম্যাডফের জেল হলো শেয়ারবাজারে অপরাধ সংঘটনের জন্য। আসলে পৃথিবীর সব ব্যবসায় যেমন নানা দুর্নীতি করার সুযোগ আছে এবং মাঝেমধ্যে তা হয়ে থাকে, শেয়ারবাজারেও অনুরূপ। যেটি প্রয়োজন তা হলো, এসব প্রতিরোধ করার বা শাস্তি দেওয়ার প্রতিষ্ঠান থাকবে, যারা সব চাপের ঊর্ধ্বে থেকে কাজ করবে। রাষ্ট্র থেকে কোনো Impunity culture-এর সুযোগ পাবে না। যুক্তরাজ্যে করপোরেট জালিয়াতি ঠেকানোর জন্য ডিপার্টমেন্ট অব ফ্রড রয়েছে।</p> <p>বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখানেও বিভিন্ন সেমিনার হচ্ছে, ভালো কথা। একসময় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে চাকরি করছি, তারই রেশ ধরে কিছু লেখালেখির চেষ্টা করি। সেখানকার একজন কর্মকর্তা আমার জ্ঞানকে আপডেট করার জন্য এসব সেমিনারে যাওয়ার আবেদন জানিয়েছেন। তবে বড় কথা যে ডিএসই সদস্যরা যে পুরনো ধ্যান-ধারণার অচলায়তন ভেঙে স্টক এক্সচেঞ্জের ডিমিউচুয়ালাইজেশনকে মেনে নিয়েছেন, এটি সবচেয়ে বড় আপডেট।</p> <p>স্টক এক্সচেঞ্জ একটি বাজার, এখানে পণ্য যত বেশি আসবে, ক্রেতার সংখ্যা বাড়বে, মার্কেট জমজামট হবে। আমাদের প্রশ্ন, আজ থেকে এক যুগের বেশি সময় আগে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে পাবলিক লিমিটেড কম্পানি করা হলো। অথচ আজ পর্যন্ত একটি শেয়ারও বাজারে ছাড়া হলো না। অর্থমন্ত্রী বারবার আহ্বান জানানোর পরও কোনো রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাজারে শেয়ার বিক্রি করল না। বাংলাদেশের প্রাথমিক মার্কেট অত্যন্ত শক্তিশালী। আজ অবধি এ রকম কোনো ঘটনা ঘটেনি যে ভালো কম্পানির আইপিওতে পর্যাপ্ত আবেদনকারী পাওয়া যায়নি। তালিকাভুক্ত কম্পানিকে ১০ শতাংশ করপোরেট ট্যাক্স ছাড় দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য সুযোগ বা ইনসেনটিভ দেওয়া হয়েছে, তার পরও বেসরকারি কম্পানি সেভাবে এগিয়ে আসছে না। স্টক এক্সচেঞ্জের অনেক সদস্য রয়েছেন, যাঁরা বেশ ভালো ও প্রতিষ্ঠিত কম্পানির মালিক। তাঁরা আইপিওতে আসছেন না, এসব বিষয়ে বিএসইসি একটু বেশি মনোযোগ দিলে ভালো হতো।</p> <p>আইপিওতে অংশগ্রহণ করা মানে জাতীয় বিনিয়োগ প্রবাহের মূলধারায় সংযোজিত হওয়া। এতে যত বেশি বিনিয়োগকারী আসবেন তত বেশি স্টক এক্সচেঞ্জের ভিত মজবুত হবে। আগাগোড়া লক্ষ করা যাচ্ছে যে বিএসইসি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ারবাজারমুখী করার ব্যাপারে বেশি উৎসাহী। অথচ অনেক সম্ভাব্য উদ্যোগী রয়েছেন, যাঁরা স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হচ্ছেন না। আবার এও লক্ষ করা গেছে যে প্রাথমিক পর্যায়ে ভালো অবস্থায় থাকার পরও শেয়ারবাজারে আসেন না। মুনাফা অর্জনের পর এক বিরাট অঙ্কের প্রিমিয়ামের মাধ্যমে আইপিওতে আসছেন, যাকে বলে ডাবল গেইন। পরিশেষে একটা কথা মনে রাখতে হবে যে যতই এলেম দান করা হোক না কেন, স্টক এক্সচেঞ্জে সব সময় সবাই লাভ করতে পারবে না। লাভ-লোকসান দিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।</p> <p><strong>লেখক : </strong>সাবেক সরকারি কর্মকর্তা</p>