<p>সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ ছিলেন বাংলাদেশের একজন স্বনামখ্যাত ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত অপরাজেয় বাংলার ভাস্কর। শিল্পকলা ও ভাস্কর্যে গৌরবজনক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ২০১৪ সালে শিল্পকলা পদক ও ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত হন।</p> <p>আবদুল্লাহ খালিদ বাংলাদেশের সিলেট জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬৯ সালে তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান কলেজ অব আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটস (বর্তমান চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে চিত্রাঙ্কন বিষয়ে স্নাতক ও ১৯৭৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিত্রাঙ্কন ও ভাস্কর্য বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।</p> <p>আবদুল্লাহ খালিদ তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাস্কর্য বিভাগে শিক্ষকতা দিয়ে। ১৯৭২ সালে সেখানকার লেকচারার থাকাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসুর উদ্যোগে কলা ভবনের সামনে নির্মিতব্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মারক অপরাজেয় বাংলা নির্মাণের দায়িত্ব পান। তিনি ১৯৭৩ সালে ভাস্কর্যটির নির্মাণকাজ শুরু করেন এবং ১৯৭৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর নির্মাণকাজ শেষ করার পর স্থাপনাটির উদ্বোধন করা হয়।</p> <p>সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি মোটামুটি পরিণত বয়সেই মারা গেছেন। যদিও আমরা ধরে নিই এখন বাংলাদেশের অনেক মানুষ ৮০ বছরের ওপরেও বাঁচেন। তিনি ৭৫ বছর বয়সে মারা গেছেন। তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে খানিকটা অসুস্থ ছিলেন। তবুও তিনি কাজ করে গেছেন। বলিষ্ঠ জীবন যাপন করেছেন। শিক্ষকতা করেছেন, শিল্পচর্চা করে গেছেন।</p> <p>আবদুল্লাহ খালিদ যে শিল্পচর্চা করেছেন, সেটা হলো ভাস্কর্যশিল্প। স্বাধীনতার পরে আমাদের ভাস্কর্যশিল্পের যে প্রকাশ ঘটল, এই প্রকাশটা কিন্তু দেশ স্বাধীন না হলে হতো না। কারণ পাকিস্তান আমলে আমরা শিল্পীরা ছবি আঁকতে পারতাম, তবে একটু ফিগারিটির ছবি আঁকলে, মানুষের ছবি আঁকলে পাকিস্তান রাষ্ট্র কিন্তু শিল্পীদের অন্য চোখে দেখত। ভাস্কর্যের চিন্তা করতে তখন আমাদের খুব বেগ পেতে হতো। যদিও আমাদের চারুকলার ভাস্কর্য বিভাগ পাকিস্তান আমলের মাঝামাঝি শুরু হয় এবং সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ সেই প্রথমদিকেরই একজন ছাত্র। এমন একটি বৈরী আবহাওয়ায় ভাস্কর্য বিষয়টিকে শিল্পচর্চা ও জীবনধারণের মাধ্যম হিসেবে নেওয়া ছিল কঠিন বিষয়। আমি বলব, রীতিমতো বিপ্লবী মনোভাব না থাকলে ও সব বাধা ডিঙানোর মতো মন না থাকলে এটা পারা যায় না। আবদুল্লাহ খালিদ এই শিল্পকর্ম চর্চার মাধ্যমে কিন্তু তাঁর এই ব্যক্তিবৈশিষ্ট্যের প্রকাশ প্রথম জীবনেই করতে পেরেছেন। আবদুল্লাহ খালিদ বিখ্যাত হয়েছেন বা আমাদের সবার কাছে পরিচিত হয়েছেন ভাস্কর হিসেবেই। স্বাধীনতার পরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে অপরাজেয় বাংলা স্থাপন করা হয়, আমি বলতে চাই, ভাস্কর্যশিল্পে এটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। আমাদের ভাস্কর্যশিল্পের জন্য তিনি যা করেছেন, তা অনন্য। তাঁর যে শৈল্পিক চেতনা, সেটি কিন্তু আমাদের ভাস্কর্যশিল্পের জন্য একটি অসাধারণ নিদর্শন হিসেবেই এখন বিবেচিত। কিন্তু আশ্চর্য, সেই সময় স্বাধীনতার চেতনা নিয়ে সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ যে অসাধারণ কাজটি করেছেন, এর ধারাবাহিকতায় তাঁর সমসাময়িক বা পরের ভাস্কর্যশিল্পীদের কেউ অপরাজেয় বাংলাকে অতিক্রম করতে পারেননি। এমনকি তিনিও না। এমনটি কেন হলো? বিষয়টি আমার কাছে একটা বিস্ময়কর ব্যাপার।</p> <p>সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদের ভাস্কর্যশিল্পের প্রথম প্রকাশটা অসাধারণ। তারই ধারাবাহিকতায় ঢাকা শহরে আমরা যে ভাস্কর্যগুলো দেখি, এগুলোর বেশির ভাগই ভাস্কর্যের নামে জঞ্জাল। যাই হোক, সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ তাঁর এই অপরাজেয় বাংলার জন্য চিরকাল অপরাজেয় থাকবেন। আমি মনে করি, তিনি একটি অসাধারণ কাজ করে গেছেন। এর পরও তিনি আরো বেশ কয়েকটি কাজ করেছেন। সেগুলোও নিঃসন্দেহে ভালো কাজ। তিনি ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশন কেন্দ্রের সামনে অবস্থিত ম্যুরাল আবহমান বাংলা ও ১৯৯৫-৯৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রধান দপ্তরের সামনে অবস্থিত টেরাকোটার ভাস্কর্য নির্মাণ করেন।</p> <p>বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনের টেরাকোটার ভাস্কর্যটিও সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ। এ ছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্যের মধ্যে রয়েছে ‘অঙ্কুর’, ‘অঙ্গীকার’, ‘ডলফিন’, ‘মা ও শিশু’ ইত্যাদি। চাঁদপুরে ‘অঙ্গীকার’ নামে যে ভাস্কর্য করেছেন, সেটিও খুব সুন্দর। চট্টগ্রামেও সুন্দর একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করেছেন। বিমানবাহিনীর একটি ভাস্কর্য করেছেন, আরো বেশ কিছু কাজ করেছেন। তিনি ছবিও আঁকতেন। এই মানুষটি সত্যি সত্যি একটি সুন্দর যাত্রা শুরু করেছিলেন অপরাজেয় বাংলার মধ্য দিয়ে। আমি বলব, এই একটিমাত্র কাজের জন্য আবদুল্লাহ খালিদ এ দেশের শিল্পকলার জগতে চিরদিন অপরাজেয় বিবেচিত হবেন।</p> <p><strong>লেখক :</strong> শিল্পী</p> <p>শ্রুতশিখন :<strong> আরাফাত শাহরিয়ার</strong></p>