<p>আন্তর্জাতিক ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর জার্নালে গবেষণার কাজ প্রকাশ করার স্বপ্ন অনেকেরই; বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য ভালো একটি স্কলারশিপ অথবা একজন ভালো মানের বিজ্ঞানী হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু এই ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর সম্পর্কে ধারণা না থাকার কারণেই প্রতারিত হচ্ছেন আমাদের অনেক শিক্ষার্থী ও গবেষক। ভারত, পাকিস্তানসহ নানা দেশের এসব প্রতারকচক্র ইন্টারন্যাশনাল নাম দিয়ে ও নিজের মনগড়া ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর বসিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে অনেক ডলার।</p> <p>দেখা গেছে, কথিত এসব জার্নাল আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন জার্নালের মতোই প্রক্রিয়ার ধোঁয়াশা তুলে গ্রাহকের কাছে বিশ্বস্ততা অর্জন করে। যেমন—লেখকদের সম্মতিপত্র পূরণ করানো, দুজন পরীক্ষকের মতামত দেওয়া ইত্যাদি। কোনো রকম পরিবর্তন ছাড়াই বা সামান্য পরিবর্তন সাপেক্ষে তারা আর্টিকেলটি (পেপার বা প্রবন্ধ) গ্রহণ করে এবং প্রকাশনার জন্য ডলার চায়। লেখক যদি কোনো ধরনের অভিজ্ঞতা ছাড়াই আর্টিকেলটি লিখে থাকেন, তাহলে বুঝতে হবে জার্নালটি আর্টিকেলটির গুণগত মানকে উপেক্ষা করে ব্যবসাকে প্রধান্য দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে জার্নালটি কথিত ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর জার্নাল বলে ধারণা করা যেতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে কথিত ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরযুক্ত আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত আর্টিকেলের গবেষণার বিষয়বস্তু ও লেখার মান দেখেই এসব জার্নালের গুণগত মান বোঝা যায়। এই অবস্থায় আর ফাঁদে পা না বাড়িয়ে জার্নালটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করা উচিত এবং বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের কোনো গবেষক বা অধ্যাপকের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত হবে।</p> <p>ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর (impact factor) হচ্ছে একটি জার্নালের গুণগত মান বিচারের মাপকাঠি। একটি জার্নালের ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর নির্ভর করে মূলত পূর্ববর্তী দুই বছরে ওই জার্নালে প্রকাশিত আর্টিকেলের তথ্য বা উপাত্ত একই জার্নাল বা অন্য কোনো জার্নালে প্রকাশিত আর্টিকেলে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহারের সংখ্যার ওপর। একটি জার্নালের ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর বলতে বোঝায় ওই জার্নালে গত এক বা দুই বছরে যে আর্টিকেলগুলো প্রকাশিত হয়েছে সেগুলো গড়ে একবার রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আর এ হিসাবে একটি জার্নালের ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর যত বেশি সেই জার্নালের গুণগত মান তত বেশি। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক জার্নাল হচ্ছে সেই জার্নাল, যেখানে বিশ্বের যেকোনো দেশের মানসম্মত গবেষণার বিষয়বস্তু প্রকাশ করা হয়, প্রকাশিত আর্টিকেলের মোট সংখ্যার কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ দেশের বাইরের হতে হয় এবং সম্পাদনা পরিষদে কমপক্ষে এক-চতুর্থাংশ সদস্য বাইরের দেশের থাকতে হয়। একটি জার্নাল আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হলেও এর ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর আপাতত না-ও থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে জার্নালটি হয়তো এখনো ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর অর্জন করতে পারেনি।</p> <p>আপনি যে জার্নালটিতে পেপার প্রকাশ করতে চাচ্ছেন, সেটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন কি না, তা জানতে Thomson Reuters Master Journal List-এ জার্নালটি আছে কি না, তা যাচাই করে নিতে হবে। আর ওই জার্নালের ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর কত, তা জানতে Thomson Reuters Journal Citation Reports (http://www.citefactor.org/impactfactor) দেখতে হবে। Thomson Reuters হচ্ছে বৈজ্ঞানিক জার্নাল সূচিভুক্ত করার একটি বিশ্বস্ত ও স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান, যার সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক সিটিতে অবস্থিত। প্রতিষ্ঠানটি ১৯৭৫ সাল থেকে তাদের তালিকাভুক্ত জার্নালগুলোর ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর গণনা করে আসছে। এ ছাড়া বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক বা একাডেমিক জার্নালকে সূচিভুক্ত করে থাকে। এসব প্রতিষ্ঠানে সূচিভুক্ত জার্নালগুলো Thomson Reuters-এ সূচিভুক্ত না-ও থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে ওই জার্নাল কোন প্রকাশনা গ্রুপের (যেমন : Elsevier, Wiley-Blackwell, Springer and Taylor & Francis) তা দেখতে হবে। বাংলাদেশে মাত্র তিনটি জার্নালের ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর রয়েছে। জার্নাল তিনটি হলো Bangladesh Journal of Botany, Bangladesh Journal of Pharmacology ও Bangladesh Journal of Plant Taxonomy।</p> <p>আমাদের দেশে গুটিকয়েক শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন গবেষণা হয়; বিশেষ করে মাস্টার্স পর্যায়ে যে গবেষণা হয়, তা দিয়ে ভালো মানের জার্নালে পেপার করা সম্ভব হয় না। কারণ মাস্টার্সের গবেষণায় খুব বেশি ভালো মানের কাজ করার সময় ও সুযোগ থাকে না। পিএইচডি পর্যায়ে যে গবেষণা হয়, সেগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হতে পারে যদি গবেষণা প্রকল্পে প্রয়োজনীয় আর্থিক সাপোর্ট থাকে। যা-ই হোক, কোনো গবেষক বা শিক্ষার্থী যদি তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশ করতে চান, সে ক্ষেত্রে প্রথমেই তাঁর কাজের মান যাচাই করার জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ের গবেষণার কাজগুলো অনলাইনে খুঁজে দেখা উচিত। নিজ কাজের সঙ্গে মিল আছে এরূপ আর্টিকেল কোন মানের জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে তা থেকে কাজের গুণগত মান অনুমান করা যেতে পারে। এরপর গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হলো জার্নাল বাছাই, এ ক্ষেত্রে কাজের ধরন ও গুণগত মান সাপেক্ষে জার্নাল বাছাই করতে হবে। আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ করার উপযোগী হলে প্রথমে একটি ভালো মানের জার্নালে, ব্যর্থ হলে অপেক্ষাকৃত কম মানের জার্নালে চেষ্টা করা যেতে পারে। অনেক সময় গবেষণার বিষয়বস্তু সুন্দরভাবে উপস্থাপন, সঠিক ও আধুনিক পদ্ধতির ব্যবহার এবং লেখার মান বৃদ্ধির মাধ্যমে কাজের গুণাগুণকে বাড়িয়ে তোলা যায়। এ ধরনের কোনো আর্টিকেল দেশীয় জার্নালে প্রকাশ করেও বিদেশে স্কলারশিপ পাওয়া যায়। কিন্তু কথিত ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরযুক্ত জার্নালে আর্টিকেল প্রকাশ করলে তা আন্তর্জাতিক প্রকাশনা হিসেবে উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কাজে না-ও লাগতে পারে।</p> <p> </p> <p><strong>লেখক : </strong>অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ</p> <p>szaman@bau.edu.bd</p>