<p>বাংলাদেশে আত্মহত্যায় পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা অনেক বেশি। বাংলাদেশ জার্নাল অব মেডিসিনের জানুয়ারি ২০১৩-তে প্রকাশিত ‘রিস্ক ফ্যাক্টরস অব সুইসাইড প্যারা রুরাল বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা অনুযায়ী এই হার নারী ৬১ শতাংশ এবং পুরুষ ৩৯ শতাংশ। নারীদের মধ্যে আবার যারা অল্প বয়সী অর্থাৎ স্কুল-কলেজে পড়ুয়া মেয়ে এবং বিবাহিত ও কম বয়সী, তাদের মধ্যে এই আত্মহত্যার হার বেশি।</p> <p>পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ-পরিস্থিতির প্ররোচনায় এসব কিশোরী তরুণী আর অল্প বয়সী নারীরা বাধ্য হচ্ছে আত্মহত্যা করতে। আত্মহত্যার যে কারণগুলো পত্রপত্রিকায় উঠে এসেছে, এর মধ্যে রয়েছে বখাটে কর্তৃক নিপীড়ন-নির্যাতন ও হুমকি, স্থানীয়ভাবে অর্থাৎ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তি তথা মাতব্বরদের কাছে অভিযোগ করে বিচার না পাওয়া, কখনো কখনো নিজ পরিবার কর্তৃক উল্টো মেয়েটিকেই দোষারোপ ও ভর্ত্সনা করা, যৌতুকের জন্য চাপ ও নির্যাতন, থানা পুলিশের অবহেলা-উপেক্ষা বা তাদের কাছ থেকে যথাযথ সাহায্য-সহযোগিতা না পাওয়া, আসামির গ্রেপ্তার না হওয়া, হলেও জামিনে বেরিয়ে এসে আরো বেশি মাত্রায় নির্যাতন করা ইত্যাদি। নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয় না, হলেও তার বিচার হয় না।</p> <p>বখাটেদের নিপীড়ন-নির্যাতনের কারণে অনেক নারীর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। কিন্তু এ বিষয়ে দেশে এখনো সুনির্দিষ্ট কোনো আইন প্রণয়ন করা হয়নি। হাইকোর্ট ২০১১ সালের শুরুতে ইভ টিজিং বা বখাটেপনাকে ‘যৌন হয়রানি’ বিবেচনা করে আইনে অন্তর্ভুক্তির নির্দেশ দিয়েছেন। হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, ‘ইভ টিজিং’ শব্দ থাকলে তা অপরাধের মাত্রা হালকা করে দেয়। এর পরিবর্তে সর্বস্তরে ‘যৌন হয়রানি’ শব্দ ব্যবহার করতে হবে। উচ্চ আদালত এ ধরনের নির্যাতন ও হয়রানি প্রতিরোধের জন্য তদারকি করতে প্রতি থানায় সেল গঠনের নির্দেশ দেন। রায়ের নির্দেশনাগুলো আইনে অন্তর্ভুক্ত করতে বলা হয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত রায়ের আলোকে আইন বা বিধি না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুসারে এসব নির্দেশনা আইন হিসেবে কার্যকর হবে।</p> <p>নারীর স্বার্থে, সমাজের স্বার্থে সেফগার্ড হিসেবে অবশ্যই সুনির্দিষ্ট আইন থাকা প্রয়োজন। অবশ্য নারীর প্রতি নির্যাতনপ্রসূত আত্মহত্যার বিষয়টি যেহেতু মানুষের মনমানসিকতা আর সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গেও সরাসরি যুক্ত, তাই আইনের পাশাপাশি যে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ কোন স্তরে রয়েছে তার পর্যালোচনা করা এবং এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য গুরুত্ব ও আন্তরিকতার সঙ্গে সব মহলের সচেষ্ট হওয়া। নেতিবাচক সামাজিক মূল্যবোধ আত্মহত্যায় প্ররোচনা, আত্মহত্যা এবং প্ররোচনাকারীর বিচার না হওয়ার এক মহা-অপশক্তি।