<p>একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া একটি বিশেষ পর্যায়ে এসেছে। চারজন কুখ্যাত অপরাধীর ফাঁসি কার্যকর হওয়া এবং বাকি অপরাধীদের বিচার নিষ্পন্ন করার মধ্য দিয়ে দেশ কলঙ্কমুক্ত হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করছি। কিন্তু দেশের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা ধর্মীয় উগ্র গোষ্ঠী তথা জঙ্গিবাদের কবল থেকে দেশকে নিরাপদ করা এখন মূল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার প্রথম থেকেই জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স প্রদর্শন করছে। অর্থাৎ জঙ্গিবাদ দমনে এই সরকারের কোনো দুর্বলতা নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আগের চেয়ে আরো সতর্ক এবং গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু কেবল আইন কিংবা শক্তি প্রয়োগ নয়, গণসচেতনতা তৈরির মাধ্যমে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা জরুরি হয়ে পড়েছে। জঙ্গিদের অর্থায়নকারীদের খুঁজে বের করা হচ্ছে। তার সঙ্গে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমনে সম্পৃক্ত করা দরকার। মাদ্রাসা, স্কুল ও কলেজের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে জঙ্গিবাদবিরোধী সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে শিক্ষা উপকরণ ও পাঠ্যসূচিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। গণমাধ্যমে জঙ্গিবাদের নেতিবাচক দিক তুলে ধরে ব্যাপক প্রচারণার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।</p> <p>যেকোনো ‘যুদ্ধবাজ’ সংগঠনকে ‘জঙ্গি’ এবং তাদের মতবাদকে ‘জঙ্গিবাদ’ বলা হয়ে থাকে। জঙ্গিবাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ‘যুদ্ধকেই’ তারা একটি আদর্শ বলে গ্রহণ করে। সহিংসতা তাদের মোক্ষম হাতিয়ার। জঙ্গিবাদীরা আক্রমণাÍক আদর্শের অনুসারী এবং নিজেদের মতাদর্শকে তারা সর্বশ্রেষ্ঠ মতাদর্শ হিসেবে বিবেচনা করে। এ দেশের জঙ্গিবাদীরা তাদের মতাদর্শের ধর্মীয়করণ ঘটিয়েছে। বিশ্বের নানা দেশের মতো বাংলাদেশেও একাধিক জঙ্গিবাদী সংগঠনের অপতৎপরতা রয়েছে।</p> <p>২০০০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে সন্ত্রাসী আক্রমণে সারা বিশ্বে দেড় লাখেরও বেশি মানুষ মারা গেছে। ছোট-বড় সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে ৯০ হাজারের মতো। এ সময় বাংলাদেশে গ্রেনেড হামলা (২০০৪) হয়েছে এবং সিরিজ বোমায় (২০০৫) কেঁপে উঠেছিল সারা দেশ। ভারতে ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর মুম্বাই হামলা পুরো বিশ্বকে কাঁপিয়ে দেয়। সেদিন ওই শহরের তাজ হোটেলসহ বিভিন্ন স্থানে ১০টিরও বেশি ধারাবাহিক গুলি ও বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ২০০৫ সালের ৭ জুলাইয়ে মধ্য লন্ডনের তিনটি আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন ও একটি বাসে আত্মঘাতী সিরিজ বোমা হামলায় নিহত হয় ৫২ জন। আহত হয় সাত শতাধিক মানুষ। ব্রিটেনের মাটিতে এটাই ছিল স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা। লন্ডনে বোমা হামলাকারী চার জঙ্গির সঙ্গে আল-কায়েদার যোগাযোগ ছিল। ২০১৪ সালের শেষ দিকে পাকিস্তানের পেশোয়ারে সেনাবাহিনী পরিচালিত একটি স্কুলে বর্বর হত্যাযজ্ঞ চালায় তালেবান জঙ্গিরা। এতে নিহত হয়েছে ১৩০-এর বেশি শিক্ষার্থী। পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন তেহরিক-ই-তালিবান এ হামলার দায় স্বীকার করে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে লেবাননের বৈরুতে বেশ কিছু সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে আল-কায়েদা সমর্থিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো। এসব ঘটনায় অসংখ্য হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। লেবাননজুড়েই আইএসের তাণ্ডব চলছে। সর্বশেষ বৈরুতে আত্মঘাতী বোমা হামলায় ৪৩ জন নিহত হয়। বাংলাদেশে এযাবৎ চিহ্নিত জঙ্গি দল, গ্রুপ বা শক্তির সংখ্যা অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতের হিসাব অনুসারে মোট ১২৫। এদের মধ্যে জামায়াত, হিযবুত তাহ্রীর ও অন্যান্য মৌলবাদী দল একত্র হয়ে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করে দেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।</p> <p>তবে বিভিন্ন সময়ে ব্লগার, লেখক ও প্রকাশক হত্যাকাণ্ড এবং জঙ্গি দমন নিয়ে হতাশার কথা ব্যক্ত করা হলেও সেই হতাশা অনেকটাই অমূলক। কারণ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় আবহমান বাংলা সব সময়ই শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর। জঙ্গিদের কর্মকাণ্ড সমর্থন করা আর আমাদের হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে অস্বীকার করা একই কথা। উগ্র সাম্প্রদায়িক হামলা বন্ধ করতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। ধর্মীয় উগ্রবাদিতা থেকে মুক্ত থাকার জন্য মসজিদ-মাদ্রাসায় ইমামদের দ্বারা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে হবে।</p> <p>দলীয় স্বার্থে কোনো কোনো দল জঙ্গি সংগঠনগুলোকে ব্যবহার, অধিক প্রশ্রয় ও সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ব্যবহার করে থাকে-এ ধরনের হীন কার্যকলাপ থেকে তাদের বিরত রাখার জন্য জনগণকে সচেতন থাকতে হবে। মানুষের মঙ্গলের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যথার্থ ব্যবহার নিশ্চিত করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের সতর্ক করবে। দেশ ও জনগণের স্বার্থে জঙ্গিবাদ নির্মূলে সবার ভেতরে সুপ্ত দেশপ্রেম ও শুভবোধ জাগ্রত করার দায়িত্ব সবার। মূলত দেশ থেকে জঙ্গিবাদ নির্মূলে সরকারের পাশাপাশি সব রাজনৈতিক দল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবাইকে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় জঙ্গিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। দেশে সবার সার্বিক প্রচেষ্টায় এ ধরনের ঐক্যবদ্ধ সামাজিক প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তোলা অসম্ভব নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাগ্রত ধর্মনিরপেক্ষ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশের মানুষ কখনোই জঙ্গিবাদের হীন ষড়যন্ত্রকে এ দেশের মাটিতে কার্যকর হতে দিতে পারে না। গণতন্ত্র, সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং নিজেদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি জঙ্গিবাদ নির্মূলে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার বিকল্প নেই।</p> <p>লেখক : অধ্যাপক ও পরিচালক, জনসংযোগ,</p> <p>তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়</p> <p>writermiltonbiswas@gmail.com</p>