</p> <p>আত্মহত্যার ঘটনাগুলোয় নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি এবং সামাজিক মূল্যবোধজনিত অনেক অনুষঙ্গ উঠে এসেছে। এক. দীর্ঘদিন ধরে উত্ত্যক্ত করা হলেও এর বিরুদ্ধে পরিবারের সরব না হওয়া, ইউনিয়ন চেয়ারম্যান কিংবা থানায় কোথাও কোনো অভিযোগ না জানানো, উল্টো মেয়ের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া। লোকলজ্জার ভয়ে মেয়ের পরিবারের আইনি কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া। প্রশ্ন হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে কে কাকে লজ্জা-ভয় করছে? লজ্জা-ভয় পাওয়ার কথা তো যে বখাটে, যে অপরাধী তার। যে নির্যাতনের শিকার তার বা তার পরিবারের তো লজ্জা-ভয় পাওয়ার কথা নয়। দুই. দীর্ঘ সময়ের মধ্যেও কোনো জবাবদিহির সম্মুখীন না হয়ে বখাটে আরো বেপরোয়া হয় এবং প্রকাশ্যেই বখাটেপনা চালাতে সাহস পায়। তিন. মেয়েটিকেই দায়ী করে বকাঝকা করা এবং এটা করে তার আপনজনরাই, যাদের কাছে তার সহায়তা, আশ্রয় ও নিরাপত্তা পাওয়ার কথা ছিল। চার. বখাটের অভিভাবকদের নীরব ভূমিকা। একজনের মা বলেন, ‘সে কী করেছে আমরা জানি না।’ আরেকজনের বাবা ঘটনা সম্পর্কে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। মা-বাবার সার্বিকভাবে অভিভাবকের যথাযথ ভূমিকা পালনে ব্যর্থতার ফলেই এসব ঘটনা ঘটে চলছে। উপরন্তু ঘটনার পর তাদের প্রশ্রয়মূলক আচরণ একদিকে বিচারের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, অন্যদিকে এহেন নীরবতায় অন্য বখাটে ও তাদের মা-বাবার ইন্ধন জোগানো হয়। পাঁচ. বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় প্রতিহিংসা চরিতার্থকরণ। ছয়. শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তুলে তার ভিডিও বাজারে ছেড়ে দেওয়া। এটি মেয়েদের বিরুদ্ধে একটি মোক্ষম অস্ত্র হয়ে আছে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধজনিত কারণে। মেয়েটি কী কারণে, কিভাবে ঘটনার শিকার হয়েছে সেসব বিবেচনায় না নিয়ে একতরফাভাবে তাকে নষ্টভ্রষ্ট, কলঙ্কিত মনে করা হয়। প্রতিহিংসাজনিত বা ষড়যন্ত্রমূলক কোনো ঘটনায় কিংবা কেউ ধর্ষকের কবলে পড়লে সে নষ্ট হয়ে যায় না। জীবনও তার মূল্য হারায় না। বিষয়টিকে যদি এভাবে দেখা হতো, তবে ভিডিওচিত্র বাজারে ছাড়ার মতো ঘটনা ঘটত না আর মেয়েরাও আত্মহত্যা করতে চাইত না। সাত. একটি মেয়ে যখন বখাটের কবলে পড়ে চূড়ান্ত রকম বিপন্ন ও দিশাহারা, যখন তার সহায়তা ও নিরাপত্তা প্রয়োজন, ঠিক তখনই তাকে তার স্কুল থেকে বহিষ্কার করা। এই ভয়ানক নিষ্ঠুর সিদ্ধান্তে মেয়েটির মনের অবস্থা কোন পর্যায় পৌঁছতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। বহিষ্কারের কারণ হিসেবে মেয়েটি স্কুলে গেলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হতে পারে বলে জানানো হয়। নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া যাতে না হয়, বরং বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার জন্য যাতে তার সহপাঠী, শিক্ষার্থীরা সমব্যথী হিসেবে তাকে সহযোগিতা করে এবং বখাটেপনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় সেটি নিশ্চিত করাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও স্কুল কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব হওয়া উচিত ছিল। তা না করে মেয়েটিকে বহিষ্কার করে তার গায়ে কলঙ্কের ছাপ দেওয়া হয়। তাকে বিচ্ছিন্ন ও একলা করে দিয়ে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়।</p> <p>নারী নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনাই নারীর প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধকেই প্রমাণ করে। কথা হচ্ছে, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ আকাশ থেকে পড়ে না কিংবা ‘হও’ বললেই হয়ে যায় না। শিশু-কিশোররা নিজ ঘরে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কী দেখছে, শুনছে, শিখছে এবং চর্চা করছে তা থেকেই ধীরে ধীরে তার মূল্যবোধ গড়ে ওঠে। আমাদের মনে রাখতে হবে আজকের শিশু-কিশোররাই ভবিষ্যতের তরুণ, যুবক, পূর্ণবয়স্ক মানুষ এবং অভিভাবক।</p> <p>দেশের শিক্ষানীতি এমন হওয়া প্রয়োজন, যেখানে শিক্ষার শুরু থেকেই শিক্ষার্থীদের চিন্তাচেতনার মধ্যে বৈষম্যহীনতা (জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র), সততা, মানবিকতার মতো বিষয়গুলো দানা বাঁধবে এবং চিন্তায়, কথায়, আচরণে ভালো মানুষ হওয়ার একটা ভিত্তি রচিত হবে। নিজ ঘরে এবং স্কুলে শিক্ষার্থীদের যদি ‘ছেলে’ ‘মেয়ে’ এই দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা না হয় এবং তাদের শিক্ষা যদি জেন্ডার নিরপেক্ষ হয়, তবে বড় হয়ে নিজেদের ‘নারী’ ‘পুরুষ’ হিসেবে না দেখে মানুষ হিসেবে দেখতে এবং বৈষম্য, দমন-পীড়নের পরিবর্তে মানবিক আচরণ করতে শিখবে। এটি একটি সহজ হিসাব, যা পিতৃতান্ত্রিক মনমানসিকতা বুঝতে চায় না, বুঝতে পারলেও মানতে চায় না। কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের মধ্যে যাতে একটি সহজ-স্বাভাবিক, সুস্থ, মানবিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে, সে জন্য যৌনতা, প্রজনন স্বাস্থ্য, ভালোবাসা, সম্পর্ক, জাতিসংঘের নারী অধিকার সনদ (সিডও), সর্বজনীন মানবাধিকার, নারীর স্বার্থসংশ্লিষ্ট বাংলাদেশের বিদ্যমান আইন, নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক মূল্যবোধ, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি বিষয় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করে শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। এ পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা যদি জীবনের মৌলিক বিষয়গুলো সম্পর্কে যথাস্থান থেকে যথাযথ শিক্ষা না পায়, তবে তারা কানাগলিতে পথ হারাবে।</p> <p>সমাজ সংসারে নারী-পুরুষের ভূমিকা, তাদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক, এসব বিষয়ে নেতিবাচক সামাজিক মূল্যবোধ এমনভাবে গেড়ে বসেছে যে তা তাড়াতাড়ি উপড়ে ফেলা সহজ নয়, কিছুটা সময় লাগবে। তাই পরিবর্তনের জন্য ব্যক্তিক, পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আমরা যত তাড়াতাড়ি কাজে নেমে পড়ব ততই মঙ্গল।</p> <p> </p> <p>লেখক : জাতিসংঘ সংস্থার অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা</p> <p>hhena54@gmail.com    </p>